মানুষের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সে জীবনের প্রয়োজনে যেখানেই ঘুরে বেড়াননা কেন, সে তার জন্মভুমিকে কখনও ভুলতে পারেনা। আমিও ভুলতে পারিনি আমার প্রিয় শহর বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে গড়ে ওটা ছোট্ট শহর পাথরঘাটাকে। আমার জন্ম বেড়ে ওঠা সবকিছুই এই শহরকে কেন্দ্র করে। শৈশব ও কৈশোরের হাজারো স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে এই শহরের প্রতিটি কোনায় কোনায়। উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে প্রানের শহর পাথরঘাটা ছেড়েছিলাম সেই ২০০৪ সালে। তারপর জীবনের প্রয়োজনেই থেকে গেছিলাম ঢাকা শহরে।
ঢাকা শহরের নানান চাকচিক্যে কিংবা আরাম আয়েস কোনটাই আমাকে ভুলাতে পারেনি আমার প্রিয় শহরকে। ১৫ বছরের অধিক সময় ধরে ঢাকায় বসবাস করছি, কখনও কাজের প্রয়োজনে, কখনও ভ্রমণের উদ্দেশ্যে কিংবা কখনও চিকিৎসার জন্যে ঘুরে বেরিয়েছি দেশে বিদেশে। কিন্তু কোন শহরই আমাকে ভোলাতে পারেনি পাথরঘাটাকে, সবসময় নিজের জন্মভুমি পাথরঘাটাকে মনে পড়েছে, ভুলতে পারিনি এক মুহূর্তের জন্যে। এখনও আমি অবসরে চলে যাই ফেলে আসা প্রিয় শহরে, যখন যেতে পারিনা তখন স্মৃতির জানালায় ভেসে ওঠে বিশখালি নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা সবুজের সমারহ কিংবা জিয়া মাঠের কোল ঘেঁষে সারিসারি কেওড়া কিংবা ও ছৈলা বাগানের কথা, কখনও ভেসে ওঠে সাব রেজিস্ট্রার অফিসের সামনের সেই বিশাল আকৃতির বাবলা গাছের কথা কিংবা সামসু স্যারের বাসার সামনের বুকুল ফুলের সেই গাছটি। স্কুলে যাওয়া আসার পথে গাছের নিচে পড়ে থাকা বাবলা ফল কুরানোর দৃশ্য এখনও চোখে জ্বলজ্বল করে ভেসে ওঠে।
এখনকার প্রজন্ম অনেকেই হয়ত এই বাবলা ফল চিনেনা। কিন্তু বাবলা ফলের সেই মিষ্টি স্বাদ আর কেওড়া ফলের টক স্বাদ আমি পৃথিবীর কোন ফলে পাইনা। কেওড়া ফল দিয়ে মা এক ধরণের বিশেষ ডাল রান্না করতেন আর নুন মরিচ দিয়ে ছৈলা ফলের ভর্তা কখনও ভোলার নয়। শৈশবের অন্যতম আরেকটি আকর্ষণ ছিল ছৈলা ফুলের মধু খাওয়া। এই কাজটা খুব যেমন কষ্টের ছিল তেমনি ছিল আনন্দের। বিকেল বেলা ছৈলা গাছ থেকে ফুলের কলি সংগ্রহ করে তারপর একটা থালার মধ্যে কাদা মাটি দিয়ে তার ভিতরে ফুলগুলো অতি সাবধানে সাজিয়ে রেখে সারা রাত অপেক্ষা করতে হত। সকালে ফুলগুলো ফুটে যেত এবং তার মধ্যে থাকত মধু। সেই মধু একটু একটু করে একটা ছোট শিশিতে জমিয়ে তারপরে খেতে হত। ফুল তোলা নিয়ে আমাদের দুই বোনের মধ্যে চলত চূড়ান্ত কম্পিটিশন। যে বেশী ফুল সংগ্রহ করতে পারত সে বেশী মধু খেতে পারত। তবে এখানে বলে রাখি এই লড়াইয়ে আমার বড় বোনই জয়ী হত কেননা সে গাছে চড়তে পারত।
ছৈলা ফুল কিংবা বাবলা ফল এখন পাথরঘাটাতে পাওয়া যায় কিনা জানিনা। কারণ ডিজিটাল বাংলাদেশের কল্যানে পাথরঘাটা এখন উন্নত, আর বর্তমান প্রজন্ম প্রাকৃতিক বিষয়ের চেয়ে কৃত্রিম বিষয় মোবাইল, কম্পিউটার কিংবা টিভিতেই বেশী আনন্দ পায়। উন্নয়ন যে শুধু মোবাইল ঘিরে হয়েছে তা কিন্তু নয়। সর্বক্ষেত্রেই পাথরঘাটার উন্নতি চোখে পরার মত। একসময় যেখানে পাথরঘাটা থেকে ঢাকা আসতে তিনদিন লেগে যেত সেখানে এখন বাসে করে দিনের মধ্যে ঢাকা চলে আসা যায়। তখন জলপথেই সবাইকে যাতায়াত করতে হত, সড়ক ব্যবস্থা তেমন ছিলনা বললেই চলে আর ঢাকাতে যেতে হলে প্রথমে লঞ্চে করে বরিশাল, তারপরে বরিশাল থেকে ষ্টীমারযোগে ঢাকা আসতে হত। এখন পাথরঘাটাকে আলাদা করে কাউকে চিনাতে হয়না অপার সম্ভাবনাময় পাথরঘাটা তার নিজস্ব পরিচয়ে আজ সবার কাছে পরিচিত।
ছোট্ট শহর হলেও প্রাকৃতিক নৈসর্গের অপূর্ব লীলাভূমি পাথরঘাটা। পর্যটন শিল্পে এর রয়েছে আপার সম্ভাবনা। তিন দিকে নদী ও সমুদ্র বেষ্টিত হওয়ায় এর সৌন্দর্য সকলকেই মুগ্ধ করে। এর দুপাশ দিয়ে বলেশ্বর ও বিশখালি নদী যেয়ে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে আর এই মিলনস্থানে গড়ে উঠেছে বিহঙ্গ দীপ নামে একটি দীপ যা খুব সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ শহরকে ঘিরে গড়ে ওঠা পর্যটন ও মৎস্য শিল্পের নানা দিক এবং এই শহরের নামকরন নিয়ে কিছু কথা লিখব যাতে করে দেশের এবং বিদেশের মানুষ আমার প্রানের শহর পাথরঘাটা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন।
পাথরঘাটার পূর্ব নাম বাধাঘাটা। তবে পাথরঘাটা নামকরণের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে প্রায় তেমন কিছুই জানা যায় না। তবে জনশ্রুতি রয়েছে যে, এ উপজেলার ভূ-অভ্যন্তরে বিদ্যমান পাথরের অস্তিত্ব থেকেই পাথরঘাটা নামকরণের সূচনা হয়েছিল। ১৯০৩ সনে এ নামকরণের সূত্রপাতঘটে মর্মে ধারণা করা হয়। তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রাম মাইজ ভাণ্ডার শরিফ থেকে বাগেরহাটের খাজা খান জাহান আলি নদীপথে অলৌকিকভাবে বাগেরহাটে পাথর ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় বিশখালী এবং বলেশ্বর নদীর মোহনায় এক রাতের জন্য ঘাটি স্থাপন করেছিলেন। উক্ত পাথরের কিয়দংশ এখানে রয়ে যায়। সে কারণেই এলাকাটি পাথরঘাটি নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে পাথরঘাটি নামটি পাথরঘাটা নামে নবরূপ লাভ করে। পাথরঘাটা নামের স্বার্থকতার প্রমাণস্বরূপ এখনো পাথরঘাটার মাটির তলদেশে পাথরের অস্তিত্ব বিদ্যমান। যে কারণে এ এলাকায় ডিপ টিউবওয়েল স্থাপন করা সম্ভব হয় না কারণ ২২-২৪ ফুট গভীরে পাথরের সন্ধান মেলে।
পাথরঘাটা উপজেলার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মূলত মৎস্য আহরণ ও কৃষি নির্ভর। পাথরঘাটার প্রধান রপ্তানিদ্রব্য হচ্ছে ধান, ইলিশ মাছ ও চিংড়ি পোনা। এখানে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ও পাইকারী বাজার আছে। ১৯৮১ সালে এটি ৫.৪০ একর জমির উপর বিষখালি নদীর পশ্চিম পার্শ্বে এটি স্থাপিত হয়। দেশের সামুদ্রিক মাছের চাহিদার একটি বড় অংশ আসে পাথরঘাটার এই মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র থেকে। মাছ সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে অথেছে বেশ কিছু বরফকল রয়েছে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য শিল্প ও কলকারখানার মধ্যে আছে স’মিল, ধানকল, ওয়েল্ডিং কারখানা। পাথরঘাটার ইলিশের স্বাদ এখন সর্বজন প্রসিদ্ধ এবং এখান থেকেই দেশের সিনহভাগ ইলিশের সরবরাহ হয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় চাঁদপুরকেই এখনও ইলিশের শহর হিসেবে জানি। তবে সে দিন আর বেশী দূরে নয় যেদিন পাথরঘাটাকেই ইলিশের শহর হিসেবে চিনবে।
