somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঘুণপোকা কেটে নিচ্ছে সব স্মৃতির কোলাজ: আমিনুল হক শান্ত

০৯ ই জুন, ২০১০ দুপুর ২:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঘুণপোকা কেটে নিচ্ছে সব স্মৃতির কোলাজ
আমিনুল হক শান্ত

এই গানটা শুনে দেখ...... এই বলে সুমন তার ঘরে রাখা স্টেরিওটা ছেড়ে দেয়।

কিছুক্ষণ আগে সিগারেটে ভরে সাল্টু, গঞ্জিকার নিজেদের দেয়া নাম, টেনেছে দুজনে খুব। এখন সুতরাং দুজনেই খুব হাই, এক অচেনা স্বপ্ন বলে ভ্রম হয় এমন কুহকে জড়িয়ে অবসন্ন হয়ে দুলছে। দুপুর মরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, এরই মাঝে যে ক্লান্ত অপরাহ্নের রোদ শরীর বিছিয়েছে মাঠের ঘাসে ঘাসে, অনাদরে বেড়ে উঠা লতা গুল্মে, নির্জীব গাছের গুড়িতে, কান্ডে, পাতায় আর শহরের দালানে, সুমনের জানালাপথে সেসমস্ত দৃশ্যাবলী খন্ডিত হয়ে ভেসে উঠে। স্টেরিওটাতে এসিডিসি তীব্র রক এন্ড রোলের মাদক ছড়ায়, ওরা দুজনেই নাচতে থাকে সুর ও ছন্দের দোলায় । নাচে যদিও একটু উন্মাদনা ছড়িয়ে থাকে, এলোমেলো হয়ে উঠে নৃত্যরত দুজোড়া পা!

‘তোর কাছে সিগারেট আছে?’ সুমন জানতে চায়।

‘আছে,’ বলে সোহান।

‘তাহলে ধরা একটা; আর এই নে চকলেট,’ বলে সুমন।

চকলেটের সাথে সাথে নেশাটা আরও একটু জমে উঠলে দুজনে সিগারেট ধরায়। এসিডিসি তে তখন তীব্র হয়ে উঠেছে গিটার আর ড্রামস্ ।

‘শালারা দারুন,’ বলে উঠে সোহান।

‘হুম,’ সুমনের সংক্ষিপ্ত উত্তর।

ওরা নাচতে থাকে ছন্দের তালে তালে। উভয়ই অকারণে হাসে, সুমন বাড়িয়ে দেয় ভল্যুমটা। যা শালা, বাজা, বাজা...। চারদিক নিঝুম, কেবল দুটি কৈশোর উত্তীর্ণ যুবক এক মাতাল পাগলামোতে নেচে চলে।

সোহান চমকে উঠে, আজকের অপরাহৃও তেমনি নিঝুম হয়ে পড়ে আছে। অদূরে যে সমস্ত নতুন বাড়িগুলো বেড়ে উঠছে তাতে হাতুড়ি পেটানো, পেরেক ঠোকা ইত্যাদি নানাবিধ আওয়াজ, কাকের আচমকা দু’একটা হাহাকারের মত ডাক, রিক্সার বেল আর গাড়ির হর্ণ আচমকা সেই আপাত নৈঃশব্দকে ভেঙ্গে দিচ্ছে কখনও কখনও। তবু এমন অপরাহৃও বুঝি স্মৃতিময় সেই অপরাহৃরই এক পুনরাবৃত্তি! এমনই ভাবে সোহান।

তার ভিতরের গভীর থেকে কে যেন বলে,‘কি রে সোহান, খবর কি?’

যদিও হয়ত সম্পূর্ণই অহেতুক এবং কল্পনায় তবু বড্ড শরীরী মনে হয়।

‘এমন ধুপ করে কাউকে কিছু না বলে এত অভিমানে মরে গেলি সুমন?’ সোহান জিজ্ঞেস করে।

‘বাহ এখন তো বেশ জিজ্ঞেস করছিস, এতদিন তোরা তো কেউ খোঁজ নিতি না। সবাই তো যে যার মত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলি।’ গাঢ় অভিমান আর বেদনা যেন সুমনের স্বরে।

