গত কয়েকদিনের আলোচিত প্রিপারেটরি স্কুলের পৈশাচিক ঘটনাটি আমাকে ক্ষুব্ধ করেছে, কিন্তু বিস্মিত নয়। বিস্মিত নয়, এজন্য যে ঘটনাটা নতুন নয়। নতুন নয় মানে যে অল্প কয়েকদিনের পুরোন, তাও নয়। এরকম একেকটা ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে ঘটে আসছে। বিভিন্ন জায়গায়, বিভিন্ন ধরনে। কোনটা রিপোর্টেড হয়, কোন টা হয়না, পার্থক্য এখানেই। তানিয়ার কথা কারো মনে পড়ে? ছয় বছরের শিশুর সঙ্গে ঘটনাটা ঘটেছিল প্রায় বছর কুড়ি আগে। হয়তো কারো মনে পড়বে, কারো পড়বেনা। এর বেশি বলে আমি নতুন করে কাওকে মনে করিয়ে দিতে চাইনা। এরকম আরো কত তানিয়া, সময়ের সঙ্গে আমাদের আলোচনায়, আসে । মরে যায়, বা বেঁচে থেকে ধুকে ধুকে মরে। আমরা কিছুদিন কথা বলি, তারপর ভুলে যাই। ভুলে যাই। কারণ মেয়েটা আমি নই, আমার কেউ নয়। সুতরাং আমার মনে রাখার দায় নাই। যদি বলি এইটাই আমাদের সমাজ, আমাদের বিবেক। আমি ভুল বলি নাই। শিশুরা, নারীরা ধর্ষিত হয়েছে, হয়, হবে। যদি বলি এটাই আমার দেশ । তাহলেও আমি ভুল বলি নাই। হ্যাঁ আমি ঠিকই বলছি এদেশে নারীরা ধর্ষিত হয়েছে, হয় এবং হবে। ততদিন, যতদিন আমরা এ পাপের দায় না নিব। যতদিন আমরা স্বীকার করবো না ধর্ষণ যে করেছে সে আমার পরিবারের, আমার সমাজের, আমার দেশের পুরুষ। আমরা সব সময় অপরাধ দেখে চোখ কুচকাই। কিন্তু অপরাধের দায় নেই না। ভাল কাজের ভাগ নিতে পিছপা হইনা। কিন্তু একটা অপরাধ ঘটে গেলে, ভাব ধরি এটা এলিয়েন শ্রেণির কেউ করেছে। অপরাধী আমার কেউ নয়, সুতরাং কিছুদিন ঘৃণাপাত। অতঃপর অপরাধীও কোনদিন ধরা পড়ে না। আমরাও ভুলে যাই।
কিন্তু এই যে একেকটা ঘটনা ঘটে যায়, কে ঘটায়? যদি বলি আমার আপনার ভাই, পুত্র বা পিতা? মানতে কষ্ট হচ্ছে, জানি। কিন্তু এটাই সত্যি। আজকে আপনার যে ভাইটা বা পুত্র খুব ভালো ছেলে। বাবার দিকে চোখ তুলে তাকায় না। মায়ের সঙ্গে আহ্লাদ করে কথা বলে। ছোট ভাইবোনদের জন্য জীবন দিয়ে দেয়, বাইরে গিয়ে সে কি করে আপনি কি জানেন? মা বাবার এই ভালো ছেলেটাই হয়তো টিএসসির নারী নির্যাতনকারী। বা মনে করেন আপনার প্রেমিক। পাঁচ সাত বছরের স্টেডি সম্পর্ক। তার কাছেও যে কøাশের সহপাঠি বলি বা অফিসের কলিগ, নারী মানে যে শুধুই শরীর! সে খবর কি আপনি রাখেন? অথবা যদি বলি এরকম কোন ঘটনা ঘটে গেল, অপরাধী আপনার পিতা! কেমন লাগবে? জানি আঁতকে উঠবেন। আমরা মনে করি আর যে যা করুক, আমার আপনজন শুধুই একেকজন ভালো মানুষ। যত অপরাধ করে সব অন্য লোক। এভাবেই আমরা দায় এড়িয়ে যাই।
উদাহরন দিয়ে যদি বলতে হয়, তাইলে বলি। এই শুক্রবার দুপুরে খেতে গেলাম বনানীর একটা রেস্টুরেন্টে। কিছুটা দূরের টেবিলে একটা পরিবার। স্বামী-স্ত্রী, দুই সন্তান। একজন বছর সাতেকের আরেকজন কোলে। সবার খাওয়া শেষ, মা’টি তখন খাচ্ছেন, স্বামীর কোলে তার শিশু সন্তান। অন্তত: মিনিট তিনেক খেয়াল করলাম, সেই লোকটা বাচ্চা কোলে নিয়ে এদিক ওদিক ঘোরার নাম করে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে। ভালো দৃষ্টি খারাপ দৃষ্টি চেনার মতো সক্ষমতা আমার আছে। লোকটা কিন্তু ওই ভদ্রমহিলার স্বামী। দুই শিশুর পিতা। রেস্টুরেন্টে মধ্যে যে এরকম আচরন করতে পারে। সে তাইলে সুযোগ পেলে আর কি না করতে পারে।
