somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উত্তর পত্র

১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ দুপুর ১২:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সুদীর্ঘ চব্বিশ বছর পর ফ্লাইওভারের নিচে স্যার-কে দেখে চমকে-থমকে গেলাম।
আমি তখন নিউ টেন এর ছাত্র। প্রথম সাময়িক এর শেষ পরীক্ষার শেষের ঘন্টা চলছে। দ্রুত লিখে যাচ্ছি। এর মাঝে পিছনে পায়ের আওয়াজ। কাধে হাত পড়লো কারও। ঘাড় ঘুড়িয়ে অবাক হলাম আমিন স্যারকে দেখে। স্যার সাধারনরতঃ ইনভিজিলেটর এর দায়িত্ব পালন করেন না। ‘পরীক্ষা শেষে আমার সাথে দেখা করে যাবি’ বলে হল ছেড়ে স্যার চলে গেলেন। কি হলো, কে জানে। যাক্, পরীক্ষা শেষে টিচার্স রুমের দিকে যাচ্ছি। আশে-পাশে বন্ধুদের নানারকম মন্তব্য আর তাড়াতাড়ি ফেরার তাগিদ। একেবারে টিচার্স রুমের দরজাতেই স্যার দাড়ানো। কাছে যাওয়া মাত্র স্যারের প্রশ্ন ‘অপর্না’ কে ? বিশেষ ভদ্র এবং মোটামুটি মেধাবী হিসেবে স্কুলে আমার বেশ সুনাম ছিল। বাড়ী থেকে ৫/৭ মিনিটের দুরত্বে একই স্কুলে পাঁচ ভাই-বোন পড়তাম। সে কারনেও সব স্যাররা সুনজরে দেখতেন। স্যারের এ ব্যতিক্রমী প্রশ্ন শুনে আমি স্তম্ভিত ও নির্বাক ! একটি মেয়ে এবং মেয়েটি কে তার সম্পর্কে স্যার আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন !? মুহুর্তের ভাবনা শেষে অপ্রস্তুত আর থতমত খেয়ে উত্তর দিলাম, ‘চিনিনা স্যার’। ভীষন রেগে একটি চিঠি দেখিয়ে চাপা কন্ঠে স্যার বললেন, ‘চিনিসনা তো তোর নামে এটা এলো কোত্থেকে’ ? অবাক বিস্ময়ে স্যারের দিকে চেয়ে দাড়িয়ে রইলাম। কিন্তু ভীতরে ভীতরে দ্রুত খুজে যাচ্ছি আমার অতীতের যাবতীয় রেকর্ড পত্র। স্মৃতি থেকে কোন তথ্য মনে আসছেনা, মনে পড়ার কথাও নয়। স্যার বলে চলেছেন, ‘তোর গার্ডিয়ানের কাছে সব বলবো, এ বয়সেই প্রেম-ভালোবাসার পত্র !। আজই আমি তোদের বাসায় যাব’।
একেতো অল্প খানিক আগে একাধারে একবসায় তিন ঘন্টা লেখার ধকল এর ওপর স্যারের এসব মন্তব্যে আমার মাথা-শরীর থেকে গরম বের হচ্ছিল। হতাশ হয়ে যখন হাল ছেড়ে দিব, এমনি সময় মনের কোনে আবছা উঁকি দিল আমাদের ভাড়া বাড়ীতে থাকা বোনের কাছে বেড়াতে আসা অপর্না’র কথা। ভীষন অবাক হলাম ! তিনিতো আমার এক ক্লাস সিনিয়র। আমি আর আমার বড় ভাই আলাদা এক রুমে থাকতাম। সেও হয়তোবা দু’চার দিন হবে ; মাঝে মধ্যে রুমে এসে জিজ্ঞেস করতেন, কেমন আছি; লেখাপড়া কেমন চলছে, হাতের লেখাও এত সুন্দর হয় ইত্যাদি। ‘অপর্না’ কে আবিস্কারে যেন সম্বিত ফিরে এলা। ‘চিনেছি স্যার, এবার চিনেছি’ বলতেই স্যার যেন সবজান্তার ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। তবে আমিও স্বাভাবিক ভাবে স্যারকে ঘটনাগুলো খুলে বললাম। নিজেকে নির্দোষ প্রমানের প্রানপন চেস্টার মাঝেই স্যারের প্রশ্ন, ‘বুঝলাম কিন্তু তোর স্কুলে ঠিকানা পেল কোথায়’ ? ভেবে অবাক হই, উত্তটার যেন আগে থেকেই রেডী করা ছিল, বললাম, ‘স্যার হয়তো আমার স্কুলের খাতা থেকে পেয়েছে, আমরা হয়তো তখন রুমে ছিলাম না’। আমার জবাবে খানিকটা আশ্চর্য হয়ে হু-হা করে স্যার কিছুটা রনে ভঙ্গ দিলেন। আর আমিও আটকে রাখা শ্বাস ছেড়ে পৃথিবীর সব বাতাস ফুসফুসে ভরতে লাগলাম। হ্যাঁ, আমার বলা সত্যটাকে স্যার বিশ্বাস করলেন। বেশ খানিক পর বললেন, ‘খবরদার, ভবিষ্যতে এরকম ঘটলে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে, এবার যা’। মাথা নেড়ে, সম্মতি জানিয়ে স্যারের সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচলাম। ছোট্ট বারান্দা পেরিয়ে স্কুলের গেট, এখন এ পথ টুকুও যেন দীর্ঘ মনে হচ্ছে, চারদিকে তাকাচ্ছি। ভাবছি আমার প্রতি স্যারের সন্দেহ হয়তো মোচন হবেনা।
দু’চার পা গেটের দিকে এগিয়ে হঠাৎ নিজের কাছে সবকিছু কেমন যেন শুন্য শুন্য মনে হতে লাগলো। স্যারের হাতে অপর্না’র লেখা হলুদ খামে মোড়া চিঠিটা একনজর দেখেছি, ছেড়া হয়েচে। আমাকে লেখা চিঠি, স্যার পড়েছেন ; আমাকে লেখা একটি মেয়ের চিঠি ! সে বয়সের জীবনে প্রথম পাওয়া কোন মেয়ের চিঠি ! আর আমি সে-টি রেখে চলে যাচ্ছি! চিঠিটার প্রতি কি এক নেশার ঘোর যেন আমাকে পেয়ে বসলো। পিছু ফিরলাম। স্যার তখনও দরজায় দাড়িয়ে। কাছে যেতেই ‘কি তুমি কি কিছু বলবে’ ( তুই থেকে তুমি বললেন ! ) সেদিন এতটা সাহস কোথায় পেয়েছিলাম জানিনা, বললাম, ‘স্যার চিঠিটা দিয়ে দিন না, প্লিজ স্যার, আর কখনও এমন হবেনা। কিছুক্ষন আমার দিকে চেয়ে থেকে মৃদু একট কানমলা দিয়ে স্যার বললেন, ‘ঠিক আছে, চিঠি দিয়ে দিলাম, তবে লেখাপড়াটা আগে ঠিকমত করো’। মুখে কিছু না বলে, দু’হাতে স্যারের পা ছুঁয়ে, কোন রকমে ভেজা চোখ লুকিয়ে সামনে থেকে সরে আসলাম।
আমার গভীর ভাবনার জাল ছিন্ন করে স্যার ডাকলেন এই যে, ‘তুমি আলম না’ ? ‘জ্বি স্যার’ বলতেই তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
পারস্পরিক কুশল বিনিময়ের পর জানলাম, স্যার আট বছর আগে রিটায়ার্ড করার পর এখন গ্রামের বাড়ীতেই থাকেন। ঢাকায় এসেছেন মেয়ের বাসায় বেড়াতে। সারের স্বাস্থ্য যেন আগের মতই রয়ে গেছে। আমি কোথায় থাকি, কি করি, বিয়ে – সংসার ইত্যাদি সব খবর জানলেন। কথার ফাকে ফাকে মনে হচ্ছিল, স্যারের চোখ দু’টোয় কি যেন এক জিজ্ঞাসা আর দুষ্টুমির হাসি। তাঁর কি সে চিঠির কথা মনে আছে ! আমি অবশ্য স্ত্রী-সন্তানদের কথা বলে আকার-ইঙ্গিতে স্যারকে বোঝালাম, ফরিদপুর থেকে পাঠানো চিঠির সে ঘটনার ইতি ওখানেই ঘটেছিল। ঠিকানা, ফোন নম্বর বিনিময়ের পর আমার বাসায় বেড়ানোর অনুরোধ স্যার শুনলেন না। রাতের ট্রেনে তার বাড়ী ফেরার কথা। দৃষ্টির আড়াল না হওয়া পর্যন্ত ঠায় দাড়িয়ে থেকে স্যারের চলে যাওয়া দেখলাম।
ফুটপাত ধরে হাটছি আর ভাবছি, পলাতকা অতীত! মানুষের মনের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকে। আর কারনে অকারনে, কখনও বা বর্তমানের সাথে সংঘর্ষে সে মানুষকে ক্ষনিক স্মৃতির পঙ্কে ডুবিয়ে দিয়ে তার নিরবিচ্ছিন্ন এ জীবটাকে টাল-মাটাল করে দেয়। অতীত মনে এলেই না পাওয়ার কোন্ এক শূন্যতাকে ঘিরে ক্ষোভে মন যেন ফুঁসতে থাকে আর বর্তমানের সাথে তার তুলনা! এমন না হয়ে অমন হলে কেমন হতো (?) জীবন হয়তো আরও উপভোগ্য (!) হতো। সুন্দর বর্তমানও যেন অতীতের কোন একটি ঘটনার কাছেও কখনও কখনও অর্থহীন হয়ে যায়। জীবনের জন্য এ যেন এক চরম সত্য উপাখ্যান !
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ দুপুর ১২:৪৮
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×