আমাদের তুই (To The Child)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
রিক্সায় করে ঘোরা আমাদের খুব প্রিয় কাজ গুলোর একটি। প্রায়ই সুযোগ পেলেই আমি আর তোর মামনি রিক্সা নিয়ে ঘুরতে বের হতাম। তেমনি একদিন অফিস থেকে ফিরছি, তোর মামনি এসে আমাকে রিক্সায় তুলে নিল। সন্ধ্যা হতে অল্প কিছু সময় বাকি- গোধূলি, আমার খুবই প্রিয় মুহুর্ত ।
তখন হঠাৎ করে কথার ফাঁকে তোর মামনি ঘোষনা করল তোর আগমনি বার্তা। আমরা জানতাম তুই আসছিস, তবুও দুজনে ঠিক ঐভাবে এ নিয়ে কথা হয়ে উঠেনি। আজ তোর মা সরাসরি জানাল এই সংবাদ। শোনা মাত্রই আমার সারা গা কেমন যেন কাঁপতে লাগল। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলামনা, তোকে বোঝাতেও পারবোনা, কিংবা অন্য কাউকেও বলে বোঝানো সম্ভবনা এই অনুভূতি। তোর মামনি আমার হাত টাকে শক্ত করে ধরে রইল। আমার মাথায় তখন নানা কথা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতদিন ছিলাম আমরা দুজন, আমাদের ছন্নছাড়া পথচলা- সেখান থেকে সব বদলে নিতে হবে। বলতে পারিস ঠিক ঐ মুহুর্ত থেকেই আসলে সব বদলে যেতে শুরু করল।
মাথায় নানা চিন্তা, তোর জন্য বদলে নিতে হবে আমাদেরকে, কি করা যাবে , কি করা যাবেনা, আফটার অল যখন তখন , রাত বিরাতে তোর মামনিকে নিয়ে এই ভাবে রিক্সায় ঘুরে বেড়ানো যাবেনা, হুঠহাট ঘুরতে চলে যাওয়া যাবেনা। তোর জন্য আমরা নিজেদেরকে সেভাবেই বদলে নেব ঠিক করলাম।
তোর মামনির মাঝে মনে হয় তখন থেকেই পরিবর্তন হওয়া শুরু হয়ে গেল, যদি ও আমার কাছে বিষয়টা মানে নিজেকে বদলে নেয়ার ব্যাপারটা অত সিরিয়াসলি ইফেক্ট ফেলেনি। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময়ই বেশ সতর্ক ভাবে সে পা ফেলছে, আস্তে আস্তে এক একটি পদক্ষেপে উপরে উঠছে। আমাদের পাঁচ তালায় অবস্হিত বাসাটা নিয়ে কিঞ্চিৎ খারাপ লাগা শুরু হল। যদিও আগে দক্ষিনের অবারিত আকাশ দেখে আমরা মুগ্ধ হতাম কিন্তু এখন কেন জানি এত উপরের এই ফ্ল্যাটটাকে সমস্যাই মনে হতে লাগল। তোর মার জন্য এত উপরে হেঁটে উঠাটা কস্টসাধ্যই বলা চলে।
আধুনিক যুগ, ঘরে বসেই সব জানা যায়। তোর মামনি সকাল সকাল ই নিশ্চিত হল হ্যাঁ, পরম করুনাময় আল্লাহ তোকে পাঠাচ্ছেন আমাদের ঘরে। সে খুব আলতো করে আমাকে ঘুম থেকে তুলে জানাল এই ঘটনা । তোর মা নাকি আরো অনেকক্ষন আগেই নিশ্চিত হলেও আমাকে ঘুম থেকে তুলতে পারছিলনা, তার সারা শরীরই নাকি কাঁপছিল। পরম মমতা নিয়ে তোর মার কপালে একটা আদর দিয়ে দিলাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বলল, আমার বাবুটার জন্যও আরেকটা আদর দাও। ঘুম জড়ানো চোখে হালকা বিষ্ময় ও ছুঁয়ে গেল আমাকে, এখনই কি নিদারুন মমতায় সে তোকে তার নিজের করে নিয়েছে।
আমার জন্য আরো বিষ্ময় অপেক্ষা করছিলো । তোর মামনি ফোনটা হাতে নেয়াতে জানতে চাইলাম কাকে ফোন করছ !! বলল অফিসে জানিয়ে দিবে সে আর জব করবেনা, আজকে থেকেই রিজাইন দিবে। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলামনা সে কি বলছে। ব্যাপারটা ক্লীয়ার করে বলল- আমাদের বাসা থেকে অফিসে আসা যাওয়াই তার যে পরিশ্রম এবং রাস্তা ঘাটের যে দশা তাতে অফিস করলে ব্যাপারটা তোর শরীরের জন্য ভাল হবেনা , তাই সে আর জব করতে ইচ্ছুক না। উচ্ছ্বাস এর সাথে নার্ভাসনেস - দুটোই ছিল তার চোখেমুখে, নিবৃত্ত করলাম এই বলে এখনও সাত সকাল , অফিসে কেউ আসেনি, অফিসতো অন্তত খুলতে দাও..........
তোর মায়ের এই আচরনে আমি সত্যি সত্যিই অবকা হয়ে গেছি। তার সাথে পরিচয়ের পর সে আমার থেকে কমিটমেন্ট আদায় করে নিয়েছিল এই বলে যে, সে জব করবে এবং তা নিয়ে আমার কোন আপত্তি করা চলবেনা । আমার আপত্তি করার কোন কারন ও ছিলনা। দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানিজ্য অনুষদের প্রথম দশজন ছাত্রছাত্রীর একজন সে, তার পথ চলার ডিসিশান সে নিজেই নিবে, ঐ বিষয়ে আমার নাক গলানোর কোন দরকার ই নেই। আর আজ সেই মেয়ে কিনা তোর আগমনী সংবাদে সোজা ঘোষনা করে দিল আপাতত সে আর জব করছেনা ।এবং সে তার কথায় অনড়, অফিস তাকে কিছুদিন ছুটি নিয়ে পরে জয়েন করতে বললেও তোর মামনি রাজি হলনা। চির চঞ্চল তোর মামনির এহেন কাজকর্ম আমি অবাক হয়ে শুধু দেখলাম, আর ভাবছিলাম মাতৃত্ব জিনিসটা আসলেই এমন একটা কিছু, যেটা মুহুর্তে একটা মেয়েকে একশতভাগ বদলে দেয় ।
তোর বড় মামীকে জানানোর পর তোর মামী বলল একবার মেডিক্যালে ফাইনাল টেস্ট করে নিতে। কারন তোর মায়ের সব কিছুই এখন থেকে নিয়মতান্ত্রিক হতে হবে, নানা বাঁধা নিষেধ এসে ভর করবে তার জীবনে। পরীক্ষা করার জন্য স্যাম্পল হাসপাতালে দেয়া হল। এই সময়টা যে কি নিদারুন উত্তেজনায় কাঁটল আমার আর তোর মায়ের তা এমন সিচুয়েশন না হওয়া পর্যন্ত কেউ কখনো বুঝবেনা। রিপোর্ট দিবে এক দিন পরে। অফিসে কোন ভাবেই মন বসাতে পারছিনা। এহেন পরিবর্তনে ঠিক কি করা উচিৎ তাও বুঝতে পারছিনা। ঐদিকে তোর মামনি জবটব ছেড়ে বাসায় বসে আছে। তোকে নিয়ে সে কোন রিস্ক নিতে রাজি না । আমি অফিসে, সে বাসায়, দুজনই অস্হিরতায় ভুগছি। ফাইনাল রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কাউকে কিছু জানাচ্ছিও না। মনে মনে সারাক্ষন তোর সাথে আমি হাজারো কথা বলে চলেছি। কত যে কথা- তোকে নিয়ে নানা চিন্তা, দেশের নানা অস্হিরতাও মাঝে মাঝে ছুয়ে যাচ্ছে। সুন্দর একটা পৃথিবী তুই পাবি সারাক্ষন এই কামনাই করছি আল্লাহর কাছে। অফিসে বসে বসে ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিলাম-
যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপনে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি--
নব জাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার ।
এটা দেয়ার সাথে সাথেই আমার বন্ধুরা নানা রকম মন্তব্যে ভরিয়ে তুলল। জেনে হউক না জেনে হউক সবাই শুভ কামনা করে গেল তোর জন্য । যদিও আমি কোন রিপ্লাই দিলামনা ।
তোর দাদা- দাদীর কাছে তোর আগমন সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা, নিজের তৃতীয় প্রজন্মের দেখা পাওয়া। তোর মামনির সাথে ফোনালাপে তারা দুজনই আনন্দাশ্রু বিসর্জন দিলেন, আর এমন সময় তোর মামনির কাছে তারা নেই এই নিয়ে তাদের আফসোসের ও সীমা নেই। তোর দাদাত আমাকে কি রত্ন আমরা পাচ্ছি সে নিয়ে বিশাল জ্ঞানগর্ভ উপদেশ দিয়ে ফেললেন। তোর দাদীমা কেমন করে তোর মামনির যত্ন নিতে হবে সে নিয়ে অনেক কিছু বলে ফেললেন- কি খাওয়া দরকার থেকে শুরু করে অনেক কিছুই। তোর নানীর কাছে অবশ্য এ অনুভূতি নতুন নয়। তিন তিনটি মামাত ভাই বোনের উপস্হিতির কারনে তিনি এ বিষয়ে অনেক অভিজ্ঞ। অতি আদরের মেয়েকে নিয়ে তিনি অনেক বেশী চিন্তিত। আর তাই স্কুল বন্ধ হবার সাথে সাথেই তিনি চলে আসলেন তোর মামনিকে সঙ্গ দেয়ার জন্য। অফিস থেকে যখন ফিরছিলাম ফোন করলাম তোর মামীকে, আমাদের বিয়ে থেকে শুরু করে সব কিছুতে যার নিবিড় মমতার ছাপ। তার সাথে ফোনে কথা বলতে গিয়ে আমি কেঁদে ফেললাম। নানা টেনশন, নানা চিন্তা সব কিছুই তোর মামীর সাথে শেয়ার করলাম। শেষ কবে কেঁদেছিলাম মনে নেই, কিন্তু তোর মামীর সাথে ফোনে যেন আমি সব বাঁধা হারিয়ে ফেললাম। ডুকরে ডুকরে কান্না করলাম। নানা সাজেশন দিল তোর মামী, সাহস দিল। জগত সংসারে এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, মনে সাহস রেখে প্রস্তুতি নিতে হবে। তোর সুন্দর আগমন নিশ্চিত করতে হবে, সে নিয়ে এখন থেকেই পরিকল্পনা করতে হবে।
আমার এই ডুকরে কাঁদা তোর মামনির কাছে লুকাতে পারলামনা । দুজন দুজনকে ধরে আরো কিছুক্ষন কাঁদলাম। বিশ্বাস কর আমরা দুজন ভালবাসায় পরিপূর্ণ জীবন পার করছিলাম, সারাক্ষনই একে অন্যের জন্য নানা ভাবনা আমাদের, সারাক্ষনই একে অন্যের খবর নেয়া, এক নিমিষেই সব কিছু কেমন করে যেন বদলে গেল। আমাদের সব, সব কিছু জুড়ে শুধু তোর অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলাম আমরা। ভাবনা চিন্তা সব কিছু তোকে ঘিরে, আমরা আমাদেরকে হারিয়ে ফেললাম তোর মাঝে। তুইই যেন আমাদের অস্তিত্ব । ।
(চলবে )
৭২টি মন্তব্য ৭২টি উত্তর
পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন
আলোচিত ব্লগ
শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক
আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।
“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন
কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য
ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার
(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন
প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭
ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।
এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন
একাত্তরের এই দিনে
শহীদুল ইসলাম প্রামানিক
আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন
হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে
তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন