somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন অন্তুর গল্প

১৫ ই আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৪:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রাত ১২টা ৫ মিনিট। বাইরে বৃষ্টির সাথে মৃদু শব্দে বাজ পরছে। বৃষ্টির শব্দের সাথে হেডফোনে কম ভলিউমে গানের মিশ্রণটা দারুন এক পরিবেশ সৃষ্টি করে। বৃষ্টির সময় গান শোনার এই অভ্যেসটা আমার বেশ পুরনো। শখের স্মার্টফোনটা কিছুদিন আগেই বিক্রি করে দিলাম। আজ তাই ল্যাপটপে গান শুনছি। ফোনের অনুপস্থিতিতে এই ল্যাপটপ বেচারা এখন একমাত্র সঙ্গী। দিনের জাগ্রত মুহূর্তের বেশিরভাগই কাটে ইনার সাথে। ইদানীং বেশ জোরেশোরে মাথার চুল পরছে, এই ঘটনার সাথে আমার ল্যাপি মিয়ার (ইয়াং জেনারেশন আদর করে ডাকে) প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার সম্ভাবনা প্রবল।


আমার পরিচয় দিয়ে নিই। আমি বরফি। আমার অবশ্য ভাল আরেকটা নাম আছে। সেটা পরে বলছি। এই বরফি বোম্বের রণবীর কাপুরের মত বোবা না হলেও বেশ চুপচাপ স্বভাবের। আমি বহুরূপী। বাস্তবে এবং ছবিতে আমাকে একেক সময় নাকি দেখতে একেক রকম লাগে। এটা এক বন্ধুর ভাষ্য, যদিও বন্ধু বলতে তেমন কেউ নেই আমার। ২৪/৭ অনেকটা একাকীই কাটে সময়। আড্ডায় কিম্বা ক্লাসে অন্যরা ফুল স্পিডে কথা বললেও আমি চুপ। সেই ‘বহুরূপী’ থেকে কালের বিবর্তনে আমার নাম এখন বরফি। বহুরূপী>বরূপি>বরফি। শুধু দেখতে নয়, স্বভাব চরিত্রেও আমি বরফি! সেই বন্ধুটি বলতো, “ তোমাকে চেনা দায়, মিস্টার বরফি মিয়া!”



এই বৃষ্টি ভেজা রাতে তোমার কথা খুব মনে পরছে। বহুরূপী এই মানুষটাকে তুমি ঠিকই চিনতে পেরেছিলে, তাইতো আমার বহুরূপিতা শুধু তোমার কাছেই ধরা দিয়েছে; হাইড্রোজেন যেমন কার্বনের শিকল ধরে তার রূপের ডালপালা মেলে তেমনি তুমি আমাকে করেছিলে রুপম। এখন আর সেই ভিন্নরুপ নেই আমার। রসকষহীন সাদা কাগজের টুকরোর মত হয়ে গেছি আমি। হাইড্রোজেন না থাকলে কার্বনের কি কোন দাম আছে বল? আমিই আমার বলয়ে ঘুরপাক খাই, কেন্দ্রবিন্দুতে নিউক্লিয়াস নেই। লাটিমের মত নিজেকে ঘিরে নিজেই ঘুরছি। সব মিলিয়ে মন্দ নই, নিজেকে উপভোগ করছি ভালই।


নন্দিনী, আমার নান্দু... তুমি ভাল আছো তো? আমার এই বরফি নামটাতো তুমিই দিয়েছিলে, তাইনা। তুমিইতো আমার বন্ধু। তুমি বলতে আমাকে সময়ে সময়ে ভিন্ন রকম লাগে। কুমার বিশ্বজিতের ‘তোরে পুতুলের মত করে সাজিয়ে’ গানটা তোমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল। হেডফোনে এই গানটাই বাজছে। এখনও কি গানটা ভাললাগে তোমার? বেশ কয়েক বছরতো হল তোমার সাথে দেখা নাই। কেমন হয়েছ তুমি? আগের মত চড়ুই পাখি আছ নাকি কিছুটা মোটাসোটা হয়েছ? তোমাকে দেখতে অনেক ইচ্ছে করছে রে। সেই মায়াটা আজো নিঃশেষ হয়ে যায়নি, এ নিঃশেষ হওয়ার নয়। ভালবাসা বেঁচে আছে আজো, বেঁচে থাকবে চিরকাল। ঢাকায় তোমার দিনকাল কেমন যাচ্ছে? তখনতো বেশ বলতে, মরে গেলেও ঢাকা শহরের বাসিন্দা তুমি হবেনা। যে শহরটার প্রতি বেজায় বিরক্ত ছিলে সে’ই তোমার আপন এখন। নান্দু, এই বরফির কথা মনে আছে তো তোমার? মনে আছে সেই দিনগুলির কথা যখন ক্লাস রেখে দুজন চলে যেতাম আফতাব মামার দোকানের পাশে দেয়ালঘেরা সেই সরু পথটায় ? দুই দেয়াল ঘেঁষে দুজন মুখুমুখি দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকতাম অপলক; তুমি আমায় দেখতে, আমি তোমায়। মাঝে মাঝে লজ্জার মুচকি হাসি হেঁসে তুমি মাথা নিচু করতে, আবার তাকাতে; মন ভরে, চোখ ভরে দেখতে আমায়, আমি তোমায়। কলেজ জীবনের সময়টুকু কত সুন্দরই না কেটেছে দুজনের। নান্দু, তোমার মনে আছে গায়ে শিহরণ জাগানো সে প্রথম চুমু , প্রথম সে জড়িয়ে ধরা? তুমিকি সবই ভুলে গেছ? জানি আজ হাজারটা প্রশ্ন করেও তোমার কাছে কোন জবাব মিলবে না, কিন্তু আমার যে বড্ড জানতে ইচ্ছে করে রে নান্দু। সে কি লজ্জা তোমার! নাহ, আমি পারিনি আমার আবেগ রুখতে। তখন রবীন্দ্রনাথের এই কথাটা মগজে নাড়া নিয়েছিল বেশ, “ ওরে, প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।” কখন চোখ বুজেছি, কিভাবে তোমার পানে ঠুট দুটো বাড়িয়ে দিয়েছি কিছুই বুঝিনি রে নান্দু,লজ্জায় লাল টুকটুকে হওয়া তোমার চেহারাটা আজো চোখে-মনে গেঁথে আছে। সেই টুকটুকে নান্দুটাকে দেখতে আজ খুব মন কাঁদছে। আমার আবেগে তাড়িত হয়ে নিজেকে বেঁধে রাখতে পারনি তুমিও; নিজেকে সঁপে দিয়েছিলে এই বুকে, দুহাতে জড়িয়ে ধরেছিলে গলায়। নাহ, আর পারছিনা আমি। বারবার ফিরে যেতে মন চাইছে ২০০৫ সালের সে সময়টায়। তোমার সৃতিগুলো আমি সচরাচর পাত্তা দেইনা, আজ কেন আবার তোমার মাঝে ফিরে যাচ্ছি। গানে মন বইছেনা, ভলিউম কমিয়ে দিয়ে মন এখন তোমার কাছে, নন্দিনী। মনে আছে, দুজন খুবই লাজুক প্রকৃতির ছিলাম, সামনাসামনি বসে কথা বলতেও লজ্জা পেতাম! ফোনেও আমাদের তেমন কথা হতনা, হত প্রচুর এসএমএস বিনিময়। কলরেট ছিল সাত টাকা মিনিট। অভিমান, প্রেম, গল্প যাই হত বেশিভাগই এসএমএসে। আমার নিরবতাটা অনেক অনেক পছন্দ করতে তুমি। তোমার একটা বদভ্যাস ছিল, প্রচুর পরিমানে সন্দেহ করতে। এ নিয়ে মাসে দু-একবার মন কষাকষি হত। বেশি ভালবাসতে বলেই হারানোর ভয়টাও ছিল বেশি, তখন বুঝিনি তোমায়। কিছু কিছু কথা কখনো বলা হয়নি তোমায়। আজ বলতে ইচ্ছে করছে। জানো, আমার মাঝে অবুঝ এক পাগলামি ছিল। তোমার সবকিছুই ভাললাগতো আমার। তোমার যা যা ছিল আমারও সেসব জিনিস পেতে ইচ্ছে করতো। মনে আছে, তোমার একটা লাল ব্যাগ ছিল? মার্কেটে কত খুঁজলাম সে ব্যাগ, পেলাম না। তুমি যে কলম দিয়ে লিখতে আমিও সেটা দিয়ে লিখতাম, হয়ত তুমি বুঝতে পারতে, মুচকি হাসতে। ভালবাসার প্রকাশ কখনো ভালবাসার মানুষটার কাছে লুকনো থাকেনা, সে সবই বুঝতে পারে। বহুদিন পর সেরকমই লাল একটা ব্যাগ আজ ভার্সিটির এক মেয়ের কাঁধে দেখতে পেলাম। চমকে ওঠেছিলাম, অবচেতন মনটা যে তোমাকেই খুঁজে বেড়ায়।


খুব অভিমান লেগেছিল তোমার ওপর সেদিন। কেন ছেড়ে গিয়েছ আমায়? আমার বুঝি কষ্ট হয়না? আমাকে ছেড়ে গিয়ে, সবাইকে ছেড়ে গিয়ে একা একা ঘর বেঁধেছ তুমি। ওই ঘরে ভাল আছ তো নান্দু? আকাশের কান্নার সাথে সাথে দুচোখ ভরে তোমার জন্য আজ কান্না ঝরছেরে নান্দু। কান্না থামাতে পারছি না আজ আমি। ফিরে এসো প্লিজ... আসবেনা তো? ঠিক আছে, আমিই একদিন আসব তোমার কাছে, সেদিন আমাকে ফিরিয়ে দিওনা লক্ষ্মীটি। সিলেটে আন্টিকে একা ফেলে রেখে ঢাকায় আব্বু আম্মুর কাছে যেতে চাইতেনা তুমি। সে আন্টির সাথেও ছলনা করলে তুমি? আজ আন্টিও নেই। পরিবারে শুধুমাত্র এই মানুষটিই ছিলেন তোমার আমার পক্ষে। কেউ আমাদেরকে মেনে নেয়নি তো কি হয়েছে? তাই বলে এই পথ বেছে নেবে তুমি? এতো সহজে হাল ছেড়ে দিলে নান্দু? তুমি আমি শক্ত থাকলে কোনকিছুইতো অসম্ভব ছিলনা। বড় মামাতো একরকম রাজি হয়েই গিয়েছিলেন, আর ক’টা দিন ধৈর্য ধরতে একটু। কিসের এতো ভয় ছিল তোমার? আমিকি সারাক্ষন তোমার পাশে ছিলামনা বল? এতোটুকু ভরসা রাখতে পারলেনা তোমার অন্তুর ওপর? হ্যাঁ, আমর ভাল নাম শাফায়াৎ অন্তর। নান্দু আমাকে অন্তু বলে ডাকতো।


নান্দু তুমি একবারও ভাবনি আমার কথা? কেন একা চলে গেলে তুমি? আজিমপুরের নির্জনপুরীতে কেমন আছে আমর নান্দু, খুব জানতে ইচ্ছে করে। না, আমার নন্দিনী আত্মহত্যা করেনি। সে অতোটা স্বার্থপর নয়। ভার্সিটি থেকে ফেরার পথ ধরে আর ফেরা হয়নি নান্দুর। এক হিংস্র বড়লোক তার বেপরুয়া মার্সিডিজ গাড়ি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে চলে যায় ময়াময় চেহারার সেই নন্দিনীকে। আশেপাশের লোকজন চাইলে পারতো ওকে সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। না, তারা তামাশা দেখেছে, দেখেছে কি করে একটি মেয়ে ছটফট করে প্রাণ দিচ্ছে। কেন যে আজ বৃষ্টি এলো, বৃষ্টি এলে সে মেয়েটির কথা ভুলে থাকতে পারিনা। আমার নন্দিনীর খুব ইচ্ছা ছিল আমায় নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে, হাতে হাত ধরে খেলা করবে আমার সাথে, সুখে-আনন্দে ভেসে যাবে আমার নান্দু। আমি তার ইচ্ছা পূরণ করতে পারিনি, কথা রাখতে পারিনি আমি, পারিনি পুতুলের মত সাজিয়ে ঘরে তুলতে তাকে। নান্দু তুমি দুঃখ করোনা, হৃদয়ের কোঠরে আজো তুমি আছো, হ্যাঁ রে পাগলি পুতুলের সাজেই আছো তুমি।


দেখ আমিও কি পাগল, তোমাকে ভেবে কাঁদার কিছু আছে? কাঁদতে কাঁদতে ল্যাপি মিয়াকে ভিজিয়ে দিয়েছি! তুমিতো আমার সুখের স্পন্দন। কাঁদবো কেন আমি? ওইদিন আমি কাঁদিনি। শোকে পাথর ছিলাম আমি। আজ বুঝি পাথর গলে পানি ঝরছে। মাঝে মাঝেই এমন হয়। মাসের পর মাস যায় পাথরই থাকি। কদাচিৎ কোন এক রাতে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনা। টপটপ অশ্রু ঝরতে থাকে। নাহ, আর কাঁদবোনা আমি। না পাওয়া সুখ বুকে ধারণ করে সারাটা জীবন পার করে দেব। রাত তিনটে বেজে গেছে। মিউজিক প্লেয়ারে এখন বাজছে, ‘তোমার আমার দেখা হবে ওইপাড়ে...’ বৃষ্টি কবেই থেমে গেছে, খেয়ালই করিনি।
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিনেতা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৫



বলতে, আমি নাকি পাক্কা অভিনেতা ,
অভিনয়ে সেরা,খুব ভালো করবো অভিনয় করলে।
আমিও বলতাম, যেদিন হবো সেদিন তুমি দেখবে তো ?
এক গাল হেসে দিয়ে বলতে, সে সময় হলে দেখা যাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×