শওগাত আলী সাগর
এ নিয়ে কতোবার যে ছবিটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকা ! কতোবার? তার হিসেব রাখা হয়নি। ফেসবুকে প্রতিদিন কতো মানুষ শত শত ছবি আপলোড করছে, তার কোনোটাই কি এভাবে আকড়ে ধরতে পেরেছে? মনে করতে পারছি না। খুব বিশেষ কোনো তাতপর্য যে আছে ছবিটার তাও নয়। তবু বার বার ছবিটা টানছে কেন? ছবিটাই কি টানছে? না কি তার সাথে ক্যাপশনের মতো করে লেখা লাইনটা?
একটি বিল্ডিং এর সামনে দাড়ানো তিনটা মেয়ে। একটু দূরে খানিকটা একাকী দাড়ানো মেয়েটাকে চিনি বলে বোধ হলো না। সম্ভবত হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে গিয়ে মুখ ঢেকে যাওয়া মেয়েটা দীনা। দীনা আমাদের সহপাঠী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগের মেধাবী ছাত্রী দূরদানা মতিন এখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই ইংরেজী বিভাগে অধ্যাপনা করছে। আর তার গা ঘেষে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটা আমাদের লিথি। লিথি নামের চেয়েও আরিফা হক নামেই তার পরিচিতি ছিলো সমধিক। লিথিও আমার সহপাঠী।
ছবিটার দিকে বারবার তাকাই। হাত দিয়ে দীনার ছবিটা ঢেকে দিয়ে লিথিকে একাকী করে দেই। ঠোটের কোনায় একটা হাসি লেগে আছে। এই হাসিটা কি কোনো একদিনের জন্যও তার মুখ থেকে মুছে যেতে দেখেছি? না, মনে করতে পারছি না।এই হাসিটা যেন সবসময়ই লিথির ঠোটে লেগে থাকতো। কথা বলার সময় ঠোটের হাসিটার সঙ্গে মিতালী করেই যেন তার চোখদুটোও উজ্জল হয়ে উঠতো। ফেসবুকে দীনা এই ছবিটা আপলোড করেছে আজ ক’দিন হলো। আমাদের অন্য বন্ধুরা, ইংরেজী বিভাগের সহপাঠি- যারা ফেসবুকে আছে, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই ছবিটার নীচে নানা ধরনের কমেন্ট করেছে। আমি কমেন্ট লিখতে গিয়েও থেমে যাই। কি লেখা যায়- এই ছবিটার কমেন্ট? কিছু একটা লিখেও মুছে দেই। প্রায় প্রতিদিনই একবার করে কিছু একটা লিখে কিছুক্ষণ বসে থাকি। তারপর পোষ্ট না দিয়ে সেটা মুছে ফেলি। তাকিয়ে থাকি ছবিটার দিকে। পলকহীন চোখ ছবিটার উপর স্থির হয়ে থাকে, কখনো সেখান থেকে সরে গিয়ে দীনার দেওয়া ক্যাপশনটায় স্থির হয়ে যায়। ‘She walked away all of a sudden, couldn't say why she was leaving; left us in grief, doubt and utter disbelief!’- কথাগুলোই যেন ছবিটার চেয়েও বেশি মূর্তমান হয়ে ওঠে।
লিথি কি বিশেষ কেউ ছিলো ডিপার্টমেন্ট এর?কিছু কিছু মানুষ থাকে, যারা হৈ হুল্লোড় আর প্রাণচাঞ্চল্যে ডিপার্টমেন্টকে মাতিয়ে রাখে। লিথি কি সেরকম কেউ ছিলো ? না, সেটি বলার যো নেই। তবু এতোগুলো বছর পর খুবই সাদা মাটা,সহজ-সরল একটা মেয়ের ছবিটাই যেন বিশেষ হয়ে উঠলো। লিথি কবে যে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গিয়েছিলো সেটা এখন আর মনে করতে পারি না। কবে যে জীবন থেকেও বিদায় নিয়ে গেলো সেটাও জানার সুযোগ হয়নি আমাদের। তবে অনেক বছর আগে সদ্য পরিচয় হওয়া একজন লিথি যে নেই এমন একটা তথ্য দিয়েছিলেন। সেই তথ্যটাও তেমন একটা ছুতেঁ পারেনি আমাকে।
তখন টরন্টোয় আমি নতুন। বিকেলটা কাটে টরন্টোর একমাত্র বাংলা বইয়ের দোকান ‘অন্যমেলায়’ আড্ডা দিয়ে। যে কোনো মানুষ দেখলেই যেচে কথা বলার একটা বাতিকে পেয়ে বসেছে তখন আমায়। সেরকমই একটা সময়ে অন্যমেলায় কথা হয়েছিলো নতুন আসা একজন অভিবাসীর সঙ্গে। ভদ্রলোক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগের ছাত্র ছিলাম জেনেই তিনি প্রশ্ন করেন, তাহলে তো আপনি লিথিকে চেনেন?
- লিথি?
