বাংলাদেশ থেকে ৩৬ জন মানুষ বিমান ভাড়া করে ভারত গেছে বাহুবলি ২ নামে একটা সিনামা দেখার জন্য।যে ৩৬ জন গিয়েছেন তারা হেঁজিপেঁজি কেউ না। আসলে হেঁজিপেঁজি কারো পক্ষে সম্ভবও না বিমান ভাড়া করে ভারত গিয়ে সিনামা দেখা। তাদের সামর্থ আছে তারা তাদের টাকা খরচ করে গিয়েছেন। ব্যাপারটা কি শুধুই তাই? আমার টাকা থাকেলেই সম্ভব যা ইচ্ছা করার?
তারা শুধু টাকার মালিক হলে সমস্যা ছিল না।তাদের মাঝে বেশ কয়েকজন আমাদের সংস্কৃতির রীতিমত হর্তাকর্তা। একজন টিভি চ্যানেলের মালিক,যিনি হৃদয়ে বাংলাদেশ নিয়ে ঘুরেন। সমস্যা হচ্ছে এখানেই। যাদের কে আপনি আদর্শ মানবেন তারা যদি বিমান নিয়ে ভারতে রউনা দেয় সিনামা দেখার জন্য তাহলে একটু তো থমকে যেতেই হবে আপনাকে।যখন হিন্দির আগ্রাসন আমাদের কে দিশাহারা করে দিচ্ছে, যখন ভারতীয় সংস্কৃতি লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে আমার আপনার ড্রয়িং রুম থেকে বেডরুম তখন যদি দেখতে পাই আমার প্রিয় অভিনেতা চলছেন হিন্দি সিনামা দেখতে বিমান ভাড়া করে তখন তো মাথা একটু এলোমেলো হওয়াটাই স্বাভাবিকই।
আফজাল হোসেন এর পক্ষে বিশাল বড় এক লেখা লিখেছেন।উনার বক্তব্য পড়ে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। তিনি প্রথমেই ভাল মন্দের কথা বলেছেন। তার বক্তব্য হচ্ছে “ আমরা খুব ভালোতে বিশ্বাসী। ভাবখানা এমন, মন্দে আমাদের মোটেও মন নেই। খুবই খাঁটিজন আমরা। আমরা মন্দ বলি না, করি না, ভাবিও না। এত ভালোগিরি দিয়ে লাভের খাতা কতটা ভারী হয়েছে, আর লোকসানের পরিমাণ কত, তা ভেবে দেখা হয় না।”
উনি কি বলতে চাইলেন তা আমার বোধগম্য হয়নি। উনি যে খোঁচা দেওয়ার চেষ্টা করলেন তার মানে কি? আমরা কি তাহলে মন্দ কে মন্দ বলব না?কি জানি? তেনারা জ্ঞানী গুনি মানুষজন!!!
উনি বিস্তর বর্ননা করেছেন। কত ভাল একটা ছবি, কত মজা উনারা করেছেন, সামর্থ্য থাকলেও যে সবাই এমন একটা মহৎ(!) কর্ম করতে পারেন না বা এই ছবি দেখতে উনারা যাওয়াতে বাংলাদেশ কি ভাবে উপকৃত হতে পারে তা তিনি চমৎকার ভাবে বর্ণনা করেছেন। বাংলাদেশ কিভাবে উপকৃত হবে ভেবে পাচ্ছেন না? আমিও পাই নাই, তবে তিনি তা নিয়ে কোন রহস্য করেন নাই। খুলেই বলেছেন গোপন কথা। তিনি বলেছেন ফরিদুর রেজা সাগর এ রকম একটা ছবি এবার বানাবেন। যেহেতু তিনি বাংলাদেশে অনেক কিছুই প্রথম করেছেন তাই এই মহান চলচিত্রও তিনিই বানাবেন বলে আফজাল হোসেন আশাবাদ ব্যাক্ত করছেন। আমরাও আশায় বুক বেঁধে বসে পড়লাম বস্তাপচা কিছু একটা যে উনি প্রসব করবেন সামনে সেই আশায়।
এর আগে অন্য কোন সিনামা দেখে আফজাল হোসেন বা ফরিদুর রেজা সাগর সাহেবের মনে হয় নাই যে এমন একটা ছবি বাংলাদেশে বানানো উচিৎ। তাদের এই ছবি দেখেই মনে হয়েছে।বিশ্ব চলচিত্রে এ ধারার ছবি আর তৈরি হয়নি? নাকি বিশ্ব রেকর্ড সব ভেঙ্গে ফেলেছে এই ছবি? ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই -গত বছর দা সিক্রেট লাইফ অফ পেটস নামে একটা মুভি মুক্তি পেয়েছিল। মোটামুটি চমৎকার একটা সিনামা ছিল এই অ্যানিমেশন মুভিটা।৭৫ মিলিয়ন ইউএস ডলারে তৈরি বাণিজ্যিক ভাবে সফল এই ছবি মোট আয় করে ৮৭৫.৫ মিলিয়ন ইউএস ডলার। এত বিপুল ভাবে হিট হওয়ার পরেও সর্বকালের সর্বোচ্চ আয় করা সিনামার তালিকায় এই ছবির স্থান ৫০তম!!এর আগের ৪৯ টা সিনামার নাম বা এই তালিকার ১ নাম্বার সিনামার আয়কৃত অর্থের হিসাব আর দিলাম না। তার মনে হয় প্রয়োজনও নাই, আপাতত ৮৭৫.৫ মিলিয়ন ডলারে কত রূপি হয় সেই হিসাব করতে থাকুন যারা ভাবছেন সব বোধহয় শেষ করে ফেলেছে বাহুবলি।খুব ভাল হ্ত যদি বাহুবলির মত ছবি না বানাতে চেয়ে নীল বাট্টি সান্নাটার মত একটা ছবি বানাতে চাইতেন, যদি পিংকের বক্তব্যটা দেশবাসির জন্য উপহার দিতেন।
আমি বাহুবলি খারাপ না ভাল তা কিছুই বলছি না।হয়ত ভাল ছবি। ভারতীয় ছবির মাপে এই ছবি যে একটু অন্য মাত্রার তা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তারপরেও এটা একটা ভারতীয় ছবিই এর চেয়ে বেশি কিছু কি? তাদের উম্মাদনা থাকতে পারে, এতে আমাদের পাগলের মত আচারনের কারন কি থাকতে পারে? যখন আমাদের দেশের পরিচালকরা হিন্দি ছবির বলয়ে ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে আজো তখন বাহুবলি দেখতে আফজাল হোসেনের মত ব্যাক্তিত্বের বিমান নিয়ে সিনামা দেখতে যাওয়া আমাদের কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে? কাল কে যে পরিচালক ভিন্ন কিছু করার কথা ভাবছিল সে যে পাঁচটা গান,ঢিসুম ঢাসুম আর গ্রাফিক্সের সাহায্যে পাহাড় পর্বত নদী নালা অনায়ায়েসে টপকে যাওয়ার দৃশ্য বানিয়ে মহান চলচিত্র বানিয়েছে ভেবে বসে থাকবে না তার নিশ্চয়তা কি? আপনারা যে সব্বাই কে হিন্দি ছবির দিকে প্রবল উৎসাহে ঠেলে দিলেন সেই খেয়াল কি করেছিলেন একবারের জন্য?
বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া এক ভারতীয় চিত্র পরিচালকের একটা কথা শেয়ার করে শেষ করি, “ আমি প্রতি মুহূর্তে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে বোঝাব যে, ইট ইজ নট এন ইমেজিনারি স্টোরি বা আমি আপনাকে সস্তা আনন্দ দিতে আসিনি। প্রতি মুহূর্তে আপনাকে হাতুড়ি মেরে বোঝাব যে যা দেখছেন তা একটা কল্পিত ঘটনা, কিন্তু এর মধ্যে যেটা বোঝাতে চাইছি আমার সেই থিসিসটা বুঝুন, সেটা সম্পূর্ণ সত্যি, সেটার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই আমি আপনাকে এলিয়েন্ট করব প্রতি মুহূর্তে। যদি আপনি সচেতন হয়ে ওঠেন, ছবি দেখে বাইরের সেই সামাজিক বাধা দুর্নীতি বদলের কাজে লিপ্ত হয়ে ওঠেন, আমার প্রোটেস্টাকে যদি আপনার মধ্যে চাপিয়ে দিতে পারি তবেই শিল্পী হিসেবে আমার সার্থকতা।” বাহুবলি কোন ম্যাসেজ নিয়ে তৈরি যা আমাদের সমাজের রন্ধ্রে গিয়ে আঘাত করবে? যা বিমান ভাড়া করে দেখে এসে আমার দেশে বানানোর উপায় খুঁজতে হবে?
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০১৭ রাত ১:১৫