শুধু মৎস্য সম্পদ নয় পাথরঘাটায় রয়েছে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা। ছোট্ট এই শহরের উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্রগুলো হল নীলিমা পয়েন্ট, বিহঙ্গ দীপ, হরিণঘাটা, লালদিয়ার বন, কালমেঘা পর্যটন কেন্দ্র। এছাড়া বিএফডিসি মৎস্য বাজারে দেখা যায় রুপালি ইলিশের সৌন্দর্য যা খুব সহজেই মুগ্ধ করে মাছপ্রেমী বাঙ্গালিকে। এই পর্যটন কেন্দ্র গুলোতে যেতে হলে সবাইকে পাথঘাটা শহরে আসতে হবে। পাথরঘাটার মিষ্টির স্বাদও মিলবে স্বীকৃত, এখানেই মিলবে রসগোল্লা কিংবা মালাইয়ের মত বিখ্যাত মিষ্টি যারা পাথরঘাটাতে আসবেন এই মিষ্টি পট্টীতে যেয়ে মিষ্টি খেতে ভুলবেননা। ঢাকা সায়দাবাদ, গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে বরগুনা অথবা পাথরঘাটাঘামী বাসে করে পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদ চত্বর আসলে এখান থেকেই সবগুলো পর্যটন স্পটে অটোরিকশা কিংবা নৌকা যোগে মোটামুটি সবগুলো স্পটে যাওয়া যায়। এছাড়া সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল হতে বরগুনার লঞ্চে এসে পাথরঘাটার কাকচিড়া ঘাটে নেমে অটোরিকশা করে পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদ চত্বর আসা যায়।
পাথরঘাটার ইলিশ এবং পর্যটন শিল্প অত্যান্ত সমৃদ্ধ হওয়ায় এই জেলার রয়েছে দেশের অন্যান্য পর্যটন জেলার মতই স্বীকৃতি পাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু যে কোন কিছুরই সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু সমস্যাও থেকে যায়, পাথরঘাটাও তার ব্যতিক্রম নয়। পাথরঘাটার অন্যতম সমস্যা হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। আমি যদি অতিতের কথা চিন্তা করি তাহলে বলব পাথরঘাটা যোগাযোগ ব্যবস্থায় গত দুই দশকে অনেক এগিয়েছে, এই শহরের সাথে এখন সরাসরি ঢাকা, খুলনা, বরিশাল কিংবা চট্টগ্রামের সাথে সরাসরি বাস রয়েছে যা একসময় এই এলাকার মানুষের কাছে স্বপ্ন ছিল।বরগুনা জেলা প্রশাসনের তত্বাবধানে উপজেলা প্রশাসন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে পাথরঘাটার এই সম্ভনাময় বিষয়গুলোকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার প্রয়াসে। তারা ইতিমধ্যে এই বিষয়ে নানা ধরণের উদ্যেগ হাতে নিয়েছেন এবং পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করছেন। যার নজির হিসেবে আমরা দেখতে পাই কিছুদিন আগে বরগুনার সাবেক জেলা প্রসাশক জনাব মুস্তাইন বিল্লাহ বিহঙ্গ দীপ ও নীলিমা পয়েন্টকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে সশরীরে এসে উদ্বোধন করেন। আমি আশা করি খুব শীঘ্রই এই সমস্যাগুলোর সমাধান হয়ে যাবে এবং পাথরঘাটা বাংলাদেশের অন্যান্য পর্যটন জেলার মতই বিশ্ব দরবারে পরিচিতি লাভ করবে।ছৈলা ফুল, বাবলা ফল এবং কেওড়া ফলের ছবি ধারাবাহিকভাবে দিলাম।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০২১ বিকাল ৪:২৩