- আরিফা হক- লিথি।
সঙ্গে সঙ্গে সহজ সরল এই মেয়েটার কথা মনে পড়ে যায়। আমি জানাই লিথি আমার সহপাঠী ছিলো।
এরপরই যে তথ্যটা তিনি দেন, তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।
- ‘লিথি মারা গেছে।‘- সারি সারি সাজিয়ে রাখা বইগুলোর দিকে এলোমেলো দৃষ্টি ছড়িয়ে তিনি বলে যান।
আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। বিড় বিড় করে উচ্চারন করি,’লিথি মারা গেছে!’
ভদ্রলোক আবারো বলেন, হ্যাঁ, ও তো চীন চলে গিয়েছিলো,দেশে এসেছিলো কিছুদিনের জন্য। তারপর মারা যায়।’এর চেয়ে বেশি কিছু ভদ্রলোক বলেন নি। কিংবা আমি এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করিনি বলেই হয়তো তিনি আগ্রহ পান নি। এর পর আর কখনোই লিথির কথা মনে পড়ে নি।
আজ অনেক বছর পর আবার যেন টুকরো টুকরো লিথি একত্রিত হয়ে একটা মালা হয়ে চোখের সামনে ভাসতে শুরু করেছে। কিরকম শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতো মেয়েটা। কথা বলার ভঙিটার মধ্যেও যেন কেমন একটা আহলাদি ভাব থাকতো।ছাত্ররাজনীতিতে অতিমাত্রায় সম্পৃক্ততার কারনেই বোধ হয় আমার বন্ধুত্বের গন্ডিটা ডিপার্টমেন্টের চেয়েও বাইরে বেশি সম্প্রসারিত ছিলো। কিন্তু ডিপার্টমেন্টের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গেও সম্পর্কটাও অনেক নিবিড় ছিলো। লিথিও তাদেরই একজন। ‘অ্যা আল্লাহ জানো, আমার না একদম প্রিপারেশন নেই, টিউটোরিয়ালটা কিভাবে দেবো?’- উদ্বেগের এই কথাটাও এমন আহ্লাদ নিয়ে বলতো যে, আড়ালে আমরা তার নকল করে নিজেরাই হাসাহাসি করতাম।মজার ব্যাপার, তার সামনেই এ্ নিয়ে আমরা হেসে মরে গেলেও তার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিনি কোনোদিন। বরং মাঝে মধ্যে প্রশ্ন করে বসেছে, ‘এমা, তোমরা এমন হাসছো কেনো?’
বিকেলে শামসুন্নাহার হলের সামনে আড্ডা মারতে গেলে কখনো কখনো দেখা হয়ে যেতো লিথির সঙ্গেও।আমাদের দীর্ঘ আড্ডার অংশিদার সে কখনোও ছিলো না ।টুকটাক যতটুকু কথাবার্তা হতো তার মধ্যে পড়াশুনা নিয়ে, পরীক্ষা নিয়ে তার উদ্বেগের প্রকাশটাই বেশি থাকতো। নিজে তেমন ভালো কিংবা মনোযোগী ছাত্র ছিলাম না বলেই হয়তো সেই সব উদ্বেগ আমাকেও ছুঁয়ে যেতো।কিন্তু আলাপচারীতা কিংবা আচরনে কখনোই কোনো সীমাকে ছাড়িয়ে যেতে দেখিনি তাকে। কি যেন একটা সীমানা সে নিজেই তৈরি করে নিয়েছিলো।
শুধু একবার, একবারই যেন নিজের তৈরি করা সীমানাটা সে ভেঙ্গে ফেলে।
-‘আচ্ছা, তুমি পার্টি করো কেন? কি ভালো একটা ছেলে তুমি। পার্টি টার্টি করে কি লাভ?’
তার ঠোটে সেই চিরায়ত হাসি,চোখের তারায় উজ্জল আলোর নাচন। আমি সেই কথার কোনো জবাব দেই না। বরং লিথির তাকিয়ে থাকি। সারল্যে পরিপূর্ণ এক মায়াবতী নারী। আমি কোনো জবাব না দিয়ে অর্থহীন হাসি। লিথিও উত্তরের প্রত্যাশা না করেই প্রসঙ্গ পাল্টায় ।
সেই লিথি ‘..walked away all of a sudden, couldn't say why she was leaving.’
আজ অনেক বছর পর ‘কাউকে কোনো কিছু না জানিয়েই না ফেরার দেশে চলে যাওয়া’ লিথিকে এনে হাজির করে দিলো দিনা।বন্ধুদের স্মৃতিতে যেন হঠাত দমকা হওয়ার মতোই একটা ঝড় তুলে দিলো এই একটা ছবি। ছবির নীচে মন্তব্যগুলো পড়তে পড়তে এক সময় আমিও লিথির ছবিটার দিকে তাকাই। অস্ফুট উচ্চারনে বলি,’তুমি খুব, খুবই ভালো মেয়ে ছিলে লিথি। খুবই ভালো মেয়ে।‘
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১১ দুপুর ১২:২৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




