বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সপোর্ট ছাড়িয়ে একটু দূরেই ঢাকাগামী একটি বাসের প্রথম সিটে বসে বিড়ি ফুকছি। বাস পুরোপুরি ভরে উঠতে আরো ঘন্টাখানেক বাকী। হাতে হেগেলের ফিলসফি অফ হিস্টরি। কয়েক পাতা দাগানোর পর হঠাৎ থেমে যেতে হল, কারণ বাসের দরজার ওপার থেকে কুন্ঠিত স্বরের ডাক। প্রথমে ভাবলাম পরিচিত কোন বাস সহকারী, প্রায় সাথে সাথেই স্পষ্ট হল যিনি কুন্ঠিত হয়ে কিছু বলতে চাইছেন তিনি আমার পরিচিত কেউ নন। আমার কৌতুহল হল, আমি তাকে ডেকে এনে সিটে বসতে অনুরোধ করলাম। তিনি পূর্বের কুন্ঠাকে আরো বাড়িয়েই জড়সড় হয়ে সিটে বসলেন।
শাহীন বুয়েটের সোহরাওয়ার্দী হলে থালাবাসন মাজার কাজ করেন। হাতের গুচ্ছো টাকার দিকে তাকানোতে আরো জড়সড় হয়ে গেলেন। বললেন, বোনের বিয়ের যৌতুকের জন্য সাহায্য চাইতে এসেছেন। ৪ মাস আগে ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে জামাই পক্ষের ২২০০০টাকা যৌতুকের দাবী মেনে নিয়ে। বিয়ের সময়ই ১ম কিস্তি হিসেবে ১০,০০০টাকা বোনের শ্বশুড়কে দেয়া হয়েছে। এরপর নিজের আয় ও অন্যদের সাহায্য মিলিয়ে আরো ৭,০০০টাকা দেয়া হয়েছে। এখন বাকী আছে আরো ৫০০০টাকা, তিনি সেই টাকাটাই জড় করতে জাবিতে এসেছেন। এই টাকাটা জড় করাতে তার কুন্ঠা আছে, কিন্তু ‘শেইম’ নেই। কেন নেই? কারণ এখনো তিনি মহানগরের পঙ্কিল অবিশ্বাসকে ধারণ করার মত স্মার্ট হয়ে উঠতে পারেননি। বাবার উপর অভিমান করে ঢাকায় চলে আসা, কারণ গুরুর মাংসের কলিজা খাবার জন্য বেশি জেদ করার জন্য বাবা তাকে “শালা” বলে গাল দিয়েছিল। এরপর নাটোরে তার গ্রামের পরিচিত বুয়েট পড়ুয়া ভাইকে ধরে হলে থালাবাসন মাজার কাজ পাওয়া। বাড়ী পালানোর ৪মাস পর ২০০০টাকা নিয়ে বাড়ী ফেরা। বাড়ীর বড় ছেলের প্রত্যাবর্তনে বাবামা ভাইবোনের দারুণ আনন্দ। আবার ঢাকায় কাজ করতে চলে আসা। এবং এর ক’দিন পরেই জানতে পারা যে সবজী বিক্রেতা বাবা রাস্তায় হঠাৎ পড়ে আঘাত পাওয়ায় তার ডান অংশ ক্রমশ অবশ হয়ে যাচ্ছে। তখনি ৫০টাকা ভারা দিয়ে আরএম বাসের ছাদে করে গ্রামে ফেরা। ৭০টাকা দামের ইনজেকশন দেয়া, কিন্তু কোন ফল না পেয়ে কবিরাজ দেখানো, বাড়ীর একমাত্র খাসিটাকে বিক্রি করা। এসবে মোট ১৭০০টাকা খরচ এবং শেষ পর্যন্ত বসে যাওয়া বাবাকে আল্লাহর উপর ছেড়ে দাওয়া। ঢাকায় ফিরে আসা।
বোন আফরোজার বয়স ২৫, কেবল কিছু আরবী পড়তে পারেন। সামাজিক নিয়মেই বিয়ে দেয়ার চাপ। অনেক বিয়ের প্রস্তাব এলেও যৌতুকের কারণে না দিতে পারা। অবশেষে রাজমিস্ত্রী জামাই শফিকের সাথে বিয়ে পাকাপাকি। শ্বশুড়ের সাথে ২২০০০টাকা যৌতুকের চুক্তি। ঘটকালীর জন্য ঘটককে ৫০০টাকা দেয়া। এরপর বিয়ের খাবার খরচ গ্রামের মানুষজন মিলে দেয়া। খাবারের মেনু ভাত, গরুর মাংস, দুই পদের মিষ্টি। এর মধ্যে একপদ নাটোরের বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা।
সরকারী নিষেধাজ্ঞার জন্য বিয়ের সময় কাজীর কাছে কোনভাবেই যৌতুকের কথা না বলা। বোনজামাইয়ের শ্বশুড়ের সাথে ওয়াদা মোতাবেক শাহীনের মেয়াদের আগেই যৌতুকের টাকা পরিশোধের চেষ্টা। শাহীনের পরিবারে কেউ পড়ালেখা করনি, নিজের নাম লিখতে পারেন কিন্তু অক্ষর সাজাতে পারেন না, পড়তে পারেন না। বহুল ব্যবহারে বুয়েটের ছাত্রদের সাহায্য অনুলিপি ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে গেছে।
