somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নীলনদের কন্যা ডোরিয়া শফিক - আরবের নারী জাগরণের অগ্রদূত

০৪ ঠা জুলাই, ২০২০ রাত ৯:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি নিজেকে একজন নারীবাদী মনে করি । তবে আমার নারীবাদের সংজ্ঞা নিতান্ত আমার নিজস্ব । সেই সংজ্ঞায় ন্যুডিটি , পিরিয়ড় , স্যানিটারী প্যাড বা মেনস্ট্রুয়েশন ট্র্যাঁবুর ভাঙ্গার প্রাধান্য নেই বললেই চলে । আমার নারীবাদের সংজ্ঞা আমি যাকে দেখে পড়ে একটু একটু করে গড়ে তুলেছি উনি হলেন 'ডোরিয়া শফিক' (Doria Shafik) । অনেকে হয়তো এই মহীয়সী ঈজিপ্টসিয়ান রমণীর কথা কখনো শুনেননি । শুনলেও গা করেন নি । বাংলাতেও তাঁকে নিয়ে তেমন কোন লিখা নেই বললেই চলে । তাঁকে এরাবিয়ান নারী জাগরণের অগ্রদূত বলা হয় । তিনি আমাদের বেগম রোকেয়ার এরাবিয়ান ভার্সন ।
.

এই মহিয়সী রমনীটি গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । ছোট থেকেই তাঁর ছিলো অসাধারণ মেধা ও শক্তিশালী নেতৃত্বের গুণ । মাত্র ১৬ বছর বয়সে ফ্রেঞ্চ ব্যাচেলারেট ডিগ্রী অর্জন করেন । ১৯ বছর বয়সে ঈজিপ্টশিয়ান শিক্ষা মন্ত্রনালয় থেকে স্কলারশীপ পেয়ে পাড়ি জমান প্যারিসে । পি এইচ ডি করেন সাইকোলজিতে । সেখানে বিয়ে করেন আইনের ছাত্র ‘নুর আল দিন রাজাই'কে । এই সুদর্শন প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন পুরুষটি তাঁর মাঝে কি দেখতে পেরেছেন জানি না তবে পরবর্তী জীবনে একজন খ্যাতনামা আইন যোদ্ধা হয়ে ডোরিয়া শফিকের প্রতিরক্ষা শীল্ডে পরিণত হন ।
.

১৯৪০ সালে ডোরিয়া শফিক ফ্রান্স থেকে ইজিপ্টে ফিরে আসেন । তিনি দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তনে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার পদে যোগদানের ইচ্ছা ব্যক্ত করলেও তৎকালীন ডিন তাঁকে 'টু মর্ডান' বলে তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন । পরবর্তীতে তাঁর যোগ্যতা বুঝতে পেরে তৎকালীন কিং ফুয়াদের ১ম স্ত্রী শিবকিয়ার ইব্রাহিম (Shivakiar Ibrahim) তাঁকে দেশের অন্যতম প্রভাবশালী ম্যাগাজিন 'লা ফ্রেমে নুউভ্যালী' (La Femme Nouvelle) এর এডিটর ইন চীফ- এর পদ অফার করেন । যা ডোরিয়ার জীবন আমূল বদলে দেয় । তার উত্থান শুরু হয় এখান থেকে । তিনি ১৯৪৫ সালে বিনতে আল নীল বা নীলনদের কন্যা নামে একটি এরাবিয়ান ম্যাগাজিন চালু করেন । কালক্রমে এই নামটি (নীলনদের কন্যা) তাঁর উপাধিতে পরিণত হয় । এরাবিয়ান নারী জাগরণে এই ম্যাগাজিনটি নারীদের মুখপাত্র হয়ে উঠে । তৈরী হয় 'বিনতে আল নীল' ইউনিয়ন ।
.

১৯৫১ সালে তিনি এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটান যা তৎকালীন কোন মুসলিম রাষ্ট্রে কেউ কখনো দেখেনি । তিনি গোপনে বিনতে আল নীল ইউনিয়ন ও ঈজিপ্টশিয়ান ফ্যামিনিস্ট ইউনিয়নের ১৫০০ সদস্যকে একত্র করে হঠাৎ ইজিপ্টশিয়ান পার্লামেন্টের দিকে মার্চ করা শুরু করেন । পুলিশী বাঁধা অতিক্রম করে তারা পার্লামেন্ট ঢুকে ৪ ঘন্টার জন্য অধিবেশন অচল করে রাখেন । ঈজিপ্টশিয়ান নারীদের আর্থ সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রচলিত বহুবিবাহ ও তালাক সংক্রান্ত পুরানো আইন সংশোধনে পার্লামেন্টকে বাধ্য করেন । পার্লামেন্ট অবমাননার দায়ে তাঁকে আদালতে হাজির হতে বলা হলে তিনি পুরো বিনতে আল নীল ইউনিয়ন কর্মীদের নিয়ে আদালতে হাজির হন । অবস্থা বেগতিক দেখে আদালত মুলতবী ঘোষিত হয় । পরবর্তীতে ঈজিপ্ট সরকার তাঁর দাবী মেনে নেয় ও আরোপিত অভিযোগ তুলে নিলে কায়রোর অচলাবস্থার নিরসন হন । সেই বছরই তিনি ব্রিটিশদের তাঁদের মাটি থেকে বিতাড়িত করতে দেশের/আরবের প্রথম ফিমেইল মিলিশিয়া ইউনিট গড়ে তুলেন এবং সরকার কর্তৃক তাঁর 'বিনতে আল নীল' পলিটিক্যাল পার্টি হিসেবে অনুমোদন পায় ।
.

তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় ঈজিপ্টশিয়ান মহিলাদের ভোট দেওয়ার যোগ্য বলে বিবেচনা করা হতো না । তাই ১৯৫২ সালের বিপ্লবে রাজতন্ত্রের উৎখাত পরবর্তী সংবিধান প্রনয়ন কমিটিতে কোন নারীর স্থান দেওয়া হয়নি । নীল নদের কন্যা এবার এখানে আঘাত আনলেন । দলবল নিয়ে শুরু করলেন অনশন । যা ব্যাপক মিডিয়া কাভারাপ পায় । পুরো পশ্চিমা মিডিয়া ফালাও করে তা প্রচার করে । জাতিসংঘ থেকে চাপ বাড়তে থাকে ঈজিপ্টের প্রথম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাগিবের উপর । অনশন শুরু করার ৮ দিন পর প্রেসিডেন্ট নাগিব লিখিতভাবে তাঁদের দাবী মেনে নেন । ১৯৫৬ সালে সংবিধান রচিত হয় । ঈজিপ্টশিয়ান নারীরা ভোটাধিকার পায় ।
.

এই ঘটনা তাকে ক্ষমতার শীর্ষে তোলার পাশাপাশি সারা বিশ্বে পরিচিতি এনে দেয় । তাঁকে তৎকালীন নারীদের আইকন মানা হচ্ছিল । ইজিপ্টশিয়ান নারীদের বিষয়ে লেকচার দিতে বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রণে তিনি বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ট্যুরে যান । তিনি পাকিস্তান ও ভারতে আসেন । ফাতেমা জিন্নাহ ও নেহেরুর সাথে দেখা করেন । তবে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে এসেছিলেন কিনা জানা যায় না ।
.

এর মধ্যে প্রেসিডন্ট মুহাম্মদ নাগিবকে গৃহবন্দী করে ক্ষমতায় আসেন ইজিপ্টশিয়ান লৌহমানব জামাল আবদেল নাসের । ডোরিয়া শফিকের হাতে পড়ে নাগিব কিভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছিল তা লৌহমানব জামাল আবদেল নাসেরের জানা ছিল । তিনি ডোরিয়া শফিকের টুটি চেপে ধরার সুযোগে ছিলেন । ডোরিয়া শফিকও তাকে নাগিব মনে করে ভুল করলেন । ১৯৫৭ সালে ডোরিয়া তার ডিক্টেটরশীপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর এক পর্যায়ে অনশন শুরু করেন । আর্মি এসে তাঁকে গ্রেফতার করে । তাঁকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলাতে চাইলেও পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক মহলের কারণে তাঁকে গৃহবন্দী করা হয় । প্রেসে তাঁর সর্ম্পকে কোন তথ্য প্রকাশ কিংবা তার নাম পর্যন্ত প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় । ‘বিনতে আল নীল’ পার্টি যেটি কিনা সামান্য ম্যাগাজিন থেকে ইউনিয়ন, ইউনিয়ন থেকে রাষ্ট্রীয় পার্টিতে পরিণত হয়েছিল, সেই পার্টিকে নাসের ধুঁলোয় মিশিয়ে দেন । যেখানে ডোরিয়া শফিকের নাম পাওয়া গেল মুছে দেওয়া হল । তার সমর্থকরা গুম হলো । এইভাবে প্যান এরাবিজমের প্রবক্তা জামাল আবদেল নাসের নারী অধিকারের কন্ঠরুদ্ধ করে দিয়েছিলেন ।
.

১৯৭৫ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ডোরিয়া শফিক গৃহবন্দী ছিলেন । দীর্ঘ ১৮ বছরের গৃহবন্দীর সময় ডোরিয়া শফিক কবিতা উপন্যাস সাহিত্য নিয়ে প্রচুর লিখালিখি করেন । যা তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশ পায় ।১৯৭০ এ নাসেরের মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট হন নাসেরের শিষ্য তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট আনোয়ার আল সাদাত । ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নাগিবকে গৃহবন্দী হতে মুক্তি দিলেও ডোরিয়া শফিককে মুক্তি দেওয়ার সাহস করেননি । বলা হয় দীর্ঘ ১৮ বছরের গৃহবন্দী জীবনে তাঁকে চরম একাকিত্বের মধ্যে যেতে হয়েছে । তাঁর স্বামী ও দুই কন্যাকে ঠিকমত দেখতে দেওয়া হয়নি । নাসের সরকার তার মনোবল ভাঙ্গতে তার স্বামী নূর আল দীন রাগাইকে তাঁর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদে বাধ্য করেন । তখন থেকেই মূলত তিনি ক্রমে ভেঙ্গে পড়তে থাকেন । ১৯৭৫ সালে আর্ন্তজাতিক মহল আনোয়ার সাদাতের উপর ডোরিয়া শফিককে ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে ঠিক তখনই ডোরিয়া শফিক বারান্দা থেকে পড়ে যান ! অনেকে বলে আত্মহত্যা করেন ! আসলেই কি হয়েছিল তা কেউ জানে না ।
.

এই হলো একজন প্রকৃত নারীবাদীর জীবনী । নারী জাতির প্রতি সম্মান রেখেই বলছি- যে নারী আর্থ সামাজিক ব্যবস্থায় নারীর প্রতি বৈষম্যতা , দারিদ্রতা , জাস্টিস সিষ্টেমে নারীর যোগদান ,নারী সাক্ষী সংক্রান্ত জটিলতা , যৌন হয়রানী , নারী দেহকে পণ্য বানানোর মত বহু মহত্ত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে শুধু স্বল্প বাসনার রাইটস নিয়ে পড়ে থাকে সে আর যাইহোক আমার সংজ্ঞায় নারীবাদী নয় ।
.

২০১৬ সালে গুগল ডোরিয়া শফিকের ১০৪ তম জন্মবাষির্কী নিয়ে একটি 'ডুডল' (DOODLE) করে । তখনই তাঁর সর্ম্পকে প্রথম জানতে পারি । আকুন্ঠ শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এই মহিয়সী নারীর প্রতি ।


.
তথ্য সুত্র- ইন্টারনেট জগত
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:২৬
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×