সোহান ভেবে দেখে অবাক হয় কথাটা খুবই সত্যি, গত চার বছর সুমনের সাথে দেখা হয়নি। অথচ একটা সময় ছিল প্রতিদিন কখনও কখনও দুবার তিনবারও দেখা হত। হয়ত সকাল দশটায় গিয়ে দুপুরে তিনটায় বাসায় ফিরা হল, তারপর আবারও দুপুরের খাবারটা খেয়েই বিকেলে দেখা। গত চারটা বছর নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল ভীষণ। জীবনে বড় বড় কিছু ঘটনা ওকে বন্ধুদের থেকে অনেকখানি বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। তাছাড়া সবাই যার যার মত ব্যস্ত...সুতরাং....। সুমনের মৃত্যুর সংবাদটা কি করে যেন বাতাসে ভেসে ভেসে ওর কাছে পৌঁছে...ওর কথা মনে পড়ছে আজ, সাথে সাথে অন্য আরও স্মৃতি হুড়মুড়িয়ে হৃদয়ের বন্ধ কপাট খুলে যেন আন্দোলন তুলছে।

সুমনের বাবা প্রণব দাস ছিলেন বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী। মা শেষ দিকে প্রায় অন্ধই হয়ে যান এবং ভদ্রমহিলা ছিলেন খুবই ফর্সা। সুমনের দুই বোনের একজনকে ওরা কখনই দেখেনি, ওর এক বোনকেই ওরা বন্ধুরা চিনত এবং তাকে ছোড়দি বলে সম্বোধন করত। ওদের বাড়িতে প্রাচুর্য ছিল না, তবে কোথায় জানি একটা পরিচ্ছন্নতার আর শীতলতার সুবাতাস বইত। গেলেই মনটা ভাল হয়ে যেত।

অদ্ভুত ছিল মেসো আর মাসিমার সম্পর্ক। মাসিমা খুব আদর করে কথা বলতেন আর মেসো ছিলেন একটু রাশভারী। সুমনের বন্ধুদের অকর্মন্যতা এবং নানাবিধ নেশাজাত দ্রব্য গ্রহণও তাকে তাদের প্রতি অসহিঞ্চু ও বিরূপ করে তুলতে সাহায্য করেছিল নিঃসন্দেহে। আর অবাক কান্ড মেসো মারা যাবার এক মাসের মাথায় মাসিমাও মারা যান হঠাৎ করেই। এ নিয়ে অন্য বন্ধুরা কি ভেবেছিল জানা না গেলেও সোহানের কাছে বিষয়টা খুবই রহস্যময় বলে মনে হয়েছিল। এ কি মায়া, প্রেম? না কেবলই এক কাকতালীয় যোগাযোগ? ছোড়দিরও বিয়ে হয়ে যাওয়ায় এবং মেসো মাসিমার উভয়ের মৃত্যুতে সুমন এরপর পুরোপুরি স্বাধীন হয়ে যায়। পৌত্রিক কিছু সম্পত্তির অধিকারী হয়ে উঠে বলে শুনেছিল সোহান এবং তার ফলে যতদিন বেঁচে ছিল বেশ খানিকটা স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছিল হয়ত। সোহান এখন ভেবে দেখে এটি হয়ত হিতে তার জন্য বিপরীতই হয়েছিল।

যদিও সেসমস্ত সোহান ভাল বলতে পারবে না। কেননা সে সময়টাতেই তার পুরোন বন্ধুদের সাথে এক রকম বিচ্ছেদ ঘটে যায়। সোহান পৃথিবীর আরও নানাবিধ বাঁচার অনুসঙ্গ বস্তুগত সুখ, নারী ও শিশু এবং পৃথিবীর দিকে মুখ ফিরিয়েছে। ততদিনে দিগন্ত বিস্তৃত হয়েছে ঢের, পৃথিবীটা, বিশেষত ঢাকাকেও তখন এক বদ্ধ চৌবাচ্চা আকৃতির ক্ষুদ্র শহর বলে মনে হতে থাকে।

এ সমস্তই স্মৃতির ওপাড় থেকে এক প্রবল ঝাঁকুনিতে সজাগ করে দিয়ে যায় ওকে। মানুষ কি তবে স্মৃতিতেই বাঁচে? প্রতিদিন এক একটি স্মৃতিই সে কুড়োয় কি তবে?

