অনেক অনেক বছর পরেও দুটো বাক্য অথবা দুটো নাম হঠাৎ করে মনে পড়ে বা কেউ মনে করিয়ে দেয়। ‘ধান শালিকের দেশ’ এবং ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসেনা’। এই নাম দুটোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শৈশব যাদের, কৈশোর যাদের তারা জানে কি অদ্ভুত মাদকতা জড়ানো একটা কিশোর ম্যাগাজিন আর একটা বই। অথবা মালাকাইটের ঝাঁপি। সম্প্রতি নিরুদ্দেশে হারিয়ে যাওয়া এদেশের মফস্বলীয় মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে বছর কয়েক আগে বেড়ে ওঠা শিশুদের সোনার কাঠি রুপার কাঠি, একেকটি বই। যে সময়টার কথা বলছি সে সময় পরিবারগুলোর ঐশ্বর্য ধনে ছিলনা ঐশ্বর্য ছিল জ্ঞানে। জ্ঞান মানে শুধু পুঁখিগত বিদ্যা না, সকাল দুপুর কোচিং সেন্টার দৌড় নয়। জ্ঞান ছিল নানারঙের বইয়ে। বইগুলো আবার রঙিন ছিলনা, কিন্তু রঙ ছড়াতো শিশুদের মনে মননে। সেরকম একটা সময় থেকে বেড়ে ওঠা এই আমি এখনও কারো দামি পোষাক বা হাল ফ্যাশনের কোন অনুষঙ্গ দেখে মুগ্ধ হইনা, হিংস্বে জাগেনা। বরং চিনচিনে একটা হিংস্বে লাগে যখন শুনি কেউ হুমায়ূন আজাদের লেখা ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসেনা’ প্রথম পড়েছিল ‘ধান শালিকের দেশ’ নামের ম্যাগাজিনে। মনে হয় কি এক মহান ঐশ্বর্যর সন্ধান সে পেয়েছিল কি দারুন একটা সময়ে! আর কটা দিন আগে হলে আমারও কি থাকতে পারতো না এমন একটা অমূল্য মূহুর্ত, আমার শিশুবেলার?
এতো গেল এক টুকরো আনন্দের ঘটনা। এরকম আরো কত শত আনন্দ, বেদনা নিয়ে কেটে গেছে এদেশের একসময়ের মেরুদন্ড হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে বেড়ে ওঠা মানুষগুলো। এই আনন্দ, বেদনা, অনেক না পাওয়ার ভীড়েও অসাধারণ কিছু পাওয়ার মধ্যে দিয়ে কেটেছে যে শৈশব, কৈশোর কোন ছোট শহর বা শহরতলীতে। যেখানে পরিবার মানে মা বাবা ভাইবোন ছাড়াও দুয়েকজন কাজিন বা কারো ছোট মামা, খালা, কাকা বা ফুপু নিয়ে একবাড়িতে থাকা। কখনো বা আরো দূর সম্পর্কর কেউ এসে দিব্বি হয়ে গেছে পরিবারের অংশ। যে সমষের কথা বলছি তখন পরিবার মানে শুধু এক ছাদের নিচে থাকা কয়েকজন মানুষ নয়, পরিবার মানে ছিল প্রতিবেশিরাও। তাদের হাসি, কান্না, আনