ছবিঃ ১৯৭১ সালের ১৪ই ও ১৬ই মার্চ, দৈনিক আজাদ সম্পাদকীয়।
কয়েক দিন আগে ব্লগার গেছো দাদা তার একটি পোস্টে ভাষা শিল্পী মওলানা আকরম খাঁ সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন যে, তিনি বুঝি বাংলাকে পৌত্তলিকদের ভাষা মনে করতেন! সেই পোস্টে কোন ব্লগারই যুতসই কোন উত্তর দিতে পারেন নাই, উল্টো অনেকে সমর্থন জানিয়েছেন। লেখাটি পড়ে আমার খুব রাগ হয়েছিলো। তাই, কিছুটা স্টাডি করে আজকের পোস্টটি লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
কে ছিলেন গুরু মওলানা আকরম খাঁঃ
১৮৬৮ সালের ৭ জুন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনায় জন্ম নেন বাংলা ভাষার এই প্রবাদপুরুষ। ছোটবেলায় কলকাতার বিখ্যাত আলিয়া মাদ্রাসায় পড়েলেখা করা আকরম খাঁ সারা জীবন বাংলা ভাষা রক্ষার জন্যে আন্দোলন করে গিয়েছেন।
বাংলা ভাষা রক্ষায় ভাষা শিল্পী মওলানা আকরম খাঁ-এর অবদানঃ
কলকাতার আলিয়া মাদরাসা থেকেই শুরু। সেখানে পড়ালেখা করার সময় থেকেই, ১৮৯৬ সালে মাদ্রাসা সিলেবাসে বাংলা সংযোজনের জন্যে যে আন্দোলন হয়, তাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। এখানে উল্লেখ্য যে, মোঘল আমলে এ দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা ছিলো ফার্সী, ব্রিটিশদের সময়ে ইংরেজি, আর, পাকিস্তান আমলে উর্দু। সেই সময়েই, মওলানা আকরম খাঁ বাংলা ভাষাকে হাতিয়ার করে মুসলিম জাতিকে পুনর্জীবিত করার জন্যে একে একে বের করেন ত্রৈমাসিক মোহাম্মদী, মাসিক মোহাম্মদী, পাক্ষিক মোহাম্মদী, দৈনিক মোহাম্মদী, মাসিক আল এছলাম, সাপ্তাহিক সেবক, দৈনিক সেবক এবং দৈনিক আজাদ।
পূর্বপাকিস্তান মুসলিমলীগে সভাপতি হিসেবে বাংলা ভাষার প্রতি অনুরাগঃ
তদানীন্তন মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীরা মধ্যে মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি ক্ষমতাসীন দলের নেতা হয়েও রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবীতে 'তমদ্দুন মজলিস' পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরকে যে স্মারকলিপি দেয়, তাতে সর্বপ্রথমে তিনিই স্বাক্ষর করেন। উক্ত স্মারকপত্রে লেখা ছিলো- "বাংলা ভাষাকে পুর্ব্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার বাহন বলিয়া যেনো অতিসত্বর ঘোষণা করা হয়।"
ভাষা রক্ষার্থে সরকারী সিদ্ধান্তের বিরোধিতা ও পদত্যাগঃ
পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেটা ঠিক করার জন্যে সরকার একটি কমিটি করে দিয়েছিলো, সেই কমিটির সভাপতি করা হয় মওলানা আকরম খাঁ-কে। তিনি সেই পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ১৯৪৭ সালের ২১ জুন দৈনিক আজাদে লিখেছিলেন-
........"পুর্ব্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাঙ্গলা হইবে, তাহা পুর্ব্ব পাকিস্তানের ব্যবস্থাপক পরিষদেই সিদ্ধান্ত হইয়া গিয়াছে। এমতবস্থায় ভাষা নির্ধারণের জন্য কমিটি গঠনের কোনো প্রয়োজনীয়তা নাই বলিয়া আমি মনে করি।"
মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতিঃ
বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে ১৯৪৭ সালের ৪ ডিসেম্বর একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই সভায় মওলানা আকরম খাঁ'র সভাপতিত্বে বাংলা ভাষার দাবীতে একটি গণস্বাক্ষর স্মারক উত্থাপিত হয়। পরের দিন, অর্থাৎ, ৫ ডিসেম্বর এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে- রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে গ্রহণ করা হবে না।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া সম্পর্কে মওলানা আকরম খাঁ-এর বিবৃতিঃ
এই প্রসঙ্গে মওলানা সাহেব দৈনিক আজাদ-এ ৮ ডিসেম্বর, ১৯৪৭ সালে লিখেছিলেন-
" রাষ্ট্রের জনগণের মাতৃভাষাই সেখানকার জনগণের রাষ্ট্রভাষা হইবে, ইহাই সংগত ও স্বাভাবিক কথা। যেহেতু পূর্ব্ব পাকিস্তানের গণভাষা অবিসংবাদিত ভাবে বাঙ্গলা, অতএব, তাহার রাষ্ট্রভাষাও নিশ্চিতরূপে বাঙ্গলাই হওয়া চাই।"
"বস্তুতঃ বাঙ্গলাদেশের শিক্ষার বাহন বা অফিস আদালতের ভাষা বাংলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা হইতেই পারে না।"
"আম বৃক্ষের নিকট থেকে যেমন আখরোট ফল আশা করা সম্ভব নয়, বাঙ্গলাদেশেও বাঙ্গলা ছাড়া অন্য ভাষা শিক্ষা বা সহকারী অফিস আদালতের মাধ্যম হিসেবে আশা করা সেরূপ অসম্ভব ব্যাপার।"
আরবী হরফে বাংলা প্রচলনের বিরোধিতাঃ
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে দমাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলো। তারা এক পর্যায়ে, আরবী হরফে বাংলা ভাষা লেখার প্রস্তাব করে বসে। এতে বাধ সাধেন মওলানা আকরম খাঁ। তিনি বাংলা ভাষায় আরবী হরফ প্রচলন অন্তত বিশ বছর স্থগিত রাখার সুপারিশ করেছিলেন।
আরও অনেক কিছুই লেখার ছিলো। কলেবর বৃদ্ধি পাবে বলে লিখতে পারলাম না। খোদা আমাদেরকে মওলানা আকরম খাঁ-কে বুঝার তৌফিক দান করুন, এই কামনা করি। আমার এই লেখার রেফারেন্স চাইলে আমার সাথে যোগাযোগ করার ঠিকানা -
[email protected]
ছবি সূত্রঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ১২:৪২