তিনি ছিলেন বিবাহিতা। থাকতেন মদীনায়। একদিন তাঁকেই শয়তান দিল কু-মন্ত্রণা। এক লোকের প্রতি তার হৃদয় আসক্ত হল। লোকটিও আগে বাড়ল। এক সুযোগে লোকটি তাকে নিয়ে এক নির্জন স্থানে গেল। সেখানে প্রকাশ্যে তারা দু’জন ছাড়া আর কেউ ছিল না। তবে অদৃশ্যে অবশ্যই শয়তান ছিল। শয়তান তো থাকবেই। কারণ, নির্জনে দুই নারী পুরুষ একত্র হলে শয়তান সেখানে এসে হাজির হবেই; এটা তার ‘মিশন’। এখানেও তাই হলো। ফলে চোখের আড়ালে থেকে শয়তান ঐ দু’জনকে ধীরে ধীরে পরস্পরের প্রতি মোহিত ও প্রলুব্ধ করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত তারা শয়তানের কাছে প্ররোচণায় পা দিলো। ব্যভিচারে লিপ্ত হলো।
মহিলাটি কোন সাধারণ মহিলা ছিলেন না। ছিলেন নবীজীর সান্নিধ্যে ধন্য
সাহাবিয়্যাহ। তাই একটু পরই তাঁর হুশ হল। ততোক্ষণে শয়তান তার শয়তানী করে চলে গেছে। পাপ কাজ সংঘটিত করে শয়তান আর থাকে না। অন্যত্র গিয়ে নতুন ফাঁদ পাতে। এখানেও তাই হল। শয়তান চলে যাওয়ার পর মহিলার ভিতরে তোলপাড় শুরু হলো। পাপবোধে তাঁর মন মানস অন্ধকার হয়ে গেল। নিজের অস্তিত্বকে অসহ্য মনে হতে লাগল। তিনি শ্বাস-নিশ্বাস ঠিকই নিতে পারছেন। তবুও যেন তাঁর দম আটকে যাচ্ছে। হৃদয়টা পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। কোথাও বসতে ইচ্ছে করছে না। এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলেই যেন তিনি মারা যাবেন। তাই আর দেরী করলেন না। দ্রুত ছুটে গেলেন চিকিৎসা নিতে চিকিৎসা কেন্দ্রে। সায়্যিদুল মুরসালীন রহমাতুললিল আলামীনের কাছে।
শোনা গেল তাঁর উদ্বেগাকূল কণ্ঠ ‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমি যিনায় লিপ্ত হয়েছি। আমাকে জলদি পবিত্র করুন। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাঁর কথা শুনেও শুনলেন না, মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কিন্তু যে দিকে নবীজী মুখ ফিরিয়ে নিলেন, সে দিকে গিয়ে তিনি আবার বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি যিনায় লিপ্ত হয়েছি। আমাকে জলদি পবিত্র করুন। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তিনি এমনটি করলেন এ উদ্দেশ্যে যে, যেন মহিলাটি ফিরে গিয়ে খাঁটি হৃদয়ে তাওবা করে নেয়। আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে ও পেয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়।মহিলাটি এর পর চলে গেলেও পাপবোধের অসহ্য আগুনে দগ্ধ হচ্ছিলেন। ধৈর্যের বাঁধ বারবার ভেঙ্গে যেতে লাগল।
পর দিন নবীজী (সাঃ) যখন মসজিদে বসলেন, তখন আবার গিয়ে তিনি তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন‘হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমি যিনায় লিপ্ত হয়েছি। আমাকে জলদি পবিত্র করুন’। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এবারও মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তখন তিনি বলে উঠলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাকে ফিরিয়ে দেবেন, যেমন ফিরিয়ে দিয়েছেন মায়াজকে? আল্লাহর কসম! ব্যভিচার জনিত কারণে আমি গর্ভধারিনী’। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এবার তাঁর দিকে তাকালেন। বললেন- এখন নয়, এখন চলে যাও, সন্তান জন্ম দেওয়ার পর এসো।
তখন মহিলা মসজিদ থেকে বের হয়ে চলে গেলেন। পা চলতে চায় না, তবু পা টেনে তিনি গৃহে ফিরলেন। দুঃশ্চিন্তা দিন দিন বেড়েই চলল, শরীর ভেঙ্গে পড়লো। অনুতাপ দগ্ধ হৃদয় থেকে উৎসারিত অবিরত অশ্রুধারা জারি থাকলো। দিন গুনতে লাগলেন। অপেক্ষার কঠিন কঠিন দিন, যেন শেষ হতেই চায় না। জন্ম নেয় মাটিতে বেদনার বৃক্ষ। তাওবা ছাড়া মৃত্যুর আশংকায় বারবার কেঁপে উঠে সে বেদনা বৃক্ষের ডালপালা। এক সময় ফুরালো অপেক্ষার ‘নীল প্রহর। এলো প্রসবকাল। এলো সন্তান। প্রসবের পর আর সইতে পারলেন না। ছুটে গেলেন নবজাতককে কোলে করেই আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর কাছে। গিয়েই নবজাতককে রাখলেন তার সামনে। তারপর বললেন- হে আল্লাহর রাসূল! আমি যিনায় লিপ্ত হয়েছি। আমাকে জলদি পবিত্র করুন। দয়া ও করুণার নবী তাকালেন তাঁর দিকে। দেখলেন তাঁর দূরাবস্থা। তাঁর দুশ্চিন্তা ও অনুশোচনা ঘেরা ক্লান্তি ও ব্যাকুলতা। তারপর তাকালেন শিশুটির দিকে। দুগ্ধপুষ্য শিশু! কেমনে চলবে মা বিহীন! তাই বললেন ‘ফিরে যাও! দুধ পান করাতে থাক! দুধ ছাড়ানোর পর এসো। আবার চলে গেলেন তিনি।
এবার শুরু হলো দুধ পান করানোর কঠিন দু’টি বছর। সহজে কি শেষ হতে চায়? নবজাতকের মায়াভরা মুখ দেখে দেখে, নীরব অশ্রুপাতের উষ্ণ ধারায় তার চেহারা মুছে মুছে, ‘বিদায়ী চাহনির’ ছলোছলো অভিব্যক্তিতে তাকে প্রতিদিন বিদায় জানাতে জানাতে এক সময় শেষ হয়ে এলো তাঁর অপেক্ষার বেলা। সন্তানকে কোলে নিয়ে ছুটে গেলেন তিনি আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এর নিকটে। থামলেন গিয়ে তার সামনে। বললেন, হে আল্লাহর নবী! এই যে আমি এর দুধ ছাড়িয়ে এসেছি। এবার আমাকে জলদি পবিত্র করুন।
আল্লাহর নবী তখন তাঁর সন্তানটিকে একজনের দায়িত্বে দিয়ে তাঁকে বুক পর্যন্ত মাটিতে গেড়ে প্রস্তরাঘাতের নির্দেশ দিলেন। প্রস্তরাঘাতে তাঁর মৃত্যু হলো। হ্যাঁ, তিনি মারা গেছেন। কিন্তু তাঁকে গোসল দেওয়া হয়েছে। দাফন করা হয়েছে। আল্লাহর নবী স্বয়ং তাঁর জানাযা পড়িয়েছেন। আর বলেছেন, সে এমন তাওবা করেছে, যা মদীনার সত্তর জন তাওবাকারীর মাঝে বণ্টন করে দেওয়া যাবে।
পাবেন কি আপনারা এমন কাউকে, যে তাওবার পথে নিজের জীবনটাই বিলিয়ে দিয়েছে? স্বেচ্ছায়! সাগ্রহে! এমন মরণ, কার ভাগ্য করে বরণ?
হে মহিয়সী! ধন্য আপনি ধন্য! লিপ্ত হয়েছিলেন ব্যভিচারে! ছিন্ন করে দিয়ে ছিলেন আল্লাহর পর্দা! তারপর? তারপর অন্ধকার থেকে শুধু আলোর দিকে ছুটে চলা। পরকালে আপনার অফূরন্ত নিয়ামত।
সম্মানিত পাঠক পাঠিকা, এমনই ছিলেন সে যুগের নারীরা। পাপ হয়েছে, সাথে সাথে এসে তাওবাও, অনুশোচনাও। কিন্তু একটু ভাবুন তো, বর্তমান যুগের নারীদের নিয়ে? তাদের মধ্য থেকে কতোজনের পা ফস্কে গেছে, স্খলিত হয়েছে পাপাচারের পিচ্ছিল জগতে, বরং তাদের আশেপাশে শয়তান জায়গা করে নিয়েছে বেশ স্বাচ্ছন্দে, তারপর তাদেরকে বিপথগামী করেছে, বের করে নিচ্ছে ইসলামের সুরক্ষিত সীমানা থেকে। তখন নামায তরক করছে তারা। নামাযের গুরুত্ব মূল্যহীন হয়ে পড়েছে তাদের কাছে। স্বামীর অবাধ্য হচ্ছে। বেপর্দায় চলাফেরা করছে। আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন, কেমন ছিলেন সে যুগের নারীরা।
হ্যাঁ, সোনালী অতীতে আমাদের গর্বিত নারী জাতি অন্যায় ও অসত্যের সাথে কখনো আপোষ করেননি। শয়তানের প্ররোচণায় গুনাহ করেছেন, তবে সাথে সাথে তাওবা ও অনুশোচনা করে নিয়েছেন। তাঁরা জান দিয়েছেন, তবু মান দেননি। নির্যাতন ভোগ করেছেন, তবু নতি স্বীকার করেননি। তপ্ত লৌহ শলাকার ছ্যাঁকা সয়েছেন, স্বামী-কন্যা-পুত্রের বিচ্ছেদ মেনে নিয়েছেন, তবুও তাঁদের পবিত্র বিশ্বাস থেকে তিল পরিমাণও সরে আসেননি। 'আল্লাহ’ আমার রব- এ উচ্চারণে সদা মুখর ও সজীব ছিল তাঁদের কণ্ঠ।
যখন এসেছে চ্যালেঞ্জ পর্দার সামনে, তখন তারা বলেছেন নির্ভীক কণ্ঠে- না, পর্দা আমি ছাড়ব না, পর্দা আমার অহংকার। যখন বিপদ এসেছে তাদের ইজ্জত আব্রুর উপর, তখন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন তাঁরা, জান দেব, তবু মান দেব না। যখন ডাক এসেছে জীবন বিলানোর, তখন শোনা গেছে তাঁদের আনন্দ বিগলিত কণ্ঠে- ‘আমার জীবন তো আমার না! এ জীবনের বিনিময়ে না আমি আল্লাহর কাছ থেকে জান্নাত খরিদ করেছি!
এরা নারী জাতির চির গর্ব। চির অহংকার। চির স্মরণীয় এরা। জীবন কেটেছে তাঁদের একই ধ্যান-জ্ঞানে। আর তা হলো, কীভাবে তাঁরা ইসলামের খিদমত করবেন। দ্বীনের তরে বিলিয়ে দেবেন ধন সম্পদ, সময় কাল এবং জান-জীবন।