somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হিটলারের হাত

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ৮:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



শাওকাত খানের চোখমুখ খুশিতে রঙ্গীন রাংতার মত ঝলমল করছে। চোখদুটো যেন নিলকান্তমনি। কুপি বাতির উগড়ানো ধোঁয়ায় অস্পষ্ট হলেও ঠিকরে বেড় হতে চাইছে যেন। তার একমাত্র ছেলে বাড়ি ফিরেছে দীর্ঘ ৭ বছর পর। এর চেয়ে খুশির আর কি হতে পারে!
১৯৪০ এ ছেলেটা পি এইচ ডি করতে ভিয়েনায় চলে গিয়েছিল স্কলারশিপ নিয়ে। কথা ছিল পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে প্রস্তাবিত ঢাকা মেডিকেল কলেজে জয়েন করবে। শের এ বাংলা এ কে ফজলুল হক নিজে তাকে এবং ছেলেকে অনুরোধ করেছিলেন। বলেছিলেন তার মত সন্তান এই দেশের দরকার।
ছেলে কথা রাখে নাই, সেখানেই থেকে গিয়েছিল। কিসের টানে কে জানে? গত ৭ বছর পরিবারের সাথে কোনরুপ যোগাযোগ ছিল না। সবাই ভেবে নিয়েছিল ২য় বিশ্বযুদ্ধের টালমাটাল সময়ে মারা পড়েছে, না হলে কিভাবে নিজের পরিবারের সাথে এত বছর যোগাযোগ না করে থাকতে পারল?
অদ্ভুত এক সময়ে সে ফিরে এল যখন ভারত, পাকিস্থান নামে দুটো রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে।
শাওকাত খানের শরীর ভালো যাচ্ছিল না। হেকিম, কবিরাজ, ডাক্তার কেউই তার অসুখ তাড়িয়ে সুখ এনে দিতে পারছিলেন না। সবাই শাওকাত খানের মৃত্যু হবে বলে ধরে নিয়েছিল। কাদের খান ফিরে আসাতে বাবা শয্যা ছেড়ে উঠে বসেছেন। তার বংশ প্রদীপ একমাত্র ছেলে ফিরে এসেছে। এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে?
কাদের সাথে করে এক বিদেশী বন্ধু নিয়ে এসেছে। মাথায় বড় চুল, মুখভর্তি দাঁড়ি, শরীরের রঙ উজ্জ্বল, চোখ সাগরের জলের মত নীলাভ। বেঁটে করে ছেলেটা ধীর স্থীর, কোনকিছুতে তাড়াহুড়া নাই। শীতের স্বচ্ছ পুকুরের জলের মত শান্ত নীরব। কিন্তু চোখদুটোতে অসম্ভব জিঘাংসা। ছেলেটাকে চেনা চেনা লাগছে। সে খুব চেষ্টা করছে চোখের ভাষা লুকাতে।
শাওকাত খান খুব বেশী লজ্জা দিল না ছেলেটাকে। কাদের মাঝে মাঝে তার সাথে কি ভাষায় কথা বলছে শাওকাত খান বুঝতে পারে না, তবে এতটুকু পরিষ্কার ইংরেজীতে নয়।
কাদের খান ফিরেছে মধ্যরাতে। বিশাল বাড়ির কাউকে না জাগাতে অনুরোধ করেছে। শুধু মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছে মা খুব খিধে পেয়েছে খাবার দাও। কাদেরকে না জানিয়ে শাওকাত খান পুকুরে জাল ফেলেছেন মধ্যরাতে। ৭ বছর পর তার ছেলে ফিরেছে, সাথে বিদেশি বন্ধু! যত রাতই হোক যেনতেন খাবার তো দেওয়া যায় না। কেউ একজন দুটো হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেল।
বিদেশি ছেলেটা টুলের ওপর বসেছে, তার দৃষ্টি কুপি বাতির দিকে। বাতির চারপাশে নাম না জানা পোকা আগুনের তাপে গলে গলে পড়ছে। চারদিকে অসম্ভব রকম নীরবতা, মন খারাপ করে দেওয়ার মত। ছেলেটা অনেক কিছুই ভাবতে পারে, ভাবছে না। সে প্রকৃতির অদ্ভুত নিয়তির শিকার। মরে পরে যাওয়া পোকাদের মত। ছেলেটার আসল পরিচয় কেউ জানে না কাদের ছাড়া। একসময়ের অসম্ভব ক্ষমতাধর এই ব্যাক্তি সবকিছু হারিয়ে পালিয়ে এমন এক জায়গায় এসে পড়েছে যেখানে হ্যাজাক, কুপি বাতি দিয়ে অন্ধকারের সাথে ডীল করতে হয়।
অন্ধকারেরও একটা সৌন্দর্য্য আছে। অসংখ্য জোনাকী পোকা অন্ধকারের গায়ে ফোয়ারার গাঁথুনি তুলছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকা একঘেয়ে সুরে ডেকে চলেছে। এই সুর তার অসহ্য লাগছে, কানের ভেতর ঢুকে এক ধরনের নির্লিপ্ত আতংক তৈরি করছে। অতীতের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যে প্রানপনে চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার চোখে এক পৃথিবী ঘুম। কতদিন সে চোখভরে ঘুমায় না। তার যদি আলঝেইমার নামক রোগ হত সবকিছু ভুলে যেতে পারত তাহলে। সে ভুল ছিল! পৃথিবীর কোনও কিছুই আসলে মানুষ সম্বোধনের সৃষ্টির হাতে নাই! মানুষকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয় নাই।
খাবার প্রায় তৈরি হয়ে গেছে। কাদির চুলার পাশে মায়ের সাথে রান্না দেখছে। আয়োজন খুব বেশী না।
কাদের খানের মা বারবার জিজ্ঞেস করছেন তোর বন্ধু কি করে এসব খাবার খাবে? আমাদের আর তার খাবার নিশ্চয়ই এক নয়!
রান্নাঘরে আরও দুইজন মহিলা গোলেজান বেওয়া কে সাহায্য করছেন। গোলেজান বেওয়া পরিচয় করিয়ে দেয় কাদির! তুই কি তোর কাকীমা দের ভুলে গেছিস? কাদির খান আস্তে কাকীমাদের পা ছুঁয়ে সালাম করে।
গোলেজান হাসে, যাক বিদেশে গিয়ে আদবকেতা সবটুকু ভুলিস নি তাহলে। তোর নানাজান তোকে দেখলে যে কি খুশি হবে! সকালেই খবর পাঠাবো।
আচ্ছা মা পাঠিও! আগে খাবার করো, পেটে কালবৈশাখী ঝড় বইছে।
শাওকাত খানের খানদানি বংশ। তার বাড়িতে ডাইনিং টেবিল আছে, ভারী নকশা করা। ব্যাবহার হয় না বললেই চলে। আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে রাখা হয়েছে। বাড়িতে দামি অতিথি এলে লাগানো হয়। আজ অনেকদিন পরে কাজে লাগছে। অনেকদিন পরে লাগানো টেবিলে বসে হাত দিয়ে খাবার খাচ্ছেন একসময়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর, বর্তমানে সবচেয়ে ঘৃনিত ব্যাক্তি। ছেলেটা দুই হাতই ব্যাবহার করছে। সে এখনও হাত দিয়ে খাওয়ার ব্যাপারটা পুরোপুরি রপ্ত করে উঠতে পারে নাই। রুই মাছের বড় পেটি, আলু ভর্তা, ডাল, কালোজিরা চালের ভাত। একটু পরপর পানি খেতে হচ্ছে তাকে। ঝাল খাবারে তার সমস্যা।
গোলেজেন বেওয়া ছেলের অনুরোধে একেবারেই ঝাল কম দিয়েছেন, তাও কষ্ট হচ্ছে। কাদিরকে বারবার বলছে তুই নিষেধ করলি তাও বেশী দিয়ে ফেলেছি।
কি যে বল মা! এর চেয়ে কম হয় না কি? ওর জিভে সমস্যা! দুই তিন দিন পর ঠিক হয়ে যাবে।
গোলেজান বেওয়া অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে থাকে! আহারে ছেলেটা ঠিকমত খেতে পারছে না।
শাওকাত খান খাওয়া দেখছেন আর হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন কাদিরের বন্ধুকে।
ফজল জোড় করে শাওকাত খানের হাত থেকে পাখা নিতে গিয়েও পারল না। কাকা আপনের এমনিতেই শরীর খারাপ আমি বাতাস করি। শাওকাত খান চোখ বড় করে বললেন কি বলছিস তুই? আমি পুরোপুরি সুস্থ।
গোলেজান বেওয়া দুই চোখ ফেলে ছেলেকে দেখছেন, কতদিন পরে ছেলেকে নিজের হাতের রান্না খাওয়াচ্ছেন। ছয় মেয়ের পরে এক ছেলে, এ কি কম আদরের!
কাদির খান ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব মেধাবী, সব পরীক্ষায় প্রথম। কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম বি বি এস পাশ করে চলে গেল ইউরোপ। ওখানে নাকি সর্বাধুনিক জ্ঞানের চর্চা হয়। সকল জ্ঞানের জননী হল ইউরোপ। শাওকাত খান অবিশ্যি রাজি ছিলেন না। ইউরোপের অবস্থা তখন নাজু্‌ক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তি ইউরোপ দুলছে অনিশ্চয়তার ওপর।
মেধাবী ছেলের একগাদা যুক্তির কাছে হার মেনেছিলেন শাওকাত খান।
খাওয়া শেষে গোলেজান বেওয়া গরম দুধের বাটি এগিয়ে দিলেন, কাদের খানকে খুব নিচু স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, উনি দুধ খান তো?
কাদির খান মুচকি হাসলেন মনে মনে বললেন, দুধ ত উনি খান ই তবে বাটিতে নয় গ্লাসে। কাদির গ্লাস দিতে বললেন না। ওকে স্থানীয় কায়দা কানুন রপ্ত করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি হয় ততই ভালো। ওকে নিয়ে উদ্ভট বাড়তি কৌতুহল যেন না হয় সেজন্যে কাদির কিছু গল্প বানিয়ে রেখেছেন। সময়মত প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাটিতে দুধ খেতে অনভ্যস্ত লোকটা দাঁড়ি গোঁফে মাখিয়ে ফেললেন, কাদির সামলে নিল ও কিছু না দুই চারদিনেই ঠিক হয়ে যাবে।
লোকটা দুধের বাটিতে চুমুক দিয়ে আশ্চর্য্য হয়ে গেলেন। এমন স্বাদের দুধ তিনি কখনও খাননি। দুধে কি সুগার দেওয়া হয়েছে? না! সুগার দিলে দুধ পাতলা হয়ে যায়। এই দুধ অতিশয় ঘন। এটা কি প্রকৃতি, পরিবেশ ভেদে ভিন্ন হয়? এইসব তুচ্ছ বিষয় ভাবা তার কাজ না। অথচ ভাবতে হচ্ছে। তার হাতে অফুরন্ত সময়। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সে ভাবতেই পারে, সময় কাটবে ভালো, অতীতের কথাও মনে পড়বে না।

চলবে
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ রাত ৮:১৪
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অপরাধের সেকাল ও একাল

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:১০

সেকাল
--------------------------------------------------------
স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা হেনরি বেভারিজ ছিলেন বৃটিশ-ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের একজন সদস্য৷বেভারিজ ১৮৭০ সালের মার্চ হতে ১৮৭১ সালের মার্চ এবং ১৮৭১ সালের জুন থেকে ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তির কোরাস দল

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৫



ঘুমিয়ে যেও না !
দরজা বন্ধ করো না -
বিশ্বাস রাখো বিপ্লবীরা ফিরে আসবেই
বন্যা ঝড় তুফান , বজ্র কণ্ঠে কোরাস করে
একদিন তারা ঠিক ফিরবে তোমার শহরে।
-
হয়তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাইডেন ইহুদী চক্তান্ত থেকে বের হয়েছে, মনে হয়!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮



নেতানিয়াহু ও তার ওয়ার-ক্যাবিনেট বাইডেনকে ইরান আক্রমণের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো; বাইডেন সেই চক্রান্ত থেকে বের হয়েছে; ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী, কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধিমান। নেতানিয়াহু রাফাতে বোমা ফেলাতে, আজকে সকাল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫

আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব কবি

লিখেছেন সাইদুর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৭

বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।

কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।

সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।

যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×