somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিশানের নাম যখন কালাশনিকভ

১৯ শে আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ১২:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এটাই দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভারী অস্ত্র। বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী, গেরিলাযোদ্ধা কিংবা গ্যাংস্টার— সবাই ব্যবহার করে। 'কালাশনিকভ বা একে-৪৭, দেশকে রক্ষা করার জন্য এটা তৈরি করেছিলাম। তারা অস্ত্রটিকে ছড়িয়ে দিয়েছে। এমনটা কিন্তু আমি চাইনি। তারপর অবস্থা হয়েছে বোতল থেকে দৈত্যের বের হয়ে আসার মতো, সে নিজের ইচ্ছামতো যেদিকে খুশি চলে গেছে।''- মিখাইল কালাশনিকভের মন্তব্য। গল্পটা একটু পেছন থেকে শুরু করা যাকপুরো নাম মিখাইল তিমোফিভিচ কালাশনিকভ, জন্মেছিলেন ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ নভেম্বর। দুনিয়া মাত্রই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি দেখেছে। অনেকে ধারণা করেছিলেন, এই মহাযুদ্ধ সব যুদ্ধের সমাপ্তি টানবে। এবার শান্তি নেমে আসবে অস্থির দুনিয়ায়। কালাশনিকভের পরিবার বাস করত কুরিয়ার আলতাই গ্রামে। সেখানকার আবহাওয়া ছিল প্রতিকূল, ভয়ানক ঠাণ্ডা। পরিবারের ১৯টি শিশুর মধ্যে মাত্র আটটি জীবিত ছিল। এবার আমরা চলে আসি ১৯৪৯ সালে। ভূমি থেকে ১০০ ফুট উচ্চতায় নিরাপদে রাখা হয়েছে পারমাণবিক বোমা। নাম আরডিএস-১। বোমার আকার চোখের পানির ফোঁটার সদৃশ। ধাতব কাঠামোর ভেতরে ছিল ইউরেনিয়াম ও প্লুটোনিয়াম, এদের ধ্বংসক্ষমতা ছিল ২০ কিলোটন টিএনটির সমান। চার বছর আগে নাগাসাকিকে ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্র যে বোমাটি ব্যবহার করেছিল, শক্তিতে আরডিএস-১ প্রায় তার সমান। এভাবে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করে। পারমাণবিক অস্ত্রের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্বের অবসান ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়ন আবারো যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ। ঠাণ্ডাযুদ্ধ এবার কেয়ামতের ময়দান প্রস্তুত করে ফেলল।
তারবার্তায় সোভিয়েতের পারমাণবিক বিস্ফোরণের খবর পৌঁছে যায় পশ্চিমের রাজধানীতে। উরাল রেঞ্জের কাছে এই পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। ঠিক সে সময়েই সোভিয়েত সামরিক গবেষণাগারে চলছিল জোসেফ স্তালিনের আরেকটি স্বপ্নের বাস্তবায়নের কাজ। এটি ছিল সেই আমলের এক অদ্ভুত দর্শন রাইফেল। ক্লাসিক ডিজাইনকে অবজ্ঞা করে এই নতুন রাইফেলের নকশা করা হয়েছিল। জন্ম হলো কালাশনিকভ বা একে-৪৭ অ্যাসল্ট রাইফেলের। পরবর্তী ২৫ বছরের মধ্যে এটা দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ব্যবহূত রাইফেলে পরিণত হয়।
বাস্তবতাই সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নকে কালাশনিকভের মতো অ্যাসল্ট রাইফেল তৈরিতে আগ্রহী করে তুলেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বাহিনী দুনিয়ার প্রথম বৃহদাকারে উত্পাদিত নিজস্ব অ্যাসল্ট রাইফেল sturmgewehr ব্যবহার করেছিল। পূর্বাঞ্চলীয় ফ্রন্টে সোভিয়েত বাহিনীকে এই অস্ত্রের মোকাবেলা করতে হয়েছে। ফলে সোভিয়েত বাহিনীও নিজেদের একটি অ্যাসল্ট রাইফেলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল। জার্মানির sturmgewehr-এর সমকক্ষ একটি অটোমেটিক রাইফেল চাচ্ছিল সোভিয়েত সেনাবাহিনী। অনেকে মনে করেন, মিখাইল কালাশনিকভের ডিজাইন বৈপ্লবিক আবিষ্কার ছিল না বরং সেটা ছিল বিবর্তন। পুরনো আমলের লম্বা রাইফেল এবং সে সময়কার ছোট সাবমেশিনগানের মধ্যে একটা সমন্বয় করার চেষ্টা চলছিল।
‘একে’ দুটি রুশ শব্দের আদ্যক্ষর ‘আভতোমাত কালাশনিকোভা’; অর্থ কালাশনিকভের অটোমেটিক। নকশাকার সিনিয়র সার্জেন্ট মিখাইল তিমোফিভিচ কালাশনিকভের প্রতি সম্মান জানাতেই এই নামকরণ। ২৯ বছর বয়সে সাবেক এই ট্যাংক কমান্ডার কালাশনিকভের নকশা করেছিলেন। মস্কোর পূর্বদিকে অবস্থিত কোমরভে টেকনিক্যাল ব্যুরো ১৯৪৭ সালে অস্ত্রটির প্রাথমিক নমুনা তৈরি করতে সক্ষম হয়। এটা পদাতিক রাইফেলের চেয়ে খাটো কিন্তু ৩০ বছর ধরে ব্যবহূত হওয়া সাবমেশিনগানের চেয়ে দীর্ঘ।
অস্ত্রটি মাঝারি শক্তির কার্টরিজ ফায়ার করে, লম্বা দূরত্বে নজরদারির জন্য এটা সুবিধাজনক নয়। কিন্তু এটা যুদ্ধ যে দূরত্বে সংঘটিত হয় সেখানে মরণঘাতী হামলা এবং ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে সক্ষম। সেই আমলে মেশিনগান যুদ্ধের গতিমুখ বদলে দিত। কালাশনিকভের প্রাথমিক রূপ সেই মেশিনগানের হারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গুলি চালাতে পারত। সাধারণ রাইফেলের মতো এটা দিয়ে সিঙ্গেল শটও ফায়ার করা যায়।
ঠাণ্ডাযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো প্রতিপক্ষই তখনো এমন কমপ্যাক্ট ফায়ার পাওয়ারের আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করতে পারেনি। এই নতুন অস্ত্রের আরো কিছু সুবিধা ছিল। গুলি করার পর রাইফেলের পেছন দিকে যে ধাক্কা তৈরি হয়, তা এই রাইফেলে ছিল সে সময়ের অন্যগুলোর চেয়ে অনেক কম। এই রাইফেল নোংরা পানি বা বালিতে ডুবে গেলেও জ্যাম হয়ে যায় না বরং নিশ্চিন্তে ব্যবহার করা যায়। এ চালানো এতটাই সহজ যে, কেউ চাইলে কয়েক মিনিটের মধ্যে শিখে নিতে পারবেন। এমনকি তখন সোভিয়েতের স্কুলের ছাত্ররা ৩০ সেকেন্ডে অস্ত্রটি খুলে আবার জোড়া লাগাতে পারত। এসব বৈশিষ্ট্যের কারণে অস্ত্রটি সাধারণ মানুষও খুব বেশি প্রশিক্ষণ ছাড়া ব্যবহার করতে পারতেন। দুই বা তিনটি ফুটবল মাঠের দূরত্বে থাকা শত্রুকেও এ অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা যেত। একেবারে সামান্য প্রশিক্ষণ নিয়ে এ অস্ত্র ব্যবহার করা যায়, ফলে যুদ্ধচলাকালীন গেরিলাযোদ্ধা বা সব শ্রেণীর সেনারা অস্ত্রটি ব্যবহার করতে পারে। অন্যদিকে প্রতিকূল আবহাওয়া বা ভৌগোলিক পরিস্থিতিতে সামান্য যত্নেই অস্ত্র কর্মক্ষম থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের কালাশনিকভের গুণাগুণ বুঝতে অতি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের আনন্দবাজারে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে নজর দেয়া যায়। ২১ বছর আগে পুরুলিয়ায় অস্ত্র বর্ষণের পর উদ্ধারকৃত অস্ত্রের অনেকগুলোই পরবর্তীকালে ব্যবহার করেছেন কলকাতা পুলিশের কমান্ডোরা। এসব অস্ত্রের মধ্যে আছে সোভিয়েত ইউনিয়নে তৈরি ২০টি কালাশনিকভ। এই ২০টি রাইফেল সম্পর্কে সেখানকার এক কর্মকর্তার মন্তব্য এ রকম— ‘১৫ বছর হয়ে গেল। ওদের কেউই কখনো ধোঁকা দেয়নি।’ আর কালাশনিকভের বিভিন্ন সংস্করণের মধ্যে সেই সোভিয়েত ইউনিয়নেরগুলোই যে সেরা, তাও উঠে এসেছে লালাবাজারের এক কর্মকর্তার কথায়— ওই ২০টা রাইফেল (সোভিয়েত ইউনিয়নে তৈরি) থেকে নিখুঁত নিশানায় গুলি ছোড়া যায়। অ্যাডজাস্ট করা বা নিজের মতো করে ঠিক করার দরকার নেই। তবে পরবর্তীকালে চেক প্রজাতন্ত্র থেকে আসা রাইফেলের প্রায় সবগুলোর ক্ষেত্রেই ওই সমস্যা। যিনি ব্যবহার করবেন তাকে আগে নিজের মতো নিশানা ঠিক করে নিতে হচ্ছে।
কালাশনিকভ তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপট নিয়ে আছে জমজমাট বিতর্ক। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাষ্যে মাতৃভূমিকে রক্ষা করার প্রেরণা থেকেই অস্ত্রটি তৈরি হয়েছিল। The Gun : The AK-47 and the Evolution of War গ্রন্থের লেখক সি জে শিভারস মনে করেন, এটা ছিল সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির প্রোপাগান্ডা। তিনি মনে করেন, এখানে নায়কোচিত কোনো ব্যাপার ঘটেনি। এই আবিষ্কার কোনো একজন মানুষের চিন্তা এবং প্রচেষ্টাপ্রসূত নয়। বরং এটা ছিল একটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ, যেখানে সামষ্টিকভাবে কাজ করা হয়েছে। আর সবকিছুর মূলে ছিল সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি। অবশ্য শিভারসের এই মূল্যায়ন চোখ বুজে মেনে নেয়ার উপায় নেই, কারণ মিখাইল কালাশনিকভ নিজেই বলেছেন, ‘আমি মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য এটা তৈরি করেছিলাম।’
শুধু যে ব্যবহারে সুবিধা বা সক্ষমতার জন্যই কালাশনিকভ দুনিয়ার প্রধান আগ্নেয়াস্ত্র হয়ে উঠেছে এমনটা নয়। বরং সোভিয়েত সরকার ১ কোটি একে-৪৭ তৈরি করে অস্ত্রটিকে দুনিয়ায় জনপ্রিয় করে তুলেছিল। গত শতকের শেষদিকে একটা কথা প্রচলিত ছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র রফতানি করে কোকা-কোলা, জাপান করে সনি আর রাশিয়া করে কালাশনিকভ।