অতিব্যস্ত ঢাকার কোলাহল ছাড়িয়ে কে যেন দূ...র স্মৃতির ওপার থেকে আচমকা এক দমকা নিঃশ্বাসে সোহানকে ডেকে ফিরল...সো...হা...ন এই সো...হা...ন। কে ডাকল? তামিম না মানিক, নাহার কি? শিপন, স্বাধীন, সুমন, শুভ...লুবনা...? কে কে...? নাকি এ-এক ‘সম্মিলিত সচেতনতা’ আচমকাই স্মৃতিতে ফিরে গেল? সবগুলো মুখ যেন একযোগে গলে গলে একাকার হয়ে ঝপ করে মাথায় ঢুকে পড়ল, মাথায় কেমন যেন সব গোলমাল পাকিয়ে জট বেঁধে গেল।

মাথাটা কি চৌচির হয়ে যাবে? আনন্দশংকরের কম্পোজিশনের তীব্রতায় কে যেন খুলিতে ভয়ানক তাল ঠুকে চলেছে। জয় জয় রাম, সিয়া রাম, জয় জয় রাম...। আনন্দশংকর খুব প্রিয় ছিল সুমনের, সোহানেরও খুব ভাল লাগে ওকে। এক মাতাল ঋত্বিকের মত দোলা দিয়ে যেতে থাকে হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে, এক তীব্র আকুলতায় চরাচর ছিন্ন করে যেন দুলে উঠে বাস্তবতার জটিল গ্রন্থী। আশ্চর্য সিডি প্লেয়ারটায় আনন্দশংকর কি নিজে নিজেই বেজে উঠল? কে ছেড়েছে? সোহান নিজেই? কখন ছাড়ল?

এতখানি নিমগ্নতায় ডুবে ছিল যে টের পেল না!! হতভম্ব হয়ে বিস্মিত সোহান দুরাগত ধ্বনির মত নিজের ভিতরে এক প্লাবনভূমি জেগে উঠতে দেখে ধীরে ধীরে। সেখানে মিথের ভাঙ্গা গড়া চলে। চলে প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসরের স্মৃতি থেকে উঠে আসা পৌরাণিক সময়ের ইতিবৃত্ত। নিমেষে হাজার লক্ষ বছর যেন ধেয়ে এসে স্থবির আর অসার এক মৃতবত চেতনায় নিমজ্জিত করে ফেলে সোহানকে। বিছানায় একদম পেড়ে ফেলে ওকে।

আনন্দশংকর ততক্ষণে রক্তের প্রতিটি লহিত কণিকায় শিহরণ তুলেছে, প্রবল এক ঝাঁকুনিতে, তীব্র এক ধাক্কায় সোহান পিচঢালা রাস্তার কংক্রিটে আছড়ে পড়ে। এমন জীবন্ত অনুভূতি হয় যে ব্যথায় আহ আহ গোঙানী বেরিয়ে আসে সোহানের মুখ দিয়ে। পাশ দিয়ে সজোরে একটা টয়োটা ক্রাউন বেরিয়ে যায়!! হতচকিত সোহান নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে আর কোন নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারে না।

ঢাকা ধীরে ধীরে নির্দয় এক প্রেমহীন কংক্রিটের নগরে পরিণত হয়েছে। গাড়ির বনেটে রোদের যে চকিত প্রতিফলন আর উত্তপ্ত পিচ রাস্তায় কখনও কখনও ভীষণ ছলকে উঠা গাড়ির আয়নায় প্রতিফলিত রোদ, দূরে দূরে গাড়িগুলোর এক কাঁপা কাঁপা আলোক তরঙ্গের ভিতরে হুটহাট হারিয়ে যাওয়া হঠাৎ হঠাৎ যেন তেমনই এক পরাবাস্তব দৃশ্য উন্মোচিত করে। তবু যেন তেমন কোন রহস্য নেই,আজব!

সেই সমস্ত দৃশ্যকল্প তৈরী হয়েই আবার নিমেষেই হারিয়ে যায়। হারিয়ে যেতে যেতে কোথায় কোন টুকরো স্মৃতির ভগ্নাংশ হুটহাট কোথায় যেন কার ভিতরে ঢুকে পড়ে, কোনটা ঢুকে পড়ে অন্য কারও গল্পে, কোনটা অন্যের কবিতায়, কোনটা কবে কোথায় কোন অপরিচিত এক মেয়ে গভীর চোখে চেয়েছিল তার চোখের ভাষায়, এমন হাজারটা হয়ে নিজের অস্তিত্ব ধীরে ধীরে আমি থেকে আমরা হতে চায়। ভেঙ্গেচুরে শত টুকরো হয়ে ছিটকে পড়ে যত্রতত্র, কেবলই স্মৃতি, যেন আমরা আদতে স্মৃতিরই এক ধারাবাহিকতা।

রাতও বা কি তেমন আলাদা? একই হলদেটে সোডিয়াম বাতির নিচে ধুকতে ধুকতে এর গায়ে ও গা ঠেকিয়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে কি পায় এরা! কিসের এত গাল-গল্প? চারদিকে কেমন শুষ্ক এক হাহাকার আর অবিশ্বাস! যেন বা সকলে অপেক্ষমান কোথাও কিছু ঘটবে, অধীর আগ্রহে সকলেই কিছু একটার জন্য বসে আছে অনন্তকাল।

এমনি এক ঝিমুনি পরিবেশে সেলফোনটা বেজে উঠে, ভীষণ সেই কোলাহলের মাঝেই কেমন যেন এক অলৌকিক আর সুররিয়াল চিত্রকল্প রচিত হতে থাকে ওর অলক্ষেই। আকাশের আরও উপরে দু’একটা ছিটেফোটা তারা করুণ চেয়ে থাকে। এমন আদিগন্ত তীব্র আহবানে হতভম্ব হয়ে যায় সোহান। কোথা হতে আজ কোথায় চলেছে সে?

কে ডাকে এমন করে, কেন ডাকে? ও সমস্ত সব এখন তো কেবলই স্মৃতি, কোনটা মধুর কোনটা তিক্ত। তবু পিছু ছাড়ে না সেসমস্ত। চরিত্রগুলো ধীরে ধীরে অবয়ব পেতে থাকে এক এক করে, হুড়মুড়িয়ে কে কার আগে এসে দেখা দেবে তারা, যেন ভীষণ এক প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ।

মদ খাওয়ার ক্ষেত্রে সুমনের জুড়ি কমই ছিল। যেহেতু তার আকৃতিটা ছিল বেশ দশাশই সুতরাং সে খেতেও পারত অনুরূপ। তখন সোহানরা কি জানি কেন মদ, গাঁজা ইত্যাদি নেশার প্রতি তীব্রভাবেই আসক্ত হয়ে পড়েছিল। হয়ত সে সময়টাই ছিল দুঃসময়। কিশোর, তরুণ যারা দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম তাদেরকে ভেঙ্গে দেয়া মানে দেশের মেরুদন্ডটাকেই নষ্ট করে দেয়া। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের উঠে দাঁড়াবার, সৃজনের সেই প্রয়োজনীয় সময়টাতে একটা গোটা প্রজন্মের ভিতরে এ ধরনের ধ্বংসাত্মক অসুস্থতার প্রবেশ বহিঃশক্তির ও দেশীয় কিছু সুবিধাভোগীর কাজ বলেও পরবর্তীতে মনে হয়েছে সোহানের। অথচ সে সময় ওরা নেশায় বুদ, জীবনী-শক্তি দ্রুত ক্ষয়িষ্ণুতার দিকে নিয়ে চলেছে।

সে সময়ই আরও কিছু খুব কাছের বন্ধু বাহিরে চলে গিয়েছিল, বেশীর ভাগই হয় আমেরিকা, কেউ কেউ কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায়, ফলে এক ধরনের শূণ্যতা ও নিজেদের ব্যর্থতা সব মিলিয়ে এক দুঃসময়। ওরা কেবল ওদেরকেই আঁকড়ে ধরেছিল। সারাদিন নানাবিধ কল্পনার ফানুস, হেল্যুসিনেশন আর নিজেদের অবাস্তব পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন, দিনের ভাবনাগুলো এসমস্ততেই ব্যয় হয়ে যেত। ফলে বিকেল হলেই যে যেখানেই থাকুক জড়ো হত এসে এক জায়গায়। এবং ধারদেনা করে হলেও চেষ্টা চলত কিভাবে সেদিনের খোরাক জোগার হয়ে যায় এই ধান্দায়।

একবার সংগ্রহ হয়ে গেলেই ব্যস। জীবনের সমস্ত অর্জন যেন পাওয়া হয়ে গেল, যেন এতেই মোক্ষ, এমনই এক ঢুলুঢুলু গা-ছাড়া ভাব, কথাবার্তায় অসংলগ্ন জড়তা। নিতান্তই অভ্যাসে পরিণত হওয়া।