হলপ করে বলতে পারি, আমি এমন কোন আহামরি রম্ভা, উর্বশী নই। তবু পঞ্চাশ পা হাঁটতে গেলে অন্তত: বিশ জোড়া চোখ বিঁধে আসে। আমি হয়তো নিজেরটা বুঝি। কিন্তু এই একই ঘটনা ঘটে প্রায় সব মেয়েদের সঙ্গেই। এই চোখগুলো কাদের? আমাদেরই ভাই ব্রাদারের। সবচেয়ে আজব ব্যাপার এমনটা ঘটে শুধু এই আমার প্রিয় ঢাকা শহরেই। আমার প্রিয় বাংলাদেশেই। এর বাইরে যেকোন দেশে, যেকোন শহরে মধ্য রাতেও একা রাস্তায় হেঁটে দেখেছি, কেউ তাকিয়েও দেখেনি, কোন অনিরাপত্তা বোধ জাগেনি। অথচ আমার ট্যাক্সের টাকায় যে দেশ চলে, সে দেশের শহরে আমি অনিরাপদ। আমার এই অনিরাপত্তার কারণ আমার আপনার ঘরের ‘ভালো’ অথবা ‘দুষ্টু’ পুরুষ। এবং যতক্ষণ আপনি নিজে আক্রান্ত না হবেন, ততক্ষন আমি সঠিক কায়দায় পোষাক না পড়া, খারাপভাবে পথ চলা নারী। জ্বি একজন নারী হয়েও আরেকজনকে এভাবেই বলবে। আর ঘরে গিয়ে ভাত বেড়ে অপেক্ষায় থাকবে নিজের পরিবারের ‘ভালো’ ছেলেদের।
আমরা ভুলে যাই পরিমলদেরও মা বাবা থাকে। একই ভাবে আমাদের ঘরেই পরিমলরা থাকে। তারপরও আমরা দায় এড়াই। দিনের পর দিন দায় এড়াতে এড়াতে আর আমাদের সমাজ আর সমাজ থাকেনা, হয়ে যায় একেকটা এঁদো ডোবা। শুধু একেকটা ঘটনা ঘটে যাবে আর আহা উহু করবো, তাতে কিন্তু সমাধান আসবেনা। এক সমাধান হতে পারতো, দেশে যদি আইনের শাসন থাকতো। এই সব ঘটনার সঠিক বিচার হতো। সেটা যখন হওয়ার নয় তখন সমাধান পেতে হলে নিজের কাছের মানুষদের আগে মানুষ বানাতে হবে। নিজে মানুষ হতে হবে। আমাদের চারপাশে এখন দ্বৈত চেহারার লোক বেশি। এতদিন ধরে দেখে এসেছি, যে কিনা নারী অধিকার নিয়ে কথা বলে, বাড়িতে গিয়ে সেই নারী নির্যাতন করে। যে কিনা শিশুশ্রমের বিপক্ষে কাজ করে, তার বাড়িতে একাধিক শিশু শ্রমিক। এই দ্বৈত আচরনের অভ্যাস আমাদের কমেনি, বরং বেড়েছে। নতুন নতুন সংগঠন তৈরি হয়েছে, নতুন নতুন ইস্যুতে। দেখা যায় মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দেয় যে প্রতিষ্ঠান, সে প্রতিষ্ঠানের কর্মীই কাওকে মানসিকভাবে তুমুল নির্যাতন করে। মাদকাসক্তি নিরাময় নিয়ে কাজ করে যে, সেই আসলে মাদকাসক্ত। একইভাবে দিনের আলোয় যে যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলছে, সন্ধ্যার অন্ধকারে তার মুখটা আসলে কোন চেহারা ধারণ করে, বলা মুশকিল। সুতরাং একজন শিক্ষক যখন যৌনপল্লীর সর্দারনির মতো কথা বলে। আমি নিশ্চিত সেটা মুখ ফসকে বলা নয়। তার দীর্ঘদিনের জীবনচর্চা, বিশ্বাসের প্রতিফলন এটা। স্কুল আর ব্রোথেল দুটো আলাদা প্রতিষ্ঠান। দুটোর চরিত্র দু’রকম। তারপরও ব্রোথলের অনেক র্সদারনি পারেন স্কুল শিক্ষকের মতো কথা বলত, জীবনের ঘাত প্রতিঘাত তাদের অনেক কিছুই শেখায়। কিন্তু স্কুল শিক্ষকরা যখন ব্রোথেলের র্সদারনির মতো কথা বলে লজ্জায় মাথা নত হয়ে যায়। সামনে দেখি শুধুই অন্ধকার। এদের হাতে আমাদের প্রজন্মকে শিক্ষিত করার দায়িত্ব ! দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসারের মুখে যখন শোনা যায় ‘দুষ্টু’ ছেলের গল্প। অবাক হওয়ার কিছুই নেই। এটাই তার ভেতরের রূপ। এদের কাছেই আমাদের আইন রক্ষার দায়িত্ব!
এতদিন জেনেছি, শর্ষের ভেতর ভুত থাকে। এখন আমাদের খুঁজে দেখতে হবে ভুতের মধ্যে দু’এক কণা শর্ষেদানা অবশিষ্ট আছে কিনা। দিন যেভাবে যাচ্ছে, তা নাহলে দু’দিন পর আমাদের কারো ছায়াই আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা। যেমন খুঁজে পাওয়া যায় না ‘মূল্যবোধ’ শব্দটার অস্তিত্ব।
ছায়া মিলিয়ে যাওয়ার আগে আসুন আয়নায় শেষ বারের মতো নিজেদের মুখ দেখি। নইলে আমাদের এ পাপের বোঝা কিন্তু বাড়তেই থাকবে। বাড়তেই থাকবে।