somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নারায়ণগঞ্জ : ব্রিটিশ লেখিকা রুমার ও জন গডেনের স্মৃতির শহর

০৭ ই আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ১:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তারা দুই বোনই কথাসাহিত্যিক— বড় বোন উইনসাম রুথ কে গডেন (১৯০৬-১৯৮৪) আর ছোট বোন মার্গারেট রুমার গডেন (১০ ডিসেম্বর ১৯০৭-৮ নভেম্বর ১৯৯৮)। উইনসাম গডেনই জন গডেন নামে লিখেছেন। পিতার চাকরিসূত্রে ব্রিটেনের নাগরিক এ দুই বোনের শৈশব কেটেছে তত্কালীন পূর্ববঙ্গে, আজকের বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মা-বাবা তাদের ইংল্যান্ড থেকে নারায়ণগঞ্জে নিজেদের কাছে নিয়ে আসেন। জন ও রুমার গডনের বয়স তখন যথাক্রমে ছয় ও সাত বছর। তাদের পিতা আর্থার লেই গডেন তখন ব্রিটিশ স্টিমার কোম্পানির (ব্রহ্মপুত্র স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি) এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। এরপর শুরু হলো জন ও রুমার গডনের ভারতীয় জীবন। তারা বাস করেছেন তত্কালীন পূর্ববঙ্গের নারায়ণগঞ্জে, ঘুরেছেন দার্জিলিং, কাশ্মীর প্রভৃতি স্থান। একবার হুগলি থেকে নদীপথে সফর করেছেন সুন্দরবন। দুই বোন তত্কালীন ভারতবর্ষে কাটানো শৈশব নিয়ে যৌথভাবে স্মৃতিকথা লিখেছিলেন, যা টু আন্ডার দি ইন্ডিয়ান সান নামে ১৯৬৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। তত্কালীন পূর্ববঙ্গের নারায়ণগঞ্জের জীবন তাদের এ স্মৃতিকথায় অনেকটা জায়গা নিয়ে আছে। কারণ পরিবারের সঙ্গে এ শহরেই তারা বসবাস করেছেন। স্মৃতিকথামূলক এ গ্রন্থে তত্কালীন পূর্ববঙ্গের সামাজিক জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের প্রাণবন্ত বিবরণ রয়েছে। নারায়ণগঞ্জের জীবনযাত্রা, বাংলার মানুষের আচার-প্রথা, ধর্মীয় বিশ্বাস, উত্সব, প্রকৃতির অনুসন্ধিত্সু বিবরণ পাওয়া যায় দুই বোনের স্মৃতিকথায়। গডেনদের নারায়ণগঞ্জের বাড়ির খাবার টেবিলের ভৃত্য ছিলেন মুসলিম, অন্য কাজের জন্য আরো ছিলেন বেশ ক’জন চাকর। আয়া ছিলেন মাদ্রাজের খ্রিস্টান, বাগানের মালি ছিলেন ব্রাহ্মণ আর মেথররা ছিলেন অস্পৃশ্য। ১৯১৯ সালে দুই বোন ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়েছিলেন।
রুমার গডেনের প্রকাশিত ৭০টি বইয়ের মধ্যে ২১টি ছিল উপন্যাস। তার উপন্যাসের অনেকগুলোই ছিল বেস্টসেলার এবং সেগুলো অবলম্বনে সিনেমাও নির্মাণ হয়েছে। তার বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— ব্ল্যাক নার্সিসাস (১৯৩৮), দ্য রিভার (১৯৪৬), দ্য গ্রিনগেজ সামার (১৯৫৮) প্রভৃতি। বিখ্যাত ফরাসি পরিচালক জ্যা রেঁনোয়া রুমারের দ্য রিভার উপন্যাসটি অবলম্বনে সিনেমা নির্মাণ করেছেন। এ সময় রুমার এ পরিচালকের সঙ্গে দুই বছর কাজ করেছেন। জন গডেনের প্রথম উপন্যাস দ্য বার্ড এসকেপড প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে আছে— দ্য হাউজ বাই দ্য সি, শিবা’স পিজিয়ন, আহমেদ অ্যান্ড দ্য ওল্ড লেডি প্রভৃতি।
জন ও রুমার গডেনের স্মৃতিকথা টু আন্ডার দি ইন্ডিয়ান সান থেকে নির্বাচিত অংশ এখান অনূদিত হলো—
নারায়ণগঞ্জ
নারায়ণগঞ্জে আমাদের বাড়ির পেছনে তিন ধরনের শব্দ সবসময় শোনা যেত: রাস্তার অপর পাশে থাকা পাটের কারখানা থেকে বের হওয়া বাষ্প— এ বাষ্প যেন আমাদের দিন-রাতের স্পন্দন; তারপর ছিল সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বাগানে কাকের কা কা; প্রতিদিন ও বেশির ভাগ রাতে বাজার থেকে আসা গমগমে শব্দ: চড়ুইয়ের মতো মানুষের বকবক করার গুঞ্জন, দোকানিদের হাঁকডাক, নারীদের বিলাপ, শিশুদের কান্না। মাঝে মধ্যে হালকা স্বরে ঢোলের শব্দ পাওয়া যেত, এর মানে রাস্তা দিয়ে বানরওয়ালা যাচ্ছে; খেলা দেখানোর জন্য তার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুটো বানর ছিল, বানর দুটোর একটা পুরুষ, আরেকটা নারীদের মতো পোশাক পরানো ছিল। চাকররা তাদের ঘিরে থাকত এবং সেখানে কী দেখে তারা হাসছে, সেটা আমাদের দেখতে দিত না। আরো কিছু অবিরাম শব্দ ভেসে আসত— ঠেলাগাড়ি চলার শব্দ, ছাপাখানার শব্দ, ঠেলাগাড়ি বা ভারী মালপত্র ঠেলার সময় কুলিদের ‘হেঁইয়ো! হেঁইয়ো!’ ধ্বনি, কামারশালা থেকে আসা হাপর ও লোহা পেটানোর শব্দ। নদীর শব্দও আসত— লঞ্চের বাঁশি, আরেক ধরনের শব্দ জানান দিত স্টিমারের। মাঝে মধ্যে এসব নিয়মিত শব্দে ব্যাঘাত ঘটত, আর সেটা ছিল আমাদের বাড়ির বিরাট সবুজ গেটটা খোলার শব্দ। এটা সবসময়ই একটা উত্তেজনাকর শব্দ, যা নতুন কারো আগমনের বার্তা ঘোষণা করে। গেটের শব্দ এখনো তেমনই আছে, ডিসেম্বরের এক সুবাসিত দিনে গেটটা আমাদের জন্য প্রথমবারের মতো খুলেছিল, জন ও রুমারের জন্য।
আমরা যখন লন্ডনে রওনা হয়েছিলাম, বাবা তখন আসামেই ছিলেন। কিন্তু এবার আমরা বাংলায় চলে এসেছি, এই নারায়ণগঞ্জ শহরে। তাই আশপাশের সবই ছিল নতুন, শুধু নদী ছাড়াআমাদের শিশুবেলার পুরোটাই কেটেছে ভারতীয় নদীর তীরে। সবসময় জোয়ার ও আবহাওয়ার সতর্কতা বার্তা শুনেছি, আর চোখে দেখেছি স্টিমার, লঞ্চ, মোটরচালিত নৌকাসহ বিভিন্ন ধরনের নৌকা। নারায়ণগঞ্জের নদীর নাম ছিল লক্ষ্যা, এটা ব্রহ্মপুত্রের বিস্তৃত নেটওয়ার্কের একটি অংশ। লক্ষ্যা নদী বেয়ে একবারে শহরে আসা যেত। রেলের একটি শাখা চলে গিয়েছিল ১১ মাইল দূরত্বে ঢাকায়। ঢাকায় যাওয়ার জন্য পাট ও ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে চলে যাওয়া সড়কপথও ছিল, কিন্তু এগুলো সবই ছিল পার্শ্বপথ; মূল যাতায়াত হতো নদীপথে। মা ও বাবা কলকাতায় এসেছিলেন আমাদের সঙ্গে একত্রিত হতে। আমরা ছিলাম জন, রুমার ও ম্যারি চাচি। শুরুতে মেইল স্টিমারে যাত্রা, রাত ৪টায় আমরা দেখা পেলাম নাইট এক্সপ্রেসের, জায়গাটা ছিল গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্রের মিলনস্থল। এর পর শত মাইল পাড়ি দিয়ে এই ব্রহ্মপুত্র বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। এসব নদীর তুলনায় ইউরোপীয় দেশের নদীগুলো নিতান্তই বামনাকার। এখানকার নদীগুলো কোথাও কোথাও প্রস্থে কয়েক মাইল, নদীর পাড় কাদা আর বালিতে পূর্ণ। নদীর তীর থেকে আকাশের তলে ছড়িয়ে থাকে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ।
স্টিমারে করে যেদিন আমরা নারায়ণগঞ্জে এসেছিলাম, সেদিন দুই বোনই বুঝেছিলাম— র্যান্ডলফ গার্ডেনের জীবনটা ছিল একটা বিরতি, পরবর্তীতে স্কুলজীবনটাও তা-ই হতে যাচ্ছে। এই নদীমাতৃক দেশই হচ্ছে আমাদের সত্যিকার ঠিকানা।
ঘরাবাড়ি ও গৃহস্থালি
‘ওটা কিসের পতাকা?’
অবশ্যই কোম্পানির পতাকা, একই রকমের পতাকা কোম্পানির স্টিমার, লঞ্চগুলোর পেছনেও উড়তে দেখা যায়। তবে আমাদের জন্য এটা ছিল বাবার পতাকা, আর স্টিমারগুলো ছিল বাবার স্টিমার। ভোরে আমাদের বাড়ির কোণে এ পতাকা উত্তোলন করা হতো। আবার সূর্যাস্তের সময় নামিয়ে ফেলা হতো। আমাদের বাড়ি ছাড়া জীবনে আমরা আরেকটা ব্যক্তিগত বাড়ি দেখেছিলাম, যাদের নিজস্ব পতাকা আছে, সেটা ছিল বাকিংহাম প্রাসাদ।

যে ভারতীয়দের আমরা সবচেয়ে ভালোভাবে চিনতাম, তারা হলো আমাদের চাকর। আমাদের অনভ্যস্ত চোখে শুরুতে তাদের সবার চেহারা একই রকম লাগত, কিন্তু তারা একে অন্যের চেয়ে যথেষ্ট ভিন্ন ছিল। তাদের মধ্যে স্থান, রীতি-নীতি, ধর্ম এমনকি গায়ের রঙের পার্থক্য ছিল। আমাদের একমাত্র ইংরেজ কর্মচারী ছিল মিস অ্যান্ড্রু। নানা ছিল একজন ইউরেশীয়, সে ছিল এক দুর্ভাগা হাউব্রিড, যাকে ইউরোপীয়দের চেয়ে ভারতীয়রা বেশি অবজ্ঞা করত। হান্নাহ ছিল আয়া। সে ছিল মধ্যবয়সী, মর্যাদাবান এবং নানার চেয়ে অনেক বেশি ধীরস্থির। হান্নাহ এসেছে দক্ষিণ ভারত থেকে, মাদ্রাজের নারকেল গাছে ছাওয়া এক গ্রামে তার বাড়ি। আর কোনো চাকর হান্নাহর মাতৃভাষা তামিলের এক বর্ণও বুঝত না। তাতে অবশ্য সমস্যা হতো না, কারণ হান্নাহ সুরেলা স্বরে সবসময় ইংরেজিতে কথা বলত। হান্নাহ ছিল খ্রিস্টান, রোমান ক্যাথলিক থমিস্ট, খুব সম্ভবত খ্রিস্টানদের প্রাচীনতম শাখা। হান্নাহ প্রতি রোববার ভোর ৫টায় উঠে ট্রেনে করে ঢাকায় অবস্থিত রোমান ক্যাথলিক চার্চে যেত। ঢাকায় রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও সেন্ট জোসেফের কনভেন্ট ছিল। আমাদের সবচেয়ে কাছের চার্চ অব ইংল্যান্ড ছিল ঢাকায়। আমাদের একটা ঘোড়ায় টানা ক্যারিজ থাকা সত্ত্বেও দূরত্বটা অনেক বেশি মনে হতো। মেথর নিতাই ছিল হিন্দু। তার মর্যাদা এতটাই নিচে যে, তাকে দূরে রাখা হতো। আর ব্রাহ্মণ মালির স্থান এত উপরে যে, আমরা তার সঙ্গে মিশতে পারতাম না। ব্রাহ্মণরা হিন্দুদের সর্বোচ্চ মর্যাদাপ্রাপ্ত বর্ণ। তারা তিনটা পূত সুতা পরিধান করত— একটি ব্রহ্মা, একটি বিষ্ণু ও একটি শিবের জন্য। এমনকি আমাদের ছায়াও যদি মালির খাবারে পড়ত, তাহলেও তা অপবিত্র হয়ে যেত এবং সে আর তা খেতে পারত না। এ ব্রাহ্মণ শুধু সবজি, ভাত আর ডাল খেত। এমনকি ডিমও খেত না। আমাদের প্রধান মালি গোবিন্দ ছিল বেশ ধার্মিক। তার ঘরের সামনে একটা ছোট পবিত্র তুলসী গাছ ছিল। গোবিন্দ মাঝে মাঝে একাকী বসে ধ্যান করত, তখন তার সঙ্গে কথা বললেও সে শুনতে পেত না। বাবার ব্যক্তিগত ভৃত্য ছিল জেট্টা, সে আমাদের অন্য সব চাকরের তুলনায় হাসিখুশি ছিল; তার মধ্যে কোনো ট্যাবু ছিল না। সে ছিল সিকিম থেকে আসা লেপচা। সিকিম ছিল তিব্বত সীমান্তে একটি ছোট স্বাধীন দেশ। জেট্টা ছিল বৌদ্ধ। আমাদের কয়েকজন মুসলিম চাকরও ছিল। আমাদের টেবিল সারভেন্ট ও মশালচি ছিল মুসলিম। তরুণ খেদমতগার— ওয়েটার মুস্তাফা ছিল আমাদের বন্ধু। কালো কোঁকড়ানো দাড়ি আর ঢলো ঢলো চোখের মুস্তাফা ছিল দারুণ হ্যান্ডসাম। নার্সারি বিয়ারার আবদুল ছিল আমাদের শত্রু। সত্যি বলতে, কেউই তাকে পছন্দ করত না। মুস্তাফা ছিল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ চাকর আর আবদুল ছিল একটা আপদ, তার ভাব ছিল সবজান্তা এবং সারাক্ষণই নানা ধরনের সমস্যা তৈরি করত। তার চেহারা কুতসিত ছিল এবং তার মনটাও তা-ই। সে চুরি করত এবং মিথ্যা বলত। খানসামা আজাদ আলীকে টি-পট বহন আর পাত্রে পানীয় ঢালা ব্যতীত আর কোনো কাজ করতে কেউ দেখেনি।
গোবিন্দের মতো আজাদ আলী ছিল কঠোর ধার্মিক এবং মুস্তাফা সবকিছুতেই আজাদকে অনুকরণ করত। তাই সেও ধার্মিক ছিল। তাদের দুজনের কব্জিতে কোরানের আয়াত সিল্কের কাপড়ে বাঁধা থাকত। ফারসি লিপিতে লেখা এ আয়াত থাকত একটি ছোট্ট ধাতব বক্সের (তাবিজ) মধ্যে। আমরা জানতাম যে, এটা কোনোভাবেই আমাদের স্পর্শ করা উচিত নয়। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’— আজাদ আলী, মুস্তাফা এবং মাঝে মাঝে আবদুলও সুর করে আবৃত্তি করত। জেট্টাকে আমরা কখনো প্রার্থনা করতে দেখিনি। দূরে সেই পর্বতের দেশে ঘূর্ণায়মান চাকা আর বাতাসে ওড়া পতাকাগুলো তার হয়ে বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা জানায়। ‘রাম, রাম, রাম, রাম’— গোবিন্দ বারবার আওড়াতে থাকে। ‘গড দ্য ফাদার, গড দ্য সন অ্যান্ড গড দ্য হোলি গোস্ট’— রান্না করতে করতে হান্নাহ আওড়ায়।
পুরো পরিবারের একসঙ্গে প্রাতরাশ করাটা ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো সময়। বাগানে বা ডাইনিং রুমে বিরাট গোলটেবিল ঘিরে আমরা সবাই বসতাম। প্রতিদিন পরিষ্কার টেবিল ক্লথ থাকত— থাকবেইবা না কেন? আমাদের তো নিজেদের ধোপা ছিল। টেবিলের মাঝে তাজা ফুল থাকত; মা গোবিন্দকে দিয়ে এ ফুল আনিয়ে নিতেন। লন্ডনের বিস্বাদ ডিম আর ভয়াবহ পরিজের তুলনায় এখানকার খাবার ছিল খুব সুস্বাদু। নারায়ণগঞ্জে আমাদের সকালের নাশতা ছিল খিচুড়ি বা ভাত-ডাল ও ডিম পোচ। তবে সবচেয়ে সেরা ছিল ফল— পেঁপের রঙ ছিল সোনালি, ভেতরে কালো রঙের বিচি। এ কালো বিচিতেই নাকি সব ভিটামিন জমা থাকত কিন্তু আমরা কখনো এ বিচি খেতাম না। লিচু ও আম পাকত গরমের সময় কিন্তু সে সময় আমরা সাধারণত পাহাড়ে থাকতাম। তবে বাবা মাঝে মধ্যে আমাদের কাছে ঝুড়িভর্তি আম-লিচু পাঠিয়ে দিত।
বাজারগুলো বিকালে জমজমাট হয়ে উঠত। মানুষ, গলার স্বর, ঘ্রাণ মিলিয়ে বাজারগুলো প্রাণপূর্ণ হয়ে উঠত। সরু রাস্তা জনাকীর্ণ হয়ে পড়ত, আমাদের জন্য গুরুকে পথ পরিষ্কার করতে হতো। বাজার দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় অগণিত কল্পনা আমাদের মনে ডানা মেলত: আমরা যদি হিন্দু হতাম, তাহলে মন্দিরে যেতাম পূজা করতে, সেখানে দেবীর মূর্তির সামনে পুরোহিত প্রদীপ দোলান— তাহলে কেমন হতো? কুঁড়েঘরের সামনে বাবা আর ছেলে মাটিতে মাদুর বিছিয়ে ডান হাত ব্যবহার করে খান, পিতলের থালায় স্তূপ করে রাখা ভাত আর তরকারি, বেশির ভাগ সময় শুধু শাকপাতা— স্ত্রী আর মা চেয়ে চেয়ে একটু দূরে ঘোমটায় মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুরুষ সদস্যদের খাওয়া দেখছেন; এমন হলে কেমন হতো? স্ত্রী-কন্যাকে খাওয়ার জন্য তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যদের খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
আমাদের জন্য ঠাণ্ডা আবহাওয়া মানে বাংলার শীতকাল শুরু হয় হিন্দুদের আলোর উত্সব দীপাবলির মাধ্যমে। দুর্গাপূজার দীর্ঘ ছুটির পরই এটা আসে। এ উত্সব কালীর প্রতি উত্সর্গীকৃত। কালী সম্পর্কে আমরা খুব বেশি কিছু জানি না। বাংলায় কালীপূজা খুব জনপ্রিয়। তবে আমাদের খুব অবাক লাগে, মানুষ কী করে কালীর ভীষণ দর্শন রূপকে ভালোবাসে!