১৯৫০-এর দশকটি ছিল কালাশনিকভের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ সময় অস্ত্রটি পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেছে। অস্ত্রটির উদ্ভাবককে তত দিনে বিপুলভাবে সম্মানিত করা হয়েছে, পুরস্কারও দেয়া হয়েছে। তিনি হয়ে ওঠেন প্রলেতারিয়েতের নায়ক। এ দশকেই সমাজতান্ত্রিক দুনিয়াজুড়ে এই রুশ অ্যাসল্ট রাইফেল তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। প্রথমবারের মতো যুদ্ধক্ষেত্রে কালাশনিকভের ব্যবহার শুরু হয়, সেনাবাহিনী এবং বিদ্রোহী উভয় পক্ষই এ অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। তখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী কালাশনিকভের অর্থ এবং গুরুত্ব বুঝে উঠতে পারেনি। নিজেদের নাক উঁচু মানসিকতার কারণে যুক্তরাষ্ট্র কালাশনিকভের গুরুত্বকে আমলে নিতে চায়নি। নিজেদের বাহিনীর জন্য তাদের তৈরি অস্ত্র কালাশনিকভের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেনি। এবং ততক্ষণে কালাশনিকভের যুগ এসে পড়েছে, আমরা এখনো সেই যুগেই বাস করছি। ট্যাংক কোনো প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে; জিপিএস-গাইডেড অস্ত্র যোদ্ধাদের এলোমেলো করে দিতে পারে। ল্যান্ড মাইন, আত্মঘাতী বোমাবাজ এবং ইম্প্রোভাইজড বোমা বর্তমানকালে অনেক বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। কিন্তু এখনো দুনিয়াতে কালাশনিকভই প্রধান অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত এবং ব্যবহূত। যে কোনো লড়াই তার অস্ত্রের ওপরই নির্ভর করে। খুব অল্পসংখ্যক অস্ত্রের ব্যবহারই একে-৪৭-এর মতো ঝটপট শেখা যায়। দুনিয়াতে আর কোনো অস্ত্র কালাশনিকভের মতো বছরের পর বছর বিভিন্ন অঞ্চলের যুদ্ধ-সংঘাতে এভাবে ব্যবহূত হয়নি। আর কোনো অস্ত্র এত বিভিন্ন ধরনের সামরিক তত্পরতার জন্য উপযুক্ত নয়। এখনো যুদ্ধে যেসব রাইফেল ব্যবহূত হয় তার মধ্যে কালাশনিকভ লাইনটিই সবচেয়ে বেশি এবং বিস্তৃতভাবে ব্যবহূত।
কালাশনিকভ তৈরি হওয়ার ছয় দশক পর দুনিয়ার ৫০টিরও বেশি দেশের সেনাবাহিনী অটোমেটিক কালাশনিকভ ব্যবহার করে। এছাড়া পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা এবং নিরাপত্তারক্ষীরাও এ অস্ত্র ব্যবহার করে। তবে কালাশনিকভের মূল ব্যবহারের ক্ষেত্র কিন্তু পেশাদার সেনাবাহিনী নয়, বরং গেরিলা, সন্ত্রাসী, শিশু যোদ্ধা, একনায়ক এবং দুর্বৃত্তরাই কালাশনিকভের মূল ব্যবহারকারী। কালাশনিকভের সক্ষমতা এবং সহজ ব্যবহারবিধি ক্ষমতা এবং সামরিক শক্তিতে অধিকতর সামর্থ্যবানের বিরুদ্ধে লড়াইরত যেকোনো শক্তি তার শত্রুকে মোকাবেলা করতে অস্ত্রটিকে বেছে নেয়।
কালাশনিকভ প্রথমবারের মতো মরণঘাতী আঘাত হানে পূর্ব জার্মানি ও হাঙ্গেরিতে, যথাক্রমে ১৯৫৩ এবং ১৯৬৫ সালে। বিদ্রোহ দমন এবং পলায়নপর নাগরিকদের ওপর কালাশনিকভ ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে একে-৪৭-এর ব্যবহার শুরু হতেই তা যুদ্ধের অনেক নিয়মকে বদলে দিয়েছিল। ১৯৬০-এর দশকে ভিয়েতনামের হু শহরে মার্কিন মেরিন সেনারা একে-৪৭-এর মুখোমুখি হয়। এখানে মেরিন সেনারা দেখতে পায় কালাশনিকভ হাতে একজন গেরিলা পুরো এক কোম্পানি সেনার অগ্রযাত্রাকে রুখে দিতে পারে। শেষমেশ মার্কিন সেনারা কালাশনিকভ থেকে গুলি ছোড়া সেই ভিয়েত কং গেরিলাকে মোকাবেলা করতে সে যেই ভবনের আড়ালে ছিল, তা গুঁড়িয়ে দিতে কামান ব্যবহার করেছিল।