আলাপচারিতার ঠিক একই সময়ে ’জাবির’ মুখচেনা সান্তনা তার ২য় মেয়ের বিয়ের জন্য সাহায্য নেবার জন্য উপস্থিত। তাকে বসতে বললে তিনি বসেন না। তিনি জানেন এধরণের আজাইরা প্যাচালে তার অহেতুক অনেক সময় ব্যয় হবে, প্রয়োজনীয় টাকা পাওয়া যাবে না । শাহীন সেটা এখনো জানেন না। তখনো তাকে আমি টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দেইনি, তবুও মনের কথা বলার লোভে তিনি ধূর্ত নৃবিজ্ঞানীর জালে আটকা পড়ে গেছেন।
এদিকে আমি, তাকে কপট (এটা কপট নাতো কি? আমারে দিয়া তার কোন কামটা হবে?) আদর করে চা খেতে বললাম। তিনি কথা বলে চলেছেন এবং যানেন না তিনি কখন বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন।
একটাও তথাকথিত উপকারী এনজিও তার খবর পেলে, নারী অধিকার আর যৌতুক নিয়ে জ্ঞান/সচেতনতার ক্যাচাল শুরু করে দেবে। কিন্তু তার ২২০০০টাকা পূরণ করবে না।
আমি প্রশ্ন করলাম বিয়ের পর আপনি যৌতুক নেবেন না? তিনি সরলভাবে বললেন হ্যা নেব। আমি সেই টাকা হয়ত বউয়ের পিছনেই খরচ করব বা ব্যবসায় লাগাবো। তিনি আরো বললেন, যদি দেখি সেই পরিবারেও আমাদের মত অবস্থা তাহলে আল্লাহ মাফ করুন আমি কোন যৌতুক নেবনা। এখন পর্যন্ত বোন জামাইকে কেমন মনে হয়? শাহীনের উত্তর, ’প্রথম প্রথম তো সবকিছু নতুন, আমার বোনকেও তাদের ভাল লাগবে জামাইকেও আমাদের ভাল লাগবে। আসল বিষয় বোঝা যাবে ২/৩ বছর পর।“ এখন বোনের শ্বশুর বাড়ীর লোকজন যৌতুক নিয়ে কথাও বলেনা বা বোনকে অযত্নও করেনা। আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনার সময় শাহীন বা তার পরিবারের কারুরই আসলে নেই।
আমার কাজও প্রায় শেষ হয়ে আসছিল। নারী দিবসের একটা মেলোড়্রামাটিক পোস্ট আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। বাবার পক্ষাঘাতের চিকিৎসার বিষয়ে আমি তাকে সিআরপির ঠিকানা লিখে দিলাম। শাহীন বিনয়ে আর আগ্রহ নিয়ে আমাকে জিগ্গেস করল, ’এমন কোন জায়গা নেই যেখানে কোন টাকাই নেবেনা?’
আমাদের সদা সতর্ক মধ্যবিত্ত সত্তা আবেগী ঠগের হাত থেকে বাঁচার জন্য কত নিরন্তুর চেষ্টাই না করে। দলিত মানুষের উপর তার কি গভীর সন্দেহ। এমন নয় যে এসব বাস্তবে ঘটেনা। আমি নিজেই প্রাইমারি স্কুলের চাকুরী হারা শিক্ষক, বাবা মারা যাবার পর কাফনের কাপড় চাই, এ্যক্সিডেন্টে আহত চালক, মেয়ের বিয়ে দিতে পারছিনা এমন কত ঘটনারই সম্মুক্ষীণ হই। সাহায্য দেই, পরিমাপ করি, সতর্ক থাকি। শাহীন নিজেই বলেন যে আয়ের জন্য এমনটা যারা করেন, তাদের কারণে অনেক সত্যিকার সাহায্য প্রার্থী সাহায্য পাননা। এই সততা যতটা মধ্যবিত্তের সমস্যা ততটা সাহায্য প্রার্থীর নয়, এতে তার দূর্বল অবস্থান খারিজ হয়ে যায় না। এমনকি এই কাজ যদি তিনি পেট চালানোর জন্যই করেন।
শাহীনের গল্পটা অনেকদূরই হয়ত টানা যেত, অসতর্ক শাহীন সেদিকেই যাচ্ছিলেন। তাই তাকে মাঝপথে থামিয়েই আমি বললাম ’এবার উঠুন, দেখুন আরো কাছ থেকে সাহায্য পান কিনা। আমার পরিচিত ও বন্ধুদের অনেকে এগিয়ে এল।“
৩টাকার চা+ সাহায্য১০টাকা= ১৩টাকায় আমি শাহীনের কাছ থেকে নারী দিবসের পোষ্টটা কিনে নিলাম। শাহীন সেটা বুঝতেও পারলেন না।
(পোস্টে শাহীনের ছবিটা দিয়ে দিলাম, জানি না এর ভবিতব্য কি)
আলোচিত ব্লগ
হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে
তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না
সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন
লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা
ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।
মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না
নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন