স্যার, প্রথমেই সালাম নিবেন। জানিনা এই মেইলটা আপনার কাছে গিয়ে পৌঁছাবে কিনা, অথবা পৌঁছলেও আপনি পড়বেন কিনা। ৫ অগাস্ট এর "কালের কণ্ঠ" পত্রিকায় ভার্সিটি ভর্তি সম্পর্কীয় আপনার অতি মূল্যবান লেখাটা পড়েই আপনাকে মেইল করতে উদ্বুদ্ধ হলাম। স্যার, প্লিজ মেইলটা পড়বেন, এড়িয়ে যাবেন না। আমি অন্যান্য অনেকের মতই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধের এক যুদ্ধা। বাস্তবের যুদ্ধের থেকে এই যুদ্ধের পার্থক্য এতটুকুই যে ওই যুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয় অস্র দিয়ে আর ভর্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পরতে হয় মেধা আর পরিশ্রম নিয়ে। আজব বিষয় হল এই যুদ্ধে সবাই যুদ্ধ করে নিজের জন্য, কোন দেশ বা জাতির জন্য নয় !! আরও আজব বিষয় হল এই যুদ্ধ কেবল আমাদের এই প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশেই হয়। পৃথিবীর আর কোন দেশে ভার্সিটিতে ভর্তি হতে হলে কাউকে এত বিরাট যুদ্ধে অংশ নিতে হয়না। আর যুদ্ধের সৈনিকদের প্রশিক্ষন দিয়ে গড়ে তোলে কোচিং সেন্টারগুলো। কোচিং ! এ এক বিরাট অরাজকতা । যেখানে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা যাওয়া আসা করে, পাছে অন্যদের থেকে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পরে! প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে ওইসব আকামা কোচিংগুলো। এই ইনকাম কতটুকু হালাল কে জানে। শিক্ষার্থীরা যে আশা নিয়ে কোচিংএ ভর্তি হয় টার কতটুকুইবা পুরন হয় কে যানে। অথচ ভর্তির পূর্বে পুরো টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হয় এবং রশিদ এর নিছে ছোট করে লেখা থাকে," ভর্তি কোনভাবেই বাতিলযোগ্য নয়"। দেশের মানুষদেরকে এক কথায় গ্রাস করছে এই কোচিংগুলো। কি'ই বা হত যদি এসব কোচিং না থাকত? কেউ কোচিং নিয়ে মাতামাতি করত না, যার যা সামর্থ্য আছে তা নিয়ে ভর্তিযুদ্ধে অংশ নিত, কারো হাজার হাজার টাকা কোচিং এর নামে জলে ঢালতে হতনা। এর চেয়ে বেশি তো আর কোন ক্ষতি হতনা। আরে না ! আরও ক্ষতি হত। কোচিং না থাকলে বছর বছর সরকার লাখ লাখ টাকা ট্যাক্স থেকে বঞ্ছিত হত ! আর এই ট্যাক্স এর টাকাগুলু তো খেয়ে খেয়ে ভুরি মোটা করছে ওই দুর্নীতিবাজরা। কোচিং বন্ধ হলে সবচেয়ে বড় যে উপকারটা হত তা হল, ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা অনেক কমে আসতো। বাসায় পড়ে যতটুকু কাভার করা যায় তা দিয়েই সবাই পরীক্ষা দিত। এতে করে যারা যোগ্য তারাই কেবল চান্স পেত। কোচিং থাকায় সবার প্রস্ততির পরিমান প্রায় কাছাকাছি থাকে। ভর্তি পরীক্ষার প্রধান জিনিষ হল 'মেধাতালিকা'। কিন্তু এ কেমন মেধাতালিকা যে তালিকায় বাদ পড়ে যায় অর্ধেকের বেশি মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী? যারা ইন্টার পরীক্ষার পর নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে দুই মাস পড়া পড়া পড়া পড়া, কোচিং, লেকচার শিট, এসব করে কাটাতে পারে তারাই কেবল চান্স পায়। তাও সবাই পায়না। আর যারা একটু অলস কিছিমের, তারা শত মেধাবী হলেও চান্স পায়না, তাদের ব্যাকগ্রউন্ড যত ভালই হোক। এদের স্থান হয় প্রাইভেট ভার্সিটি কিমবা জাতীয় ভারসিটির উনুনে, যেখানে সারা জীবন ব্যার্থতার আগুনে তাদেরকে জলতে হয়। আর ওই তালিকার নাম নাকি মেধাতালিকা! ১ ঘণ্টার এক MCQ টেস্ট করে কারো মেধা সম্পর্কে কতটুকুইবা ধারনা পাওয়া যায়! ওই তালিকার নাম হওয়া উচিত ছিল "পরিশ্রমী তালিকা" । ঠিক একই অবস্থা মেডিকেল আর বুয়েট ভর্তির ক্ষেত্রেও। ওই তালিকায় ২০% জুড়ে অযোগ্যরাও ঢুকে পড়ে শুধু ভাগ্যের জোরে দাগিয়ে দাগিয়ে! কি সুন্দর সে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কিমবা ত্রিপল ই নিয়ে পড়তে থাকে মনের আনন্দে! ভর্তির আগে হয়ত সে "engineering" বানানটাই পারত না। HSC তে পুরোপুরি রচনামূলক সিস্টেম। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষা সম্পূর্ণ MCQ. তাই মাত্র দুই মাস সময়ের মধ্যে পাহাড়সমান সিলেবাস শেষ করা কি যে কষ্ট তা কেবল পরীক্ষার্থীরাই জানে। কি'ই বা ক্ষতি হতো যদি hsc তেও ssc এর মত উভয় সিস্টেম থাকত? এসব বাদ দিলাম। এখন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় আসি। স্যার, আমি মফঃস্বল থেকে খুব স্বপ্ন নিয়ে সিলেট এসেছিলাম SSC এর পর। এমসি কলেজে ভর্তি হয়ে কি যে খুশি তখন !! একদিকে ২০০৯ এর SSC তে ভাল ফলাফল অন্যদিকে বোর্ড এর সেরা কলেজে ভর্তি হতে পারা ! আর কি চাই আমার !! কিন্তু ভাগ্যদোষে HSC পরীক্ষার আগে হয়ে গেল অসুখ। ঠিকমত পড়তে পারলাম না, তাই পরীক্ষা অতটা ভাল হলনা। রেজাল্ট যা আসা করেছিলাম তার থেকে চরম খারাপ আসল। মন গেল ভেঙ্গে। পড়াশোনা আর কোচিং যাওয়া অফ করে দিলাম। শুরু হল কান্নাকাটি আর হতাশা। দিলাম রিস্ক্রুটিনাই। কিন্তু কোন কাজ হলনা। রেজাল্ট আগেরটাই থেকে গেল। রেজাল্ট ভাল না হওয়ায় সবার থেকে আমার মার্ক পিছিয়ে গেল ১০-১৪। মেডিকেল এ পরীক্ষা দিয়ে চান্স হলনা। বাবার অত টাকাও নাই যে প্রাইভেট মেডিকেলে পড়ব। আর ডাক্তারি পড়ার অত ইচ্ছাও ছিলনা। সবচেয়ে যে বিষয়টা আমাকে সারাক্ষন কাঁদায় তা হল, রেজাল্ট এর কারনে আমার বুয়েটে পরীক্ষা দিতে না পারা। স্যাররা খাতা দেখতে গাফিলতি করেছেন, সময় কম থাকায় ভতিজা,ভাতিজি রে দিয়া খাতা দেখাইছেন, বোর্ড রিএক্সামিন করতে গাফিলতি করেছে আর এর করুন পরিনতির শিকার হলাম আমরা ছাত্ররা। শুধু আমি না, আমার পরিচিত শত শত ছেলে মেয়ের একই অবস্থা, একই অভিযোগ। কারো খাতা ঠিকমত দেখা হয়নি। কেউবা মার্ক পেয়েছে প্রত্যাশার থেকে অনেক উপরে আবার কেউ অনেক নিচে। গত বছর হাহাকার আর যন্ত্রণা বুকে নিয়ে কয়েকটা ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিয়ে কোথাও চান্স হয়নি। আবার চান্স হলেও বিষয়ভিত্তিক মার্ক এর কারনে পছন্দের বিষয় পাইনি তাই ভর্তি হইনি। শেষে স্থান হল ঘুরে ফিরে সেই এমসি কলেজে!! এ যে কি এক যন্ত্রনা তা বুঝে কেবল আমার মত পরাজিত ছাত্ররা। আমিতো কেবল তাদেরই একজন প্রতিনিধি। এক বছর গ্যাপ দিয়ে পুরো প্রস্তুতি নিয়ে এ বছর আবার HSC improvement পরীক্ষা দিলাম। কিন্তু এই বছর ফলাফল আসল গতবারের চেয়েও খারাপ !! যা আমার পক্ষে মেনে নেয়া নিজেকে খুন করার মত। মনে হচ্ছিল দুনিয়া ছেড়ে তখনি চলে যাই। নিজেকে এবারও নিওন্ত্রন করলাম। এখন আবার পাবলিক ভার্সিটির ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। কি আছে কপালে জানিনা। আমার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার খুব ইচ্ছা ছিল। এখন সব স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে। শুধুমাত্র বেঁচে আছি দেহ নিয়ে। আত্মা আরও আগেই মরে গেছে। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার মত কোন অযোগ্যতা মনে হয়না আমার আছে। যে ছেলে ব্লগিং করে, টেকটিউন করে, মাঝে মাঝে ফ্রীল্যান্স করে, আউটসোর্স করে, SSC তে Golden A+, ক্লাস 5 আর 8 এ ট্যালেন্টপুল বৃত্তি সে কি আসলেই পাবলিক ভার্সিটিতে CSE পড়ার অযোগ্য? আমার স্কুল এর স্যাররা এখনও আমাকে নিয়ে আফসোস করেন। স্যাররা আমার এই পরিনতি মেনে নিতে পারেন না যেখানে আরও খারাপ ছাত্ররাও ভাল যায়গায় পড়ছে। শুধু আমি না, আমার মত হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এই করুন পরিনতির শিকার। পরিবার, সমাজের কাছে তারা এখন ঘৃণার পাত্র, পাশাপাশি নিজের কাছেও। এর জন্য দায়ী কারা? দায়ী এ আনাড়ি শিক্ষা বেবস্থা। এই অবিচার আর অনিয়মের কি কখনও শেষ হবেনা? আমার নিজের জীবন তো অনেকটাই ভূতুড়ে হয়ে গেছে। আমি আমার ছোট ভাই এর জীবনটা এরকম দেখতে চাই না। প্লিজ, হাতজোড় আবেদন, আপনারা কিছু একটা করেন। ( স্যার এখনও রিপ্লাই করেননি)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১২ রাত ১১:১১