পাঠ প্রতিক্রিয়া লেখা আগে বই থেকে কয়েকটা লাইন বর্ণনা করি। কি জিনিস নিয়ে কথা বলছি বুঝতে সহজ হবে।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়দের বাড়িতে বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে দুইজন লোক এসেছে। তারা এবং তৎকালীন গ্রামিন সমাজ কোথায় ছিল তার নমুনা লেখক দিয়েছেন এভাবে -
“বাবা যে বঙ্গোপসাগরের তীরে পৃথিবীর কি আদিম জায়গা থেকে আদায় করে ফিরতেন তা আজ বুঝি। পর দিন ঘুম ভেঙ্গে উঠে হাসিম আর দবির তনুদাকে ছাদে দেখে অবাক। বারবার জানতে চাইল, ওখানে কি করে উঠা যায়?
ওদের অবাক হওয়ায় আমরা অবাক।
মা বলল, কেন? মই দিয়ে উঠছে তনু!
একতলা বাড়ির ছাদে উঠার কোন সিঁড়ি ছিল না।
আমাদের এট্টু ওঠাবেন?
ওঠানো হল। উঠে কি হাঁসি সারা মুখে দুজিনের!
ওপর থেকে পৃথিবীর পুকুর, গাছপালা, মানুষ, বিড়াল, সজনে গাছ দেখতে পেয়ে আনন্দ আর ধরে না ওদের। ওখান থেকেই দবির ভাই বলল, বিকালেও এট্টু ওঠব।
মা বলল, বেশ তো।
কিন্তু বিকালে আর ছাদে উঠা হল না। কেননা তার আগেই ওরা পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য আবিস্কার করে বসে আছে।
বাবার বিয়ের ডিম ডিম চেহারার একখানা পারা- ওঠা আয়না। দাদামশায় দিয়েছিলেন। সেখানায় নিজের মুখ দেখে হাসিম ভাই গম্ভির হয়ে জানতে চাইল, ওডা কেডা?
দবির ভাই পাসে ছিল। সে এগিয়ে বলল, কই? দেখি?
মা বলল, বারান্দায় নিয়ে গিয়ে দ্যাখো।
আয়নাখানা বারান্দায় নিয়ে গিয়ে ওরা তো অবাক ! আয়নার পিছনে তো কেউ নেই ! তাহলে?
তনুদা - আমি - আমরা তো আরও অবাক।”
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত আত্মজীবনী “জীবন রহস্য” থেকে উপরের লাইন গুলো দিলাম। আত্মজীবনী লেখার ক্ষেত্রে বাঙালি নাকি ফেরেশতার হাতে শয়তানের আত্মজীবনী লেখে। আমার কথা না হুমায়ুন আজাদের কথা। জীবন রহস্যে লেখক কিন্তু তা করেন নাই। নিজেকে নিয়ে বা নিজ পরিবার নিয়ে এমন ব্যাঙ্গ করা সোজা কথা না। শিবরাম কে দেখেছি আর শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কে দেখলাম। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তার আত্মজীবনীতে নিজেকে এক ফোটা ছাড় দেন নাই। যা ঘটনা তাই লিখেছেন তার বইয়ে। নিজের বাবা ঘুষ খান তা স্বীকার করে নিয়েছেন প্রথমেই। এবং কিভাবে খান, এর তরিকা কি তাও এক বিস্তর ব্যাপার। উনার মা যে ঘুষের টাকা রাখার জন্য জামায় আলাদা কর পকেট বানিয়ে দিয়েছিলেন তাও তিনি বলে গেছেন অকপটে।
বাংলাদেশের খুলনা জেলায় জন্ম। অনেক ভাই বোনের মাঝে তিনি একজন। তিনি বইয়ে উল্লেখ্য করেন নাই যে উনারা কয় ভাই বোন। কিন্তু এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন যে বুঝা যায় তা নেহায়েত কম না। আশ্চর্য পরিবারের গল্প যেন সিনামার মত করে বলে গেছেন লেখক। গ্রামিন সমাজের কথা যেন চোখের সামনে জীবন্ত করে এনে ফেলেছেন।
দেশ ভাগ হওয়ার সময় কলকাতা এসে পরেছেন । দেশ ভাগের তীব্রতা অতটা পরে নি উনার জীবনে। মোটামুটি ঝামেলা ছাড়াই মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন দেশ ভাগ। বড় ভাই আগে থেকেই কলকাতায় থাকার ফলে উনারা এই সুবিধা পান।
কি নাই উনার এই আত্মজীবনীতে? তৎকালীন সমাজের কথা তো বললামই। ইতিহাস আছে আর আছে হিউমার। প্রতি লাইনে লাইনে উনার হিউমারের ছড়াছড়ি। নিজেকে নিয়ে বা অন্য কে নিয়ে, জটিল কথা হাস্যরসের মাধ্যমে এমন ভাবে বলেছেন যে পাঠক দ্বিধায় পরে যাবে হাঁসা উচিত নাকি কাঁদা? রূঢ় বাস্তবতা কে তুলে ধরেছেন ব্যাঙ্গের মাধ্যমে। আর পুরো আত্মজীবনী জুড়ে আছে জীবনের কথা। রসিকতার ছলে জীবনের কুৎসিত দিকের কথা বলে গেছেন অম্লানে। যা আমাদের কে বারবার ভাবায়, বারবার প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায়।
আগা গোঁড়া চমৎকার একটা বই জীবন রহস্য। কখনো পেটে খিল ধরে যাবে পড়তে পড়তে। কখনো হতভম্ব হয়ে যেতে হবে জীবনের রসিকতা দেখা। বইয়ের একটা সমস্যা মনে হয়েছে লেখক আরও বড় পরিসরে লেখার নিয়তে বসে ছিলেন কিন্তু যে কারনেই হোক তিনি একদিন ভেবে দেখলেন অনেক লিখে ফেলেছি, আর কত! হুট করে শেষ করে দিলেন উনার জীবনী। ঠিক হুট করে না, মাঝামাঝি পর্যায় থেকেই হঠাৎ শেষের দিকে হাটা শুরু করে দিলেন। কলকাতায় উনার পরিবারের বর্ণনা বিশেষ করে উনার বাবার কথা নাই বললেই চলে। যে মেয়ের কারনে উনি দুই দিন অন্যের বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে কাজ করেছেন তার কথা আর কোথাও খুঁজে পেলাম না। তারপরেও জীবন রহস্য নিঃসন্দেহে চেটেপুটে খাওয়ার মত একটা বই। একবার না বারবার পড়ার মত বই জীবন রহস্য।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ২:০৪