আলহামদুলিল্লাহ মেনে নিয়েছি আমি আমার নিয়তিকে।
প্রথমে যখন শুনলাম বাম চোখে আর দেখতে পাবনা, চমকে উঠেছিলাম, কেঁদেছিলাম, টানা ৭ দিন ধরে পাগলের মত করে কেঁদেছি, কখনও সবার সামনে, কখনও অন্ধকারে বসে। তবে হ্যাঁ এখন আর কান্না করছিনা, আর কান্না করে কি বা হবে যদি নিয়তি থাকে এক চোখওয়ালা হয়ে বেঁচে থাকা, কিন্তু সত্যিকথা বলতে কি আমি আমার মায়ের কান্নাকে থামাতে পারছিনা।
বেঁচে থাকার লড়াই শুরু করেছিলাম সেই জন্মের পর থেকেই। সুস্থ্য স্বাভাবিকভাবেই এসেছিলাম এই ধরণীতে, কেঁদেছিলাম আমি হেসেছিল আমার মা, আমার চারপাশের মানুষ, আমার আত্মীয়স্বজন শুভাকাঙ্ক্ষী সবাই।
কিন্তু সেই হাসি বেশীদিন হাসতে পারেননি আমার মা। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত জন্মের ছয়মাসের মাথায় আক্রান্ত হলাম সেবিরাল পলিও নামে এক মারাত্নক রোগে, পুরোপরি প্যারালাইসিস বলতে যা বোঝায়, তাই হল। যেই বয়সে বাচ্চারা হামাগুড়ি দিয়ে একটু একটু করে বড় হতে থাকে, পরিচিত হতে থাকে নতুন পৃথিবীর সাথে সেই বয়সে আমি পরিচিত হতে থাকলাম নতুন নতুন টেস্ট আর চিকিৎসার সাথে। কখনও ব্লাড টেস্ট, কখনও মেরুদণ্ডের টেস্ট, কখনও বুকের টেস্ট আরও কতকি। আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় টেস্টের জন্যে আর আমার মা কাঁদেন দরজার সামনে দাড়িয়ে; আহা বাছা আমার এত কষ্ট কিভাবে সহ্য করছে। মায়ের লড়াইয়ের কাছে নিয়তি এসে কিছুটা থমকে দাঁড়াল, শরীরের ডান পাশ অবশ হয়ে গেলেও সে যাত্রায় বাম পাশ বেছে গেল।
জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভাল। তাই এবার কর্মের লড়াই শুরু করলেন আমার মা, কিভাবে আমাকে এই পৃথিবীতে অন্য আর পাঁচজন মানুষের মত করে স্বাভাবিক জীবন দিতে পারেন সেই লড়াই শুরু করলেন তিনি। বাম হাতে কলম ধরিয়ে দিলেন আর আমিও মায়ের হাতধরে এই পৃথিবীর লড়াইয়ে যাত্রা শুরু করলাম।
না, তারপর আমি কিংবা আমার মা আর পিছনে তাকাইনি, বরং পৃথিবীর মানুষ আমাদের দিকে তাকিয়েছে বহহুবার, প্রশংসা করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন সামনে এগিয়ে যাবার। সকলের দোয়া আর ভালবাসা নিয়ে একটি একটি করে জীবনের অনেকগুলো ধাপ পার করেছি, পড়াশুনা শেষ করেছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে। কর্মজীবন, সংসার জীবন সবখানেই আজ আমি একজন সফল মানুষ, আর আমার মা একজন পরিতৃপ্ত মা কেননা তিনি পেরেছেন তার মেয়েকে এই পৃথিবীতে আর পাঁচজন মানুষের মত স্বাভাবিক, সুন্দর ও সার্থক জীবন দিতে। তিনি কয়েকদিন আগেও সবাইকে বলতেন তার যেই মেয়েকে নিয়ে সবচেয়ে দুশ্চিন্তা ছিল সেই মেয়েই এখন সবচেয়ে সফল।
কিন্তু নিয়তি আমার মায়ের সেই ভরসার যায়গায় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত আবার এসে আঘাত করল। গত ২ নভেম্বর হঠাৎ করেই আমার বাম চোখে এক দুরারোগ্য রোগ (একিউট রেটিনাল নেক্রোসিস)ধরা পড়ল, যার ফলাফল হচ্ছে চোখের দৃষ্টি চলে যাওয়া। ফাইনাল্লি গতকাল ডাক্তার বলে দিলেন তেমন কিছু করার নেই, দৃষ্টি আগের চেয়ে আরও কমে গেছে, সামনে আরও কমবে। ওষুধ কন্টিনিউ করতে বলেছেন, সেকেন্ড অপিনিয়ন এর জন্যে চাইলে দেশের বাইরে যেতে পারি, তবে সব যায়গায়ই চিকিৎসা পদ্ধতি একই রকম। এই কয়দিন আমার মা দিনরাত শুধু আল্লাহ্রেই ডাকছেন, এখনও ডেকে যাচ্ছেন। কিন্তু গতকালের খবর শোনার পর থেকে উনি আর কিছুই ভাবতে পারছেননা, একেবারে চুপ হয়ে গেছেন, কিছুই বলছেননা।
না গতকালকে ডাক্তারের কাছ থেকে এসে আমি আর কাঁদিনি, মেনে নিয়েছি আমার নিয়তিকে, এইটাই হয়ত মহান আল্লাহর ইচ্ছা, আমার প্রতি তার ভালবাসা, তিনি তো যা করেন বান্দার মঙ্গলের জন্যই করেন। কিন্তু আমি আমার মায়ের দিকে তাকাতে পারছিনা, আমি জানিনা কি বলে আমি আমার মাকে সামলাব। সবাই আমার মায়ের জন্যে দোয়া করবেন তিনি যেন এই বাস্তবতাটা মেনে নিতে পারেন। আর গালিব আমার লাইফ পার্টনার ওর কথা কি বলব ও আমার হাতটা ধরে আছে, কিন্তু আমি জানি ওর মনের মধ্যে কি যুদ্ধ চলছে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০১৮ সকাল ১১:১০