শুরুর দিকে কালাশনিকভের ক্ষমতা অনেকেই বুঝে উঠতে পারেনি। ফিনল্যান্ডের প্রকৌশলী এবং জোসেফ টিটোর যুগোস্লাভিয়া কালাশনিকভের প্রাথমিক সংস্করণ সংগ্রহ করেছিল। বিপ্লব সফল হওয়ার পর ফিদেল কিউবায় সোভিয়েত কালাশনিকভের মজুদ গড়ে তোলেন। ফিদেল অনেককে উপহার হিসেবেও কালাশনিকভ দিয়েছেন। উগান্ডার শাসক ইদি আমিন তার সেনাবাহিনীকে কালাশনিকভ দিয়ে সজ্জিত করেন। ইয়াসির আরাফাত তাদের প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) জন্য কালাশনিকভ কেনেন। ফাতাহ থেকে সৃষ্টি হওয়া বিভিন্ন সশস্ত্র দলও এই একে-৪৭-এর ওপর নির্ভর করত। বিপুল উত্পাদন এবং বিভিন্ন হাতে বিক্রি হওয়ায় যে সোভিয়েত সেনাবাহিনী এই অস্ত্র তৈরি করেছিল, একসময় অস্ত্রটি তাদের বিরুদ্ধেই বিভিন্ন বাহিনী ব্যবহার করতে শুরু করল। এমনটা হয়েছিল সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধ এবং চেচনিয়ায়।
১৯৮০-র দশক নাগাদ বিভিন্ন উত্স থেকে আফগান যুদ্ধে দুই পক্ষকেই অস্ত্র সরবরাহ করা হয়। পুরো আফগানিস্তান একে-৪৭ রাইফেল আর তার গুলিতে পূর্ণ হয়ে যায়। কালাশনিকভ দারুণ টেকসই এক অস্ত্র, কয়েক প্রজন্ম কোনো সমস্যা ছাড়াই একটি কালাশনিকভ ব্যবহার করতে পারে। আফগানিস্তানে একে-৪৭ মুজাহিদিনদের কয়েক প্রজন্মের হাত ঘুরেছে। কাবুলের উত্তরের পার্বত্য এলাকার পঞ্জশির উপত্যকায় কালাশনিকভ আফগান পরিবারগুলোর গৃহস্থ আসবাবপত্রে পরিণত হয়েছিল। আফগান যুদ্ধের শুরুর বছরগুলোতে এই উপত্যকাতেই ভয়ানক কিছু লড়াই হয়েছিল। মুজাহিদিনদের কিংবদন্তি উপত্যকার কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়েছিল। যতবারই সোভিয়েতবাহিনী এই উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে ততবারই তারা গেরিলাদের ব্যাপক হামলার মুখে পড়েছে। এই উপত্যকাকে কখনই সোভিয়েত বাহিনী দখলে নিতে পারেনি।
সোভিয়েত বাহিনীর প্রধান শত্রু ছিলেন আহমেদ শাহ মাসুদ। এই তাজিক কমান্ডারের কারিশমা এবং সামরিক কুশল আফগান লোককথায় জায়গা করে নিয়েছে। একবার এক সোভিয়েত হামলার পর মাসুদ জনৈক আফগান গেরিলার শেষকৃত্যে যোগ দেন। এখানে মাসুদ মৃত গেরিলার কালাশনিকভ সবার সামনে তুলে ধরেন এবং সেটা সেই গেরিলার ছোট ভাই আশরাত খানের হাতে তুলে দেন। এভাবে একটি শোকের অনুষ্ঠানকে মাসুদ তার কারিশমাকে ব্যবহার করে তাঁর বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধের নতুন প্রেরণা সঞ্চারিত করেন। আশরাত খানকে মাসুদ জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি মুজাহিদিন হতে চাও?’ আশরাত খান দুহাত প্রসারিত করে রাইফেলটি গ্রহণ করেন। ‘হ্যাঁ, আমি আমার ভাইয়ের অস্ত্র হাতে নেব এবং আমি আপনার সঙ্গেই থাকব।’ এমন মুহূর্ত প্রমাণ করে কালাশনিকভ নামের একটি রাইফেল মানুষের বৈষয়িক এবং স্বপ্নের জগতে মিশে গিয়েছিল। মিখাইল কালাশনিকভ যে প্রেরণা থেকে কালাশনিকভ তৈরি করেছিলেন, সেই একই প্রেরণায় আফগান মুজাহিদিনরা অস্ত্রটি হাতে তুলে নিয়েছিল। অস্ত্রটি সেই শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে একইসঙ্গে সংহতি এবং আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। ক্রেমলিন শুধু যুদ্ধের জন্যই এ অস্ত্র তৈরি করেছিল কিন্তু একসময় এই কালাশনিকভ যুদ্ধের গণ্ডি ছাপিয়ে অনেক মানুষের সংস্কৃতির উপাদান হয়ে উঠেছিল।
২০০৪ সালে নিহত হন হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিন। তার অনুসারীরা যখন তার শব নিয়ে শোকযাত্রা বের করেছিল, তখন সেটা ঘিরে রেখেছিল একদল মুখোশধারী— যাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল উদ্ধত একে-৪৭ রাইফেল। এটা ছিল পুরনো একটি দৃশ্যের প্রত্যাবর্তন। ছয় বছর আগে কম্বোডিয়া-থাই সীমান্তে পল পটের মরদেহকে পাহারা দিয়েছিল একদল তরুণ বন্দুকধারী— যাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল কালাশনিকভের এশীয় সংস্করণ।
একটা সময় গোপন রাজনৈতিক সংগঠনের সদস্যদের অন্যতম যোগ্যতা ছিল কালাশনিকভ চালাতে জানা। আফগানিস্তান এবং পকিস্তানের আল কায়েদা ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করা ছাত্রদের নোটবুক থেকে দেখা যায়, জিহাদের পাঠ্যসূচিতে প্রথম দিনের ক্লাসেই থাকত কালাশনিকভ চালানোর প্রশিক্ষণ।
অনেকে বাস্তব প্রয়োজনেও নিজের কাছে কালাশনিকভ রেখেছেন। ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনকে যখন গোপন আস্তানা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল তখন তার সঙ্গে যেসব ব্যবহার্য ছিল তার মধ্যে ছিল দুটি একে-৪৭ রাইফেল। কালাশনিকভ কেবল যুদ্ধ আর যোদ্ধাদের সঙ্গী হয়েই রয়নি, দক্ষিণ আমেরিকার ড্রাগ মাফিয়াদেরও প্রিয় অস্ত্র হয়ে উঠেছে। কোকো প্লান্টেশন বা কোকেন তৈরির কারখানা পাহারা দেয়ার জন্য কালাশনিকভ হাতে পাহারাদার থাকে।
আজকের দিনে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না যে, কত কালাশনিকভ এখন দুনিয়াতে সক্রিয় আছে। বিভিন্ন আনুমানিক হিসাব থেকে ধারণা করা হয় দুনিয়াতে এখন প্রায় ১০ কোটি কালাশনিকভ সক্রিয় আছে।
ঠাণ্ডাযুদ্ধের কালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিভিন্ন দেশে তাদের মিত্রদের কালাশনিকভ সরবরাহ করেছে। অবশ্য শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়, সঙ্গে আরো অনেক দেশ এই উদ্যোগে নিয়োজিত ছিল। রাশিয়া, চীন ও উত্তর কোরিয়ার কালাশনিকভ গিয়েছে উত্তর ভিয়েতনামের যোদ্ধাদের হাতে, পোলিশ কালাশনিকভ হাতে পেয়েছে কন্ট্রা, পূর্ব জার্মানি দিয়েছে ইয়েমেনকে, রোমানীয় কালাশনিকভে সজ্জিত হয়েছে কুর্দিরা, রুয়ান্ডায় পাওয়া যাবে রুশ ও বুলগেরিয়ার কালাশনিকভ। যুক্তরাষ্ট্র আফগান যুদ্ধের সময় চীন ও মিসরের কালাশনিকভ পৌঁছে দিয়েছিল সোভিয়েতবিরোধী মুজাহিদিনদের বিরুদ্ধে। উগান্ডা ও সুদানে পাওয়া যাবে চীনের কালাশনিকভ।
