বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম ডানহাতের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। মায়ের কাছ থেকে শুনেছি আমিও আর সবার মত দুই হাত দুই পা নিয়েই সুস্থ্য স্বাভাবিকভাবেই জন্মগ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু জন্মের ছয়মাসের মাথায় কি এক জ্বরে আমার শরীরের ডান পাশ অকেজো হয়ে যায়। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই অনুভব করেছি ডান পা টা কিছুটা কাজ করলেও ডান হাত একেবারেই আমার না। এই হাত আমার চলার পথে কোন কাজে আসবেনা। আমাকে নিয়ে মায়ের চিন্তার শেষ নেই, কিভাবে আমি চলব, আমি কি স্বাভাবিক লাইফ লিড করতে পারব, বিয়ে হবে তো আমার, এরকম আরও অনেক দুশ্চিন্তা নিয়ে মায়ের মাথা যখন পুরো এলোমেলো তখন প্রতিবেশী কাকী এসে মাকে বুদ্ধি দিলেন বাম হাত দিয়ে লেখানোর চেস্টা করাতে। মাও আর দেরী করলেননা সাথে সাথে বড় বোনের চক শেলেট দিয়ে আমাকে লেখানোর চেস্টা করলেন। এইবার মা আমার বেজায় খুশি, যা শিখাচ্ছেন তাই আমি পারছি। এভাবেই আমার জীবন শুরু হয়েছিল। আস্তে আস্তে সবকিছুই এক হাত দিয়ে করতে শিখে গেলাম, পাশে ছিল মা আর বড় বোন। ছোট খাট কিছু কাজ যেমন বাম হাতের নখ কাটা, চুল বাধা কিংবা ওড়নাতে সেফটিপিন মারা এরকম কিছু কাজ ছাড়া বাকি সবই আমার আয়ত্তে চলে এসেছিল এতদিনে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রথম সমস্যায় পরি চুল বাধা নিয়ে, কে বেধে দিবে। মামার বাসায় ছিলাম প্রথমে, মামী চাকরি করেন সকালে তার অফিস যাওয়ার তাড়া থাকে তাই ইচ্ছা থাকলেও তিনি সবসময় পারেননা, মামাতো বোন সকালে ঘুমে থাকে, ঘুম থেকে তুলে রোজরোজ চুল বাধার জন্য বলতে ভালো লাগতোনা। বাড়িতে বসে কখনো এই চুল বাধা নিয়ে ভাবতে হয়নি কারণ হয় মা নাহয় বড় আপু এগুলো করে দিতেন। এই প্রথম অনুভব করলাম আর একটি হাতের। মামাত বোনের পরামর্শে একদিন পার্লারে যেয়ে কোমড়ে সমান চুল কেটে অনেকটা বয়কাট করে আসলাম। ভালই হল কাউকে আর বিরক্ত করতে হবেনা মনে মনে শান্তি পেলাম। ভালই চলছিল নিউ হেয়ার কাট নিউ লুক সবমিলিয়ে দিনগুলো এগিয়ে যাচ্ছিল।
কিন্তু একটা চিন্তা মাথা দিয়ে কোনভাবেই যাচ্ছিলনা, সেটা হল এখন মামাত বোন কিংবা মামী বাম হাতের নখ কেটে দিচ্ছে ঠিক আছে কিন্তু হলে ওঠলে কে এটা করে দিবে। মামাত বোন বলে রুমমেটরা কেটে দিবে কিংবা ওদের বাসায় আসলে ও কেটে দিবে কিন্তু আমার মন কিছুতেই তা মানতে রাজী না। কারণ এটা আমার সারাজীবনের সমস্যা তাই এর সমাধান আমাকেই করতে হবে। ভাবতে ভাবতে প্রথমে চেস্টা করলাম দাত দিয়ে নখ কাটার কিন্তু না ব্যাপারটা ঠিক ভাল কিচ্ছু হচ্ছেনা অন্যকিছু ভাবতে হবে। এবার ঘরের ওয়ালের সাথে ঘষে ঘষে নখ ছোট রাখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু এটাও কোন ভাল সমাধান হচ্ছেনা কারণ ওয়ালের সাথে ঘষার কারনে নখগুলো ব্যাথা করত তাই একদিন একটার বেশী নখ ঘষতে পারতামনা, আবার হঠাৎ করে কোন কারনে নখ ভেঙ্গে গেলে সেটা কাটতেও পারতামনা। প্রচন্ড মন খারাপ থাকত। হঠাৎ একদিন মাথায় আসল আমার একটি পা তো ভাল, সেই পা দিয়েই চেস্টা করা যাক। প্রথম চেস্টায় সফল না হলেও কয়েকবার চেস্টার পরে আমি পারলাম এই অসাধ্য না পারা কাজটাকে আমার পারার লিস্টে নিয়ে আসতে। সেদিন কি যে ভাল লাগছিল তা লিখে আমি বুঝাতে পারবনা, সে এক অন্যরকম অনুভূতি। সেদিনের পর আমার আত্মবিশ্বাস এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে এরপরে আমি আর কোন কাজ আমি পারবনা ভাবিনি। সময়ের সাথে সাথে মাছ কাটা থেকে শুরু করে বাটনা বাটা সবই আমার আয়ত্তে চলে এসেছে। দীর্ঘ হল জীবন শেষ করে সংসার জীবনে ঢুকেছি তাও অনেক বছর হল।
এতদিন পরে এসে আজকে এতকথা বলার কারণ কি সবাই হয়তো ভাবছেন। আসলে দুই বাসের বেপরোয়া পাল্লাপাল্লিতে রাজীবের ডান হাত কাটা যাওয়ার নিউজটা দেখার পর থেকেই পুরনো কথাগুলো বারবার মনে পরছিল তাই মনেহল একটু সবার সাথে শেয়ার করি। জানিনা রাজিব সুস্থ্য হয়ে স্বাভাবিক জীবনে কবে ফিরবে, আদৌ ফিরবে কিনা। আজ প্রথম আলোতে পরলাম ও নাকি অনেকটা কোমায় চলে গেছে। আল্লাহর কাছে দোয়া করছি রাজিব আমাদের মাঝে ফিরে আসুক। তবে মনের মধ্যে থেকে একটা আশংকা কিছুতেই যাচ্ছেনা সেটা হল যদি রাজিব ফিরে আসে তাহলে সে কি তার এতদিনের অভ্যস্ততা দুইহাত দিয়ে কাজ করা, ডানহাত দিয়ে লেখা আরো কতকিছু এগুলো কি ভুলতে পারবে অথবা এক হাত দিয়ে আবার নতুন করে সবকিছু তার আয়ত্তে নিয়ে আসতে তার কতটা সময় লাগবে কিংবা তার সেই পথ কতটা সহজ হবে।
একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না এই লেখাটা প্রায়ই আমাদের চোখে পড়ে। হ্যাঁ একটা দুর্ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে আমাদের সব স্বপ্ন তছনছ করে দেয়। তাই সবাই সাবধানে চলাচল করুন এবং সর্বোপরি রাজীব খুব তারাতারি সুস্থ্য হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসুক সেই দোয়া সবাই করুন।
সকলের যাত্রা শুভ হোক।