somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঙালির সাজপোশাক

১৪ ই আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ১:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৮৭৪ সালে রাজনারায়ণ বসু তার ‘সেকাল আর একাল’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন, ‘প্রত্যেক জাতিরই একটি নির্দিষ্ট পরিচ্ছদ আছে। সেইরূপ পরিচ্ছদ সেই জাতির সকল ব্যক্তিই পরিধান করিয়া থাকেন। কিন্তু আমাদিগের বাঙ্গালী জাতির একটি নির্দিষ্ট পরিচ্ছদ নাই। কোন মজলিসে যাউন, একশত প্রকার পরিচ্ছদ দেখিবেন, পরিচ্ছদের কিছুমাত্র সমানতা নাই। ইহাতে একবার বোধ হয়, আমাদের কিছুমাত্র জাতিত্ব নাই।’ বাঙালির পোশাক নিয়ে একই রকম কথা কয়েক বছর পরে বিলেত থেকে ফিরে লিখলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। ১৮৮৫ সালে তিনি লিখলেন, ‘বাঙ্গালির পোষাক অতি আদিম ও আদমিক। বাঙ্গালীর কোন পোষাক নাই বলিলেও চলে। যদি জাতি, গুটিকতক সভ্য শিক্ষিত যুবকে না হয়, যদি জাতির আচার ব্যবহার ভদ্রতা শিক্ষা কেবল জগতের পঞ্চমাংশের স্বীকৃত না হয়, যদি অশিক্ষিত লক্ষ লক্ষ কৃষক ও ব্যবসায়ী জাতির মূল হয়; তাহা হইলে দুঃখের সহিত বলিতে হইবে, বাঙ্গালীর কোনই পোষাক নাই।’ কথাগুলো শুনতে খারাপ লাগলেও খুব যে মিথ্যা নয়, সেটা অস্বীকারের উপায় নেই। বাঙালির পোশাকের এই দৈন্য প্রধানত পুরুষের পোশাকের ক্ষেত্রে। নারীর ক্ষেত্রে পোশাক হিসেবে ইতিহাসে শাড়ির ধারাবাহিকতা দেখা যায় এবং শাড়ি আজো জৌলুস নিয়েই দুনিয়াতে টিকে আছে। শাড়িই বোধহয় বাঙালির একমাত্র পোশাক যা ভারত এবং দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে নারীরা বেশ আগ্রহ নিয়ে পরে। আজকের দিনে বলিউডের নায়িকারাও শাড়ি পরে ধন্য হয়ে যান। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা প্রবন্ধ ‘কোট বা চাপকান’-এ শাড়ির মাহাত্ম্য টের পাওয়া যায়, ‘আমাদের মধ্যে যাহারা বিলাতি পোশাক পরেন, স্ত্রীগণকে তাঁহারা শাড়ি পরাইয়া বাহির করিতে কুণ্ঠিত হন না। একাসনে গাড়ির দক্ষিণভাগে হ্যাট কোট, বামভাগে বোম্বাই শাড়ি।
শাড়ি দিয়েই বাঙালির পোশাকের গল্পটা শুরু করা যাক। শাড়ি শব্দটির উত্স ‘শাট’ বা ‘শাটক’ শব্দজাত ‘শাটিকা’। শাটক শব্দের অর্থ সরু দৈর্ঘ্যের জোড়া দেয়া কাপড়। আচার্য সুকুমার সেনের মতে, বাংলায় তাঁতযন্ত্রের আবির্ভাবের আগে শটক বা জোড়া দেয়া কাপড় ব্যবহারের প্রচলন ছিল। এবং এই শটক নারী-পুরুষ নির্বিশেষ সবাই ব্যবহার করতেন। মলয় রায় তার ‘বাঙালির বেশবাস’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সুকুমার সেনের বক্তব্য অনুসরণ করে আমাদের এই সিদ্ধান্তে আসতে হয়, ধুতি ও শাড়ির মধ্যে কোনো গুরুতর লিঙ্গভেদ সে-কালে মানা হত না।’ ধুতি এবং শাড়ির সমার্থক হওয়ার বিষয়টি কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের কাব্যে পাওয়া যায়। তিনি তাঁর কাব্যে সুরঙ্গ পাটের শাড়ি, তসরের শাড়ি, মেঘডম্বুর শাড়ি, ক্ষীরোদক শাড়ি, খুঞার ধুতি, খুঞার শাড়ি ও বিয়ে উপলক্ষে ব্যবহার্য মন্ত্রপূত হরিদ্রাযুত ধুতির উল্লেখ ছাড়াও বলেছেন- ‘তন্তুবায়ভুনি ধুতি খাদি বুনে গড়া’। ‘গড়া’ সর্বদা ব্যবহার্য মোটা কাপড় ও ‘খাদি’ খদ্দরের কাপড়। এসব বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, নারীর বস্ত্র হিসেবে ‘শাড়ি’ নামটি কালের বিবর্তনে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, যদিও ধুতি নামটি তখনো একেবারে হারিয়ে যায়নি। পনেরো-ষোল শতকে বাংলার নারীরা শুধু একখণ্ড শাড়ি গায়ে জড়াতেন। তখনো শাড়ি ব্যতীত নারীর ঊর্ধ্বাঙ্গে কোনো বস্ত্রের প্রচলন হয়নি।
বাংলায় শাড়ির ব্যবহার সেই প্রাচীনকাল থেকেই, বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের শাড়ির প্রচলন ছিল। প্রথমবার মা হওয়া উপলক্ষে নারীরা যে শাড়ি পরিবার থেকে উপহার পেতেন, তার নাম ছিল ‘অধ্যয়া’। এ শাড়ি হতো লাল রঙের। আবার ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নারীরা পরতেন নীল শাড়ি, যার নাম ছিল ‘ব্রশতী’।
মধ্যযুগের সাহিত্য আমাদের শাড়ির দৈর্ঘ্যের পরিমাপ জানিয়ে দেয়, অর্থাত্ মধ্যযুগেই শাড়ির দৈর্ঘ্য ১২ হাত হয়ে গিয়েছিল। কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘দোছটী করিয়া পরে বার হাত শাড়ি’— এ কথায় মহিলাদের বস্ত্রের দৈর্ঘ্য বোঝা যায়। সাহিত্যে আছে রাজকন্যার যৌতুকের সময়ে ‘কেহ নেত কেহ শ্বেত পাটশাড়ী’ দিতেছে। মনসামঙ্গল বা পদ্মপুরাণের অন্যতম কবি বিজয়গুপ্ত মনসার গোয়ালিনী রূপের সজ্জার যে বিবরণ দিয়েছেন, সেখানেও শাড়ির উল্লেখ পাওয়া যায় :

“সাজিয়া গোয়ালিনী বেশে...
বন্ধে ছন্দে বাঁধি খোঁপা পৃষ্ঠেতে পাটের থোপা
শ্রবণে সোনার মদনকড়ি।
স্বর্ণ অলঙ্কার গায় চলন্ত নূপুর পায়
উল্লাসে পরিল পাটির শাড়ী।।”

ষোড়শ শতাব্দীর কবি দ্বিজ বংশীবদনের মনসামঙ্গলে গঙ্গাজলি শাড়ি, নেতের উড়নী, পাটশাড়ি, ঘুঘরা, নীবিবন্ধ ইত্যাদির উল্লেখ আছে।
বাংলার মসলিন কিংবা অন্য সূক্ষ্ম কাপড় বহু আগে থেকেই দুনিয়ায় বিখ্যাত। এ অঞ্চলের নারীদের শাড়িও ছিল বেশ পাতলা, স্বচ্ছ। ‘সমাচার চন্দ্রিকা’র সম্পাদক ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘দূতীবিলাস’-এ লিখেছিলেন,

সুবর্ণের গোল মল পরিয়াছে পায়।
পরেছে ঢাকাই শাড়ী অঙ্গ দেখা যায়।।

পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে ব্রিটিশদের আগমনের মাধ্যমে। একদিকে নারীরা অন্তঃপুর থেকে বের হওয়া শুরু করেন, অন্যদিকে ব্রিটিশদের রীতি অনুসরণ করতে গিয়ে নারীদের ফিনফিনে পাতলা শাড়ির ব্যবহার হ্রাস পেতে থাকে। ১৮২২ সালের ফ্যানি পার্কস কলকাতা ভ্রমণ করে বাঙালি নারীদের পাতলা, স্বচ্ছ শাড়ির বিষয়টি পর্যবেক্ষণ এবং তার লেখায় উল্লেখ করেছেন। উনিশ শতকে শুরু হলো মেয়েদের পাতলা শাড়ি নিয়ে তুমুল সামাজিক তর্ক। জয়িতা দাস লিখেছেন, ‘‘বাড়ির বউ-ঝিরা দামী সূক্ষ্ম শাড়ি অলঙ্কার পরলে সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়ে। ‘বড় মানুষের’ এই দেখনদারি স্বভাব নিয়ে কাগজে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ শুরু হল। মেয়েরা তখন শাড়ি পরলেও শরীর দেখা যেত।’’ নীরদ সি চৌধুরী জানিয়েছেন, অনেকেই নাকি তখন নিতম্বে আলতা মাখতেন— এর আভা দেখে মনে হত পেটিকোট। কিন্তু এ আলতার ছদ্ম পেটিকোট পরে তো আর বাইরে বেরোনো চলে না। শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরা বিশেষ করে ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়েরা তখন অন্দরমহলের বাইরে পা রাখছেন। তাঁদের পোশাক বলতে মিহি শাড়ি। এই পোশাকে তাঁরা বাইরে বেরোন কী করে! অনেক পরিবারের কর্তা আবার রাজপুরুষের চাকরি নিয়ে সপরিবারে প্রবাসে যেতে শুরু করেছেন। কেউ হয়তো স্ত্রীকে নিয়ে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন, মেয়েদের রেলেও চাপতে হচ্ছে— মার্জিত পোশাক না পরলে যে আর মেয়েদের সম্মান থাকে না।” শাড়ির কাপড়ের ঘনত্ব নিয়ে এই টানাপড়েনের মাঝে চলে এল নতুন যুগ। বাংলার নারীদের পোশাকে পরিবর্তন এল। উনিশ শতকের সাতের দশক-পরবর্তী সময়ে লাগল পরিবর্তনের ছোঁয়া। নারীরা নিজেদের পশ্চিমা পোশাক, বিশেষত গাউনে সজ্জিত করলেন। কেউ গাউনের ওপর ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিলেন। বিশ শতকের প্রথমভাগে শাড়ির পরিশীলিত রূপ চালু হয়ে গেল। তবে তখনো পশ্চিমা পোশাকের অনুকরণ অব্যাহত ছিল।
বাংলায় মুসলমানদের আগমন এ অঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক— সব ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখেছিল। পোশাক-পরিচ্ছদেও এর প্রভাব পড়ে। চীনা কূটনীতিক ও ইউরোপীয় বণিকদের বিবরণে মুসলিম শাসনামলে বাংলার পোশাক সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মহুয়ান বাঙালিদের পোশাক সম্পর্কে লিখেছেন, ‘পুরুষরা তাদের মস্তক মুণ্ডন করেন এবং গোল গলাবন্ধবিশিষ্ট লম্বা ও ঢিলা পোশাক পরিধান করেন; মাথায় তারা সাদা পাগড়ি ব্যবহার করেন এবং কোমরে চওড়া রঙিন রুমাল বাঁধেন। তাঁরা সুচালো চামড়ার জুতা পরেন।’ এই পোশাক রীতি ছিল মুসলিম সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর, যাদের মধ্যে ছিলেন সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষিতরা। আর বাংলার সাধারণ মুসলমানের পোশাকের বর্ণনা পাওয়া যায় পর্তুগিজ বণিক বারবোসার বর্ণনায়। তিনি লিখেছেন, ‘সাধারণ অধিবাসীরা খাটো সাদা শার্ট পরিধান করে, এটি উরু পর্যন্ত প্রলম্বিত থাকে। তারা তিন কিংবা চার প্যাঁচবিশিষ্ট শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করে। তারা সবাই চামড়ার জুতা পরে এবং কেউ কেউ পরে রেশমি অথবা সোনালি সুতায় কাজ করা পাদুকা।’ মধ্যযুগে বাংলা মুসলমানদের পোশাকে গভীর ধর্মীয় প্রভাব দেখা যায়। কবি মুকুন্দরাম এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তারা (মুসলমানগণ) মাথায় কোন কেশ রাখে না, কিন্তু বুক পর্যন্ত দাড়ি রাখে। তারা সর্বদা তাদের নিজস্ব পথ অনুসরণ করে। মুসলমানরা মাথায় টুপি পরে। তাদের টুপির দশটি রেখা থাকে। তারা ইজার (পায়জামা) পরিধান করে এবং তাদের কোমরের সাথে শক্ত করে বাঁধা থাকে। কাউকে (মুসলিম) খালি মাথায় দেখলে তারা তার সঙ্গে কোন কথা বলে না; কিন্তু যাবার সময় তারা তার দিকে মাটির ঢেলা নিক্ষেপ করে।’ কবি দ্বিজ বংশীবদন লিখেছেন, ‘হাসানের সাতপুত্র পায়জামা, নিমা (শার্ট), টুপি ও কটিবন্ধে সজ্জিত হয়।’ ষষ্ঠীবর বলেন, ‘কাজী ইজার (পায়জামা), লম্বা কোর্তা ও টুপি পরেন।’ এই বাঙালি কবিদের বর্ণনার সঙ্গে পঞ্চদশ শতকের চৈনিক রাষ্ট্রদূত মহুয়ানের বর্ণনা মিলে যায়। মহুয়ান লিখেছেন, ‘লোকেরা (মুসলমান) তাদের মাথা মুণ্ডন করে এবং মাথায় সাদা সুতি পাগড়ি ব্যবহার করে। তারা বন্ধনীযুক্ত লম্বা ও ঢিলা পোশাক পরিধান করে এবং মাথায় শিরাবরণ ব্যবহার করে।’ ডক্টর এমএ রহিম লিখেছেন, ‘কবি বর্ণিত চিত্রে দেখা যায় যে, মুসলমানরা পয়গম্বর ও প্রথম যুগের মুসলমানদের অনুসরণ করে মাথা মুণ্ডন করত ও লম্বা দাড়ি রাখত এবং পায়জামা, টুপি ও লম্বা কোর্তা পরিধান করত।’ উল্লেখ্য, মাথার সাদা সুতি পাগড়ি দৈর্ঘ্যে ৪০ ফুট এবং প্রস্থে ৬ ইঞ্চি ছিল। মুসলমানরা হাতের আঙুলে মুক্তা বসানো আংটি ব্যবহার করতেন। টুপি না পরলে সেই মুসলমান সমাজে অপ্রিয় হতেন, এটা বিভিন্ন বর্ণনায় উঠে এসেছে।
ডক্টর এমএ রহিম লিখেছেন, ‘বাংলা সাহিত্যে দেখা যায় যে, স্ত্রীলোকেরা সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছদ ও মূল্যবান অলঙ্কারাদি খুব ভালোবাসত। তারা নানা প্রকার শাড়ি কিংবা ঘাঘরা এবং রেশমি জামা বা সুতি কাপড় পরিধান করত। সম্পদশালী ধনী পরিবারের মেয়েরা গলার হার, মুক্তা ও হীরার কর্ণকুণ্ডল ও অনন্ত, বালা বলয় ও মূল্যবান পাথর-বসানো সোনার আংটি ইত্যাদিতে সজ্জিত হতো। তারা কোমরে কিঙ্কিনী নামক আরো একটি অলঙ্কার পরত এবং পায়ে নূপুর বা পাঁইজর পরত।’
বাংলার মুসলিম পুরুষদের একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পোশাকের নাম লুঙ্গি। লুঙ্গির প্রতিশব্দ ‘তহমত’ বা ‘তহমান’, শব্দ দুটির মূল ফারসি থেকে আগত। ভারতে প্রাথমিককালে আসা আরব অধিবাসীরা কুর্তা, চোগা আর তহমত ব্যবহার করতেন। সে সময় লুঙ্গি ছিল সেলাইহীন। পরবর্তীকালে আব্বাসীয় দরবারের নীতি অনুসরণে ভারতীয় মুসলিমদের লুঙ্গিতে সেলাই পড়ে। আরো একটি অনুমান প্রচলিত আছে যে, মগ বা বর্মীদের অনুকরণে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে লুঙ্গির প্রচলন হয়।
বাংলার মুসলিমদের ঊর্ধ্বাঙ্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় পোশাকটি ছিল সম্ভবত কুর্তা। এটি মূলত কোমর পর্যন্ত দীর্ঘ একটি আঁটসাঁট জামা। কুর্তা একই সঙ্গে কোর্তা, কুর্তি নামের পরিচিত ছিল। কুর্তার হাতা লম্বা আর গলা গোলাকার। পলাশীর যুদ্ধকেন্দ্রিক রচিত ছড়ায় আছে ‘ছোট ছোট তেলেঙ্গাগুলি কালো কুর্ত্তি গায়।’ আবার তিতুমীরের বিদ্রোহ নিয়ে লেখা হয়েছে, ‘রাঙ্গা কুর্ত্তি গায়, বেতের টোপ মাথায়, এসেছে রাঙ্গা গোড়া পালাব কোথায়।’ চোগা হচ্ছে বুক কাটা ঢিলেঢালা লম্বা জামা। মুসলমানদের মধ্যে পায়জামার চলও আরব থেকে আগত অধিবাসীদের হাতে শুরু হয়। হালিম শররের ‘পুরনো লখনউ’ গ্রন্থে আছে, ‘হজরত মহম্মদ (সা.) সাহেবের সময়েই অন্য দেশ থেকে পায়জামা আরবে পৌঁছে যায় এবং পরবর্তীকালে বাগদাদি দরবারের ও প্রবাসী আরবদের জাতীয় পরিচ্ছদ হয়ে যায়। মুসলমান আসার আগে হিন্দুস্থানে ধুতি ছিল, পায়জামা ছিল না। দিল্লির শেষদিন পর্যন্ত এবং সারা হিন্দুস্থানে মুসলমানদের এই পায়জামাই ছিল। হিন্দুদের সঙ্গে মেলামেশার ফলে নিম্নবর্গের মসুলমানরা ধুতি পরত এবং প্রতিষ্ঠাবান হিন্দুরা ইচ্ছে করলে ঘরে ধুতি পরত। কিন্তু শিষ্টমণ্ডলীতে আসার সময় পায়জামা পরেই আসত।’ পায়জামা আসার পর উত্তর ভারতের মুসলমানদের মধ্যে লুঙ্গির ব্যবহার কমে যায় কিন্তু বাংলায় তা অব্যাহত ছিল। মলয় রায় বাঙালির বেশবাস: বিবর্তনের রূপরেখা গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বঙ্গদেশের ক্রমবর্ধমান মুসলিম জনগণ কেন লুঙ্গি বা তহমানকেই আদর্শ বেশ হিসেবে গ্রহণ করেছিল, তার কোনো ঐতিহাসিক বা সমাজতাত্ত্বিক কারণ আমার জানা নেই। তবে অনুমান করা যায়, আরব দেশ থেকে আমদানি করা মুসলিম তমদ্দুনের প্রতি আনুগত্য এর অন্যতম একটা কারণ হতে পারে। কালক্রমে ধুতি আর লুঙ্গি বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের বেশপ্রতীকে পরিণত হয়।’
বাংলায় মুসলিম শাসনে অব্যবহিত পূর্বে শাসক ছিল সেন বংশের। সে যুগে পুরুষের প্রধান পোশাক ছিল ধুতি আর নারীদের শাড়ি। পুরুষরা কোমরে কটিবন্ধ ব্যবহার করতেন এবং ঊর্ধ্বাঙ্গে থাকত উত্তরীয়। নারীদের ঊর্ধ্বাঙ্গের জন্য তখনো সেভাবে কোনো পোশাকের ব্যবহার শুরু হয়নি। শাড়ি কোমর থেকে কাঁধে ঝুলত, যা হয়তো আজকের দিনের আঁচল। তবে অনেক নারী ঊর্ধ্বাঙ্গে উত্তরীয়, ওড়না, চোলি বা স্তনপট্ট ব্যবহার করতেন। নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে উত্তরীয় ব্যবহারের বিষয়টি সে আমলের সাহিত্যে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। আর বিভিন্ন উপলক্ষে পোশাকের বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হতো। যেমন— বিয়ের সময় নারীরা চোলি পরতেন। সেনা ও কুস্তিগীররা উরু পর্যন্ত দীর্ঘ আঁটসাঁট পায়জামা ব্যবহার করতেন। শ্রমিক তথা নিম্নবিত্ত শ্রেণীর পুরুষরা ল্যাঙ্গোটি পরতেন। শিশুদের পরিধেয় ছিল ধুতি বা পাজামা।
বাংলার নারীদের মধ্যে অলঙ্কারের ব্যবহার ছিল। মধ্যযুগের সাহিত্যে এসব অলঙ্কারের বিবরণ পাওয়া যায়। অলঙ্কারসমূহের নামে ছিল বৈচিত্র্য। কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘অলঙ্কারের কথায় পরবর্তী নানা কাব্যে মস্তকে রত্ন মুকুট, চূড়ামণি, কপালে ঝুরি, মুক্তাবলী ও সিঁথি, পশ্চাদ্ভাগে পুরট ঝাঁপা, থোপনা, কর্ণে কর্ণপুর, কুণ্ডল, কর্ণফুলী, চক্রাবলী বা চাকা, নিম্ন কর্ণে বালি, নাসায় নাকচনা বেসর ও মুকুতাবলী, গলায় ধনাঢ্যের গজমুক্তার হইতে আরম্ভ করিয়া সরস্বতীহার, চন্দ্রহার, কলধৌত কণ্ঠমালা প্রভৃতি আছে। শিশুর গলায় সেকালেও বাঘনখ দৃষ্ট হয়। বাহু ও মণিবন্ধে টাড়বালা, বাউটি বা বাজুবন্ধ; কেয়ূর, অঙ্গদ বলয়, সোনার চুড়ি, খাড়ুু, রাঙ্গা রুলী; কটিতে কঙ্কিণী ও শিকলী, আঙ্গুলে আঙ্গুরী, পদে পাশুলী, নূপুর (ঘুংঘুর দেওয়া) এবং গোটামল প্রভৃতি নানা জাতীয় মল পাওয়া যায়। ক্রমশ কিরূপে একালের রুচির সঙ্গে সঙ্গে অলঙ্কারগুলো নব কলেবর ধারণ করিয়াছে, তাহা সাধারণ পাঠকের অজ্ঞাত নহে। একালের এক সুদীর্ঘ যাত্রার গানে শোনা গিয়াছে—

রমণী যতনে পরে নানা অলঙ্কার; নানা প্রকার,
গুজরি মাকড়ি সোনার চুড়ি আর চিক্হার,
মাছ মাদুলি, পাশা পাশুলী, কণ্ঠী পাঁইজোড়
আর চন্দ্রহার।— ইত্যাদি।

পাশা পাশুলী ও বহুদিন পলায়ন দিয়াছে; গুজরী চিকও তথৈবচ, এখন নূতন ফ্যাসানের হার, ফারফোর বালা অনন্তের অন্ত নাই। সোনার কানবালা ইংরেজি নামের অন্য ভূষণের অনুকূলে স্বত্ব ত্যাগে বাধ্য হইয়াছে।’
সেন যুগে বাংলার নারীদের ব্যবহূত অলঙ্কারের মধ্যে ছিল কুণ্ডল, হার, বলয়, মেখলা, নূপুর প্রভৃতি। আরো আছে মুক্তাহার, মরকতময়ী হার, মণিহার, চন্দ্রহার, কুণ্ডল, নাকবালা, কঙ্কণ। তত্কালে মেয়েদের পায়ে নূপুর ব্যবহারের চল ছিল।
বাংলার নারী-পুরুষের পায়ে জুতা উঠেছে ঔপনিবেশিক আমলে। এর আগে বিশেষত নারীরা খালি পায়েই চলতেন। ব্রিটিশ সাহেবদের অনুকরণে সম্ভ্রান্ত বাঙালির মধ্যে জুতা পরার চল শুরু হলো। পুরুষরা শুরুর দিকে পা কেটে, খুঁড়িয়ে হলেও জুতা পরে সাহেবদের সামনে হাজির হতে লাগলেন। তবে জুতা পরার এই চল সমাজ সহজে গ্রহণ করেনি। মেয়েদের জুতা পরাকে খ্রিস্টান হয়ে যাওয়া বলেও অনেক সময় কথা উঠেছিল। প্রবাদ তৈরি হয়েছিল, ‘মেয়েরা দেয় জুতো পায়/ ভাত ব্যঞ্জন পুড়ে যায়।’
মধ্যযুগ থেকে চলে আসা বাঙালি পুরুষের পোশাকরীতি বৈপ্লবিক একটি পরিবর্তন সূচিত হয় ঔপনিবেশিক আমলে, উনিশ শতকের শেষভাগে। শহরের বাঙালি পুরুষরা ধুতির ওপর সাদা শার্ট পরা শুরু করেন। পায়ে থাকত চামড়ার বুট। ধীরে ধীরে শুরু হলো ফুলপ্যান্ট (প্যান্টালুন), আঁট শার্ট, কোট, হ্যাট পরার অভ্যাস। মলয় রায় লিখেছেন, ‘উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালির পোশাকে হিন্দু, মোগল ও বিলেতি রীতির সংমিশ্রণ ঘটেছিল।’ এই শতকের শেষ নাগাদ বাঙলার সাধারণ মুসলিম পুরুষদের পোশাক হয়েছিল— পাজামা, শেরওয়ানি, টুপি, লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, চোস্ত। আর সাধারণ হিন্দু পুরুষদের পোশাক হলো— ধুতি, চায়না কোট, পিরান, চাদর, পাম সু বা হাঁটু পর্যন্ত মোজাসহ বুট জুতা; না হলে ধুতি, পাঞ্জাবি, উড়ুনি বা চাদর ও পাম সু।
বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ে পোশাকের ভেদ থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা ঘুচেও গিয়েছিল। শাড়ি তো বাঙালি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে আপন করে নিয়েছিলেন। যেমন— চাপকান নিয়ে তাঁর ‘কোট বা চাপকান’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘চাপকানের ইতিবৃত্ত আমার পিতাও জানেন না, আমিও জানি না, ইহাকে বিদেশী বলা যায় না। মুসলমানের সহিত বসনভূষণ শিল্পসাহিত্যে আমাদের এমন ঘনিষ্ঠ আদানপ্রদান হইয়া গিয়াছে যে উহার মধ্যে কতটা কাহার, তাহার সীমা নির্ণয় করা কঠিন। চাপকান হিন্দু-মুসলমানের মিলিত বস্ত্র। উহা যে সকল পরিবর্তনের মধ্য দিয়া বর্তমান আকারে পরিণত হইয়াছে, তাহাতে হিন্দু-মুসলমান উভয়েই সহায়তা করিয়াছে।”

তথ্যসূত্র:
বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ডক্টর এমএ রহিম, বাংলা একাডেমি
প্রাচীন বাংলা সামাজিক ইতিহাস: সেন যুগ, এসএম রফিকুল ইসলাম, বাংলা একাডেমি
সাজমহল: ঔপনিবেশিক বাংলায় মেয়েদের সাজগোজ, জয়িতা দাস, গাঙচিল
বাঙালির বেশবাস: বিবর্তনের রূপরেখা, মলয় রায়, মনফকিরা
মধ্যযুগের বাঙ্গালা, কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশি

(লেখাটির পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ ২১ এপ্রিল ২০১৭ 'দৈনিক বণিক বার্তা'র বিশেষ সাময়িকী 'সিল্করুট'-এ প্রকাশিত)
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ২:০০
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বৃদ্ধাশ্রম।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১৬



আগে ভিডিওটি দেখে নিন।

মনে করেন, এক দেশে এক মহিলা ছিলো। একটি সন্তান জন্ম দেবার পর তার স্বামী মারা যায়। পরে সেই মহিলা পরের বাসায় কাজ করে সন্তান কে... ...বাকিটুকু পড়ুন

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×