আমাদের বাসায় সবসময়ই দীপাবলির উত্সব হতো। সারা দিন আমরা গুরু, গোবিন্দ ও বাগানের অন্য কর্মচারীদের প্রদীপ তৈরি
এবং সেগুলো গেটের খিলান, ছাদের প্রাচীর, বারান্দার রেলিংয়ের ওপর সাজাতে সাহায্য করতাম। আবার নানা রকমের জ্বালাতন করে তাদের কাজে ব্যাঘাতও ঘটাতাম। মুসলিম চাকররাও এ উত্সবে শামিল হতো। কারণ এ উত্সবে সবাই অংশ নিত। বাবা বলেছিলেন, মোগল সম্রাট আকবরও নাকি এ উত্সবের রাতে তার প্রাসাদ প্রদীপ দিয়ে সজ্জিত করতেন। বাগানে গিয়ে আমরা আলোয় উদ্ভাসিত বাসার দিকে চেয়ে থাকতাম। নদীতে নৌকা এমনকি বাবার স্টিমারগুলোয় সোনা রঙের আলো আঁধারে জ্বলজ্বল করত। সন্ধ্যায় আমরা বাবাসহ পরিবারের সবাই ‘আলো’ দেখতে সোনাচরা যেতাম।
এপ্রিল, মে মাসে সূর্য দেবতা বেরিয়ে আসেন। প্রতিটা দিন আরো বেশি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ধানক্ষেত, পুকুর শুকিয়ে যায়। মাটি ফেটে চৌচির হয়। গাছ থেকে ফুল শুকিয়ে মাটিতে পড়ে।
আমরা দুই বোন— জন ও রুমার বাংলার পূর্ণাঙ্গ বছর দেখেছি কেবল একবার। বাংলায় প্রথম গরমের মৌসুমে বাবা আমাদের পাহাড়ে পাঠাতে পারেননি। কারণ আমাদের ইংল্যান্ড থেকে আনতে বাবার অনেক টাকা খরচ হয়েছিল, তাই সেবার আর পাহাড়ে গমন সম্ভব হয়নি। গরম সহ্য করা কাকে বলে, সেটা আমরা সেবার বুঝেছিলাম। চারদিকে ধুলা আর শুষ্কতা। শরীরের ত্বক শুকিয়ে গিয়েছিল। চোখের পাপড়ি এমনভাবে পড়ে যেত যে মনে হতো, সেগুলো কাগজের তৈরি। বারান্দায় যেখানে সূর্যের আলো পড়ত, সেখানকার পাথর এত উত্তপ্ত হয়ে উঠত যে, খালি পায়ে পা রাখা যেত না। খুব ভোর বা রাতেই কেবল ছাদে যাওয়া যেত।
নারায়ণগঞ্জের বড়দিন অন্য জায়গার মতো ছিল না। আমাদের পরিবারে ক্রিসমাসের কোনো কেনাকাটা ছিল না। কলকাতা থেকে ডাকযোগে ক্যাটালগ থেকে আমরা জিনিসপত্র কিনতাম। বড়দিনে আমাদের বাড়ি সাজানো হতো না। নারায়ণগঞ্জে কোনো ক্রিসমাস ট্রি ছিল না। একবার শুধু ক্লাব পার্টিতে একটা ক্রিসমাস ট্রি দেখেছিলাম। বাবার উদ্যোগে বড়দিনে আমরা হাঁস শিকারে যেতাম।

(লেখাটির পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ ৯ জুন ২০১৭ 'দৈনিক বণিক বার্তা'র বিশেষ সাময়িকী 'সিল্করুট'-এ প্রকাশিত হয়েছে)

সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ১:৫৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×