মনে আছে একবার সে আর সুমন একত্রে সিলেটে চলে গিয়েছিল, সেই যাওয়াটাই এক বিশেষ রকমের যাওয়া। পকেটে টাকা নেই, কিন্তু যেতে হবে এই জেদ ওদেরকে টেনে নিয়ে যায় স্টেশনে। এবং অদ্ভুত বিনা ভাড়ায় ট্রেনে উঠেও বসে তারা দুজনে, সিলেট পৌঁছে জুটে যায় সেরকম কিছু ছেলেমেয়ে, আড্ডায় গল্পে, কবিতায়, দূরন্ত সাহসে কেটে যায় দিন। লাঙ্গি (সিলেটের চা শ্রমিকরা বানায় এক ধরনের দেশী মদ) খেতে চলে গিয়েছে চা শ্রমিকদের আস্তানায়, এভাবে দুজনে বেশ কিছুদিন সিলেটে থেকে তারপর ঢাকায় ফিরেছিল। দুজনের কারও কাছেই টাকা পয়সা ছিল না, তবু কি করে যেন সুমন সব ব্যবস্থা করে। ওখানে থাকতেও খুব একটা সমস্যা হয়নি। বেশ ভালই ছিল, ঘুরে বেরিয়ে আর প্রচুর গাজা সেবন করে। এমনকি ঢাকায় ফেরার টাকাটাও যোগার হয়ে যায়। এদিকে দুজনের কারও বাড়িতেই কেউ কিছু জানে না তারা কোথায়, ফেরার পর সে নিয়ে আরেক চোট রাগারাগি এবং পরিবারের সকলের হতাশা।

তখন সময়টা ছিল স্বপ্নময়, কখনও কখনও রাতে হঠাৎ করেই মনে হলে চলে যেত কমলাপুর। সারারাত সেখানে মানুষ কিভাবে থাকে তা দেখার জন্য। যেমন ভাবা তেমনই কাজ, রাতের কমলাপুর অন্যরকম। সেখানে রাতজাগা ভবঘুরে মানুষের চলাফেরা। সেখানে বসে বসে স্কেচ করে রাত কাবার এবং এই রকম আরও সব অদ্ভুত খেয়ালী ইচ্ছা পূরণেই কেটে যেত সময়। একদিন সোহান অন্য আরেক বন্ধুর সাথে সারা রাত হাটার পরিকল্পনা করে, হাটতে হাটতে পুরোন ঢাকায় গিয়ে তারা পথ হারিয়ে একই জায়গায় চক্কর দিতে থাকে, পিছনে পিছনে একটি কুকুরও ওদের সঙ্গী হয়ে যায়। সেই নিঃশব্দ কুকুর এবং পথ খুঁজে না পাওয়া ওদের উপর এক অদ্ভুত চাপ সৃষ্টি করে। রাত হবে তখন ২টা, পুরোন ঢাকার প্রতিটি বাড়িই ঘুমে, মনে হচ্ছিল হঠাৎ তারা কোন এক মৃত নগরীতে চলে এসেছে, পিছনে এক ভুতুড়ে কুকুর!! সেই রাতের সেই অভিজ্ঞতা মনে পড়লে এখনও বড্ড কেমন যেন ঘোরের মত এক অনুভূতি হয় সোহানের। সম্ভবত কুকুরটিও আসলে সঙ্গ চাচ্ছিল ওদের!

কখনও বুড়িগঙ্গায় সারারাত কাটিয়েছে। নৌকায় চিত হয়ে শুয়ে মাঝ নদীতে ভেসে থেকে ঢাকার আকাশে তারা গুনেছে। সেখানে মাঝির কাছে গল্প শুনে শুনে সেটি লিখে রেখে বেহুলা লখিন্দরের কাহিনীর লোক-ভাষ্য টুকে রেখেছে। এরকম কত বিচিত্রভাবে সাধারণ ও প্রান্তিক জীবনের অনেক কাছে থেকে মানুষগুলোকে দেখে নেয়া সম্ভব হয়েছে তখন।

ভাবতে অবাক লাগে সেই বিভ্রম আর কুহক থেকে অনেকেই বেরিয়ে আসতে পারেনি। আজীবন জড়িয়ে ধরেছিল যা সত্য জেনেছিল সেই নেশাকেই। মৃত্যুর দিকেই নিয়ে চলে অমোঘ নীল দংশন, সৃজনের বাইরে দাড়িয়ে এ এক স্বপ্নীল আহবান। যদিও খুবই তীব্র সেই আকাংখা, শেষাবধি হয়ত সুমনকে সে তার নিজের গ্রাসে পরিপূর্ণ নিয়ে গেছে। সোহানের একটা সময় মনে হয়েছে সে যেন বড্ড মৃত্যুর কথা ভাবে। মৃত্যুর রঙ কেমন হবে, এর কি কোন গন্ধ আছে, এই সমস্ত। কেবলই কালির মত গভীর এক অন্ধকার, রাতের মত রহস্যময় কিছু একটা যেন ডেকে ফিরত। সে বয়সের রোমান্টিকতা নয় কেবল এটি, এতে যোগ হয়েছিল বিভিন্ন ধরনের নেশাজাত দ্রব্যের প্রভাবও। যা আদতে নেতির দিকে নিয়ে যেতে চায়।

একবার জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছে সোহান, সাথে স্বাধীন ছিল। তো সেখানে পুকুরে এক পেঁচাকে মরে পড়ে থাকতে দেখে সোহান আর স্বাধীন সেটিকে তুলে নিয়ে এসেছিল স্টাফ করবে বলে। কি সব আজগুবি কান্ড কারখানা, সেই পেঁচা কোথায় স্টাফ করা যায়? সে নিয়ে অনেক খোঁজাখুজি করার পর এলিফ্যান্ট রোডে স্বাধীনের কোন এক পরিচিত কার বাসায় দিয়ে আসা হল। সেখানে ডিপ-ফ্রিজে পেঁচাটাকে ঢুকিয়ে রাখা হয়। চার-পাচ ঘন্টা সেই মৃত পেঁচাটাকে নিয়ে তারা দুজনে ঘুরে বেড়িয়েছে!! ভাবা যায়?

নেশাতে পরিপূর্ণ নিমজ্জিত হয়েছিল সুমন। শেষাবধি জীবনও বিসর্জন দিয়ে গিয়েছে, ভালবাসার জন্য কি? জানা যায় নি সেসমস্ত উত্তর। জীবনের সাথে পরিপূর্ণ ভাবে জড়িয়ে থেকে সোহান তা বুঝতেও পারত না হয়ত, তবু এখন ভেবে আফসোস হচ্ছে এ নিয়ে সুমনের সাথে তর্ক তো করা যেত।

হারিয়ে গেল সুমন। আর কখনই দেখা হবে না সেই পরিচিত মুখের সাথে। শত ইচ্ছায়, চাওয়াতেও সুমনের বয়েই যাবে। পথে এখনও কখনও কখনও সুমনের চেহারার আদলের কাউকে দেখলে আচমকা চমকে উঠে সোহান। ভুল করে ডেকে উঠতে মনে হয়, ঠিক বিশ্বাস হতে চায় না যে সে অন্য কেউ!

কিছুই স্থির নয় জগতে, নয় কোন জীবন বা জড়। সে তুলনায় সুমনের অন্তর্ধান এমন কোন সাংঘাতিক বিষয় নয়। পৃথিবীতে ঢের বেশী গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রতিনিয়ত ছাপা হচ্ছে কাগজের পাতায় পাতায়, প্রচারিত হচ্ছে নানা মিডিয়ায় এবং ততোধিক সংঘটিত হচ্ছে চতুর্পার্শ্বে। তবু রাত দ্বি-প্রহরেরও পরে সুমন এমন চমক তুলে দমকা হাসে যে সোহান চমকে উঠে। মনে হয় সুমন যেন হালকা বিদ্রুপ করছে। সোহানের আপাত সাফল্যকে। বলতে চাইছে কি হবে রে বোকা এই সমস্ত করে? সেই তো আঁধারেই যাবি, সেখানেই ঠিকানা।

ভীষণ চমকে দেয় সুমন। ওর প্রানোচ্ছল আমুদে স্বভাবের মুখভঙ্গি সোহানকে আবিষ্ট করে রাখে। ওর মৃত্যু নিয়ে রহস্য ও জিজ্ঞাসা কিছুদিন ওদেরকে ভাবিয়ে রাখে, আর ভাবার মতই বটে। সোহান শুনেছে ওর লাশ নাকি পাওয়া গিয়েছিল যে হাসপাতালের পুকুরে সেখানে ও চিকিংসা গ্রহণের জন্য ভর্তি হয়েছিল। কারও কারও অভিমত টাকা শেষ হয়ে যাওয়াতে ও আত্মহত্যা করে থাকতে পারে কেননা শেষ দিকে ও হেরোইন আসক্ত ছিল বলে শুনেছে সোহান। কেউ কেউ দূর্ঘটনার কথা বলে, কারও কারও মস্তিষ্কে খুনের মত জটিল বিষয়ও খেলে যায়। তবু শেষ পর্যন্ত জানা হয় না সম্পূর্ণটা।