যুদ্ধ, সহিংসতা বিষয়ে গবেষকদের কাছে কালাশনিকভের বাড়তি গুরুত্ব আছে। কোনো দেশের খোলাবাজারে কালাশনিকভের দাম দেশটির যুদ্ধ পরিস্থিতি বা ঝুঁকি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। খোলাবাজারে কালাশনিকভের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বৃদ্ধি পায় আর কমলে বুঝতে হবে সংঘাতের তীব্রতা ও ঝুঁকি কমছে। কালাশনিকভ সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে গেলে বুঝতে হবে সেই দেশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, অস্ত্রটি দারুণ এক অনানুষ্ঠানিক সামাজিক সূচক। সাধারণ পোশাক পরিহিত তরুণদের হাতে কালাশনিকভ দেখলে বুঝতে হবে সেই দেশ জীবনের জন্য বিপজ্জনক। ২০০৪ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১৮টি দেশে শিশুযোদ্ধাদের উপস্থিতির কথা জানিয়েছিল এবং দেখা গেছে এই শিশুযোদ্ধাদের হাতের প্রধান অস্ত্রটি কালাশনিকভ।
কালাশনিকভের চেহারা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গোপন কারখানা থেকে কালাশনিকভ এখন দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। আর এ যাত্রায় কালাশনিকভ কেবল অস্ত্র হয়ে থাকেনি বরং একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে। শুরুতে এটা ছিল স্ট্যালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নের শিল্প ও সামরিক খাতের সাফল্যের প্রতীক। তারপর ধীরে ধীরে বিদ্রোহ, সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম, গ্যাংওয়ার এবং সবশেষে জিহাদের প্রতীক হয়ে ওঠে কালাশনিকভ। মোজাম্বিকের পতাকায় আছে বেয়নেট লাগানো কালাশনিকভ, সঙ্গে আছে একটা কোদাল ও বই। মনে হবে যেন বই আর কোদালের মতো কালাশনিকভও জাতির জন্য অত্যাবশ্যকীয়। লেবাননের প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহর পতাকাতেও একে-৪৭ সদৃশ অস্ত্র দেখা যায়।
২০১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর ৯৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন মিখাইল কালাশনিকভ।

(লেখাটির পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ মিখাইল কালাশনিকভের মৃত্যুবার্ষিকী ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬ 'দৈনিক বণিক বার্তা'র বিশেষ সাময়িকী 'সিল্করুট'-এ প্রকাশিত)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৭ দুপুর ১২:৫৩
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

টের পেলে

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৫৭

টের পেলে
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

টের পেলে গুটিয়ে যায় লজ্জাবতী/ পরিপূর্ণ যৌবনে যুবতীর নিখুঁত অনুভূতি। আমার চাওয়া, ইচ্ছে, স্বপ্ন! আমার পছন্দ বুঝদার, সুন্দর হৃদয়ের রূপ! সৌন্দর্য সুন্দর যা চিরন্তন সত্য। কিন্তু সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×