১৯৫২ সালে আর্জেন্টিনার দুই যুবক ঠিক করল তারা ল্যাটিন আমেরিকা ভ্রমণ করবে।ভ্রমণ শুরু হবে বুয়েনোস আইরেস থেকে। আন্দিজ থেকে চিলি, সেখান থেকে পেরু,পেরু থেকে কলম্বিয়া, তারপর ভেনিজুয়েলা গিয়ে শেষ করার প্লান দুই যুবকের। ভ্রমনে তাদের নীতি হবে ইম্প্রভাইজেশন।তাদের বাহন হচ্ছে সিঙ্গেল সিলিন্ডার ১৯৩৯ নরটন ৫০০ সিসি মোটর সাইকেল, তাদের ভাষায় “দা মাইটি ওয়ান” !!
তাদের ইচ্ছা চার মাসে ৮০০০ কিলোমিটার ভ্রমণ করা। দুই জনের মধ্যে মূল চালক,যিনি একজন বায়ো কেমিস্ট, তার ইচ্ছা তার ৩০তম জন্মদিনে ভ্রমণ শেষ করা। কো পাইলট হিসেবে আছেন অন্য বন্ধু যিনি মেডিকেলের ছাত্র,কুষ্ঠ রোগে যার বিশেষজ্ঞতা,যার আর একটা সেমিস্টারই বাদ আছে ডাক্তারি পড়াশোনার।যিনি অপেশাদার রাগবি খেলোয়াড় আর অকেশনাল অ্যাজমা রোগী!! তাদের ইচ্ছা যে ল্যাটিন আমেরিকাকে শুধু বই পত্র দিয়ে চেনে তারা তা নিজের চোখে দেখা, বৃদ্ধ হয়ে রেস্টুরেন্টে বসে ঝিমিয়ে জীবন শেষ করার ইচ্ছা তাদের নাই।
এই রকম পাগলাটে ভ্রমণ প্লান করা দুই বন্ধু একদিন সত্যি সত্যি ভ্রমনে বের হয়ে গেল। এবং ভ্রমণ করে ফেলল ৮০০০ কিলো মিটারের জায়গায় প্রায় ১২০০০ কিলোমিটার। চার মাসের জায়গায় সময় লেগে গেল প্রায় এক বছর। তাদের মাঝে শিক্ষানবিশ ডাক্তার যিনি তিনি এই ভ্রমণ কাহিনী তার ডাইরিতে লেখে ফেললেন। আর পৃথিবী পেল এক ঐতিহাসিক ভ্রমণ কাহিনী যা যে কোন সময়ের জন্যই বিরল।আর এই ভ্রমনের পরেই বদলে গেল নাম না জানা ওই যুবকের জীবন।জন্ম নিল কিংবদন্তী মার্ক্সবাদী এক গেরিলার। যার নাম ছিল এর্নেস্তো গেভারা ডে লা সেরনা এবং পরবর্তীতে যাকে পৃথিবীবাসী চিনেছে এক নামে - চে গুয়েভারা।
চে গুয়েভারা আর তার বন্ধু আলবের্তো গ্রানাদোর সেই ভ্রমনের উপরে লেখা চে’র লেখা দিয়ারিওস দি মোতোসিক্লেতা বা দা মোটর সাইকেল ডাইরিস নিয়ে ২০০৪ সালে ব্রাজিলের পরিচালক Walter Salles তৈরি করেন স্প্যানিস ভাষায় এক সিনাম দা মোটর সাইকেল ডাইরি নামেই।মেক্সিকান প্রতিভাবান অভিনেতা গেল গার্সিয়া বের্নাল চে গুয়েভারার চরিত্রে আর রডরিগো দে লা সেরনা আলবার্তো গ্রানাদোর চরিত্রে অভিনয় করেছেন।দুই জন অভিনেতাই এত দারুন অভিনয় করেছে যে মনে হবে সত্যি যেন ৫২ সালের দুই ক্ষ্যাপা যুবক যেন তারা।
পরিচালক ল্যাটিন আমেরিকার সৌন্দর্য কে সেলুলয়েডে তুলে এনেছেন চমৎকার ভাবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ল্যাটিন আমেরিকা কে আমাদের চোখের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছেন তিনি। আর হচ্ছে এই ছবির সংলাপ। এক কথায় অসাধারণ। যেহেতু সরাসরি চে’র ডাইরি থেকেই এই ছবি বানানো হয়েছে তাই এর আসল কৃতিত্ব দিলে চে কেই দিতে হয়। রসবোধে পরিপূর্ণ দুই বন্ধুর কথাবার্তা ছবির প্রাণ বলা যেতে পারে।
দক্ষিন আমেরিকার মানুষের দুঃখ কষ্ট চলে এসেছে অবধারিত ভাবেই। যে দুঃখ কষ্ট গুলাই চে’র জীবন কে পরিবর্তন করে দিয়েছিল। মানুষের জন্য কিছু করার তীব্র স্পৃহা তৈরি হয় তার।আর যার ফলেই জন্ম নেয় এক নয়া ইতিহাসের।
শুধু এই ছবি বা তার লেখা ডাইরি পড়ে চে কে বোঝা সম্ভব না। তারপরেও চে’র চরিত্র সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা পাওয়া যে যাবে তা বলা যায় কোন সংশয় না করেই। নিজের জন্মদিনে কুষ্ঠ রোগীদের সাথে থাকার জন্য নৌকা না পেয়ে রাতের উত্তাল নদী সাঁতার দিয়ে পার হওয়ার মাঝে ফুটে উঠে অনেক কিছু।ফুটে উঠে ভবিষ্যতের এমন এক নেতার চরিত্র যে শুধু মাত্র মানুষের জন্য।
চে’র চরিত্র ব্যাখ্যা করা আমার জন্য দুঃসাধ্য কাজ। সেই চেষ্টাও করব না আমি। সিনামা হিসেবে এই ছবি যে অতি উচ্চ মানের তা বলা যায় সহজেই। পরিচালনা, অভিনয় বা দৃশ্যায়ন সব মিলিয়েই এক মনমুগ্ধকর সিনামা দা মোটর সাইকেল ডাইরি।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০১৭ দুপুর ১২:৩৬