সুমনের মৃত্যুতে শোক করার মত তেমন কেউ ছিল না, সোহান শুনেছে ছোড়দি আর ওর বউ এসে নাকি ওর লাশ নিয়ে গেছে, সুমন যে বিয়ে করেছিল এটাই জানত না সোহান! সোহান এই মৃত্যুর কোনও ব্যাখ্যা পায় না, কোন মৃত্যুরই যদিও কোন ব্যাখ্যা হয় না, তবু এ বড় অপ্রত্যাশিত। সুমন কি মৃত্যুকেই ভালবেসেছিল? তবে ওর প্রেমিকা? এখন সোহান নিশ্চিত সুমন মূলত ভালবেসেছিল আত্মবিনাশের ‘নেশা’-কেই, কোন নারী বা বস্তুকে নয়!

রাত দ্বি-প্রহর বলেই পৃথিবীটা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে, তবু অন্ধকার এখনও নিশ্ছিদ্র হয়ে উঠেনি। গত ছ’দিনে সূর্য একবারের জন্যও দেখা যায়নি ঢাকার আকাশে, তারই ধারাবাহিকতায় মৃদুমন্দ বায়ুপ্রবাহে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ছাঁটে গভীর আকাশের খন্ডাংশ, এ্যাপার্টমেন্টের ধাতব শীতল নৈঃশব্দের ভিতর দিয়ে স্থির চেয়ে থাকে সোহানের দিকে। সোহান বিছানায় চিত হয়ে থেকে এক ফাঁকা দৃষ্টিতে ফ্যানের ব্লেডের দিকে চেয়ে থাকে। কেমন যেন নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারে না। ধাতব এক ধরনের যান্ত্রিক আবেগ যেন তাকে কিভাবে আন্দোলিত করছে নিজেই সে বুঝতে পারে না। দু’একটা ফ্ল্যাটে তখনও আলো জ্বলে, তীব্র হয় ঝিঁঝিঁর আর্তস্বর আর জেগে রয় পাশের এ্যাপার্টমেন্টে মোটরে পানি উঠার শব্দ! এতসব বাঙময়তার ভিতর সুমনের অস্তিত্ব মৃদু থেকে মৃদুতর হয়ে আসতে থাকে।

একসময় সুমন কেমন যেন সুদূরের হয়ে যায়। সোহান চায় না এমনটা হোক, আরও অন্তত কিছুক্ষণ স্মৃতিতে জেগে থাক সুমন। অথচ ক্রমাগত বিন্দুতে মিলিয়ে যেতে চায় সুমন।

পৃথিবীর এতবিধ সুন্দরের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আরও কোন ভিন্নতর প্রদোষে কি জেগে রইল সুমন? এসমস্তই মূর্তমান প্রশ্ন হয়ে বাতাসে ফিসফিস করে। স্মৃতির কার্নিশ থেকে সুমনও তারা খসার মত ভুস করে তলিয়ে যায়। মনে হয় রক এন্ড রোল নয়, জীবন নয়, নারী নয়, বিস্ময় নয়, সুমনের চেতনা আরও কোন তীব্রতর আকাংখাকে প্রত্যাশা করেছিল হয়ত। তার নাম কি তবে বিনাশ আর অন্ধকার? ফলে সেই বিনাশকেই ভালবেসে তাতেই শেষাবধি সমর্পিত হয় সুমন। কেবল স্মৃতিতে ওর হাসি সোহানকে বিব্রত করে রাখে কয়েকটা দিন।

মোহাম্মদপুর, ঢাকা
১৬ই সেপ্টেম্বর,২০০৪

প্রথম প্রকাশ: শিল্পকণ্ঠ, ঈদ সংখ্যা ২০০৯
পরবর্তীতে লেখক কর্তৃক পরিমার্জিত ও সম্পাদিত



সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২০ সকাল ৮:১৭
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ মিসড কল

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×