আজ অনলাইনে হিরামণির মায়ের ফরিয়াদের ভিডিও দেখলাম, ভয়ে মনটা কেঁপে উঠল, তাই এই পোস্টটি লিখা, যাতে আমরা সতর্ক হতে পারি। হিরামণির মায়ের আহাজারির ভিডিওটি পোষ্টের শেষে দেয়া হোল। লক্ষ্মীপুরে ক্যান্সারে আক্রান্ত স্বামীর চিকিৎসায় হিরামণির মা ঢাকাতে অবস্থান করছিলেন। হিরামণী তার নানার বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে এসেছিল পরদিন বাবা মায়ের কাছে ঢাকা যাবে বলে। এদিকে বাড়িত আসার পর ফুলের মতো নিষ্পাপ ৯ম শ্রেণীর ছাত্রী হিরা মণিকে দিনের আলোতে ধর্ষণ করে মেরে ফেলেছে নরপশুর দল। মনে রাখবেন, জুলুমকারিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাবান, শক্তিশালী, এবং চতুর হয়ে থাকে।
জুলুম আরবী শব্দ যার অর্থ হল অত্যাচার, নির্যাতন, নীপিড়ন, বঞ্চণা, প্রবঞ্চনা, উৎপীড়ন, ভরাক্রান্ত কাজ, ভারসাম্য রক্ষা না করা ইত্যাদি। বর্তমান বিশ্বে জুলুম একটি সহনীয় এবং নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। শান্তি ও মানবতার ধর্ম ইসলামে সব ধরনের জুলুম বা অত্যাচার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ও হারাম। শুধু জুলুম নয়, জুলুমের সহযোগিতা করা এবং জালেমদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করাও হারাম। আর এ বিধান শুধু মুসলমান নয়, কোনো অমুসলিমের ওপর জুলুম করলেও তার জন্য এ হুকুম। ইসলাম মতে, মানুষের ওপর জুলুম এক ভয়াবহ গোনাহ। এ কারণে পরকালে দোজখে প্রবেশ করতে হবে। জুলুম অনেক ভাবেই হতে পারে। নিম্নে এর নয়টি ধরণ উল্লেখ করা হলঃ
১।জীবনের উপর জুলুমঃ কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে
২।সম্পদের উপর জুলুমঃ কারও সম্পদ অন্যায়ভাবে ক্রোক করে।
৩।সম্ভ্রমের উপর জুলুমঃ কারও সাথে জোড়পুর্বক মিলন স্থাপন করা।
৪।অধিকার হরণ করার জুলুমঃ কাউকে তার মৌলিক অধিকার হতে বঞ্চিত করা
৫।ইজ্জতের উপর জুলুমঃ কারও নামে অপবাদ বা কাউকে সম্মুখে অপমান করা।
৬।অন্য কারো আইন মানা আল্লাহের আইন বাদ দিয়েঃ আল্লাহ যে হুকুম দিয়েছেন তা না মেনে অন্য আইন মানা
৭।ভূমির উপর জুলুমঃ কেউ কারও জমি অন্যায়ভাবে দখল করা
৮।মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ারঃ কেউ আদালতে এসে মিথ্যা বলে আসামীকে ফাসিয়ে দেয়।
৯। মজুরী আদায় না করেঃ শ্রমিককে যদি যথার্থ মজুরী না দেওয়া হয় তবে তা হবে জুলুম।
১০। ইয়াতীমের মাল ভক্ষণঃ অর্থাৎ যাদের মা বাবা নাই তাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করা হল এক চরম পর্যায়ের জুলুম।
মজলুম বা নিপীড়িতের দোয়া কখনো ব্যর্থ হয় না। তাই মজলুমের অশ্রুফোঁটা ও অন্তরের অভিশাপ পতনের অন্যতম কারণ। মজলুমের আর্তনাদের ফলে আল্লাহর পক্ষ থেকে জালিমদের ওপর নেমে আসে কঠিন আজাব। তাদের অধঃপতন ত্বরান্বিত হয়। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া আল্লাহর কাছ থেকে ফেরত আসে না। এক. ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া। দুই. ন্যায়পরায়ণ শাসকের দোয়া। তিন. মজলুমের দোয়া। আল্লাহ তাআলা তাদের দোয়া মেঘমালার ওপরে তুলে নেন এবং তার জন্য আসমানের দরজাগুলো খুলে দেন। মহান রব বলেন, আমার সম্মানের শপথ, কিছুটা বিলম্ব হলেও আমি তোমাকে অবশ্যই সাহায্য করব।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৯৮)
আল কোরানে মহান আল্লাহ বলেন, তুমি কখনও মনে করবে না যে, জালিমরা যা করে, সে বিষয়ে আল্লাহ্ গাফিল। তিনি তাদেরকে সে দিন পর্যন্ত অবকাশ দেন, যে দিন তাদের চোখগুলো হবে স্থীর, ভীত বিহবল চিত্তে আকাশের দিকে চেয়ে তারা ছুটাছুটি করবে, নিজেদের প্রতি তাদের দৃষ্টি ফিরবে না এবং তাদের অন্তর হবে শূণ্য (সূরা ইব্রাহীমঃ ৪২-৪৩)। ‘আর তোমরা জালেমদের প্রতি ঝুঁকে পড়বে না, জালেমদের সহযোগী হবে না, তাহলে জাহান্নামের আগুন তোমাদেরও স্পর্শ করবে’ (সূরা হুদ : ১১৩ : আয়াত)।
মজলুমের দোয়া আল্লাহ সরাসরি শুনেন এবং কবুল করেন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মুআয (রাঃ) কে ইয়মানে পাঠান এবং তাকে বলেন, মাজলুমের ফরিয়াদকে ভয় করবে। কেননা তার ফরিয়াদ এবং আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা থাকে না। (বুখারী ২২৮৬, ইঃফাঃ)। রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘তোমরা মজলুমের দোয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকো। কেননা মহান আল্লাহ ও তার দোয়ার মাঝে কোনো পর্দা থাকে না।’ (বুখারি, হাদিস : ১৪৯৬)। হয়ত জুলুমকারী কিছুদিন অবকাশ পায়।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা জালেমকে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন। অবশেষে যখন পাকড়াও করেন তখন তাকে আর রেহাই দেন না। অতঃপর তিনি এই আয়াত পাঠ করেন, তোমার প্রভুর পাকড়াও এ রকমই হয়ে থাকে, যখন তিনি জুলুমরত জনপদগুলোকে পাকড়াও করেন। তার পাকড়াও অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক, অপতিরোধ্য। সহিহ বোখারি ও মুসলিম। আমাদের মনে রাখা দরকার, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন এমন এক অপরাধ যা সাধারণত আল্লাহ মাফ করেন না, যতক্ষণ পর্যন্ত ওই মজলুম ব্যক্তি (যার প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে) জালেমকে (অত্যাচারী ব্যক্তিকে) মাফ না করেন।
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মু’মিনগণ যখন জাহান্নাম থেকে নাজাত পাবে, তখন জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝখানে এক পুলের উপর তাদের আটকে রাখা হবে। তখন পৃথিবীতে একের প্রতি অন্যের যা যা জুলুম ও অন্যায় ছিল, তার প্রতিশোধ গ্রহণের পরে যখন তারা পরিচ্ছন্ন হয়ে যাবে, তখন তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে। সেই সত্তার কসম, যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ, নিশ্চয়ই তাদের প্রত্যেকে পৃথিবীতে তার আবাসস্থল যেরূপ চিনত, তার চাইতে অধিক তার জান্নাতের আবাসস্থল চিনতে পারবে। (বুখারী ২২৭৮, ইঃফাঃ) ।
আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমার ভাইকে সাহায্য করো, সে জালিম হোক অথবা মাজলুম। তিনি (আনাস) বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! মাজলুমকে সাহায্য করব, তা তো বুঝলাম। কিন্তু জালিমকে কি করে সাহায্য করব? তিনি বললেন, তুমি তার হাত ধরে তাকে বিরত রাখবে (অর্থাৎ তাকে যুলুম করতে দিবে না)।(বুখারী ২২৮২, ইঃফাঃ)
আসুন আমরা মজলুমের জন্য দোয়া করি, তার পক্ষে দাড়াই, আর জালিমকে নিভৃত করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন, আমীন।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুন, ২০২০ বিকাল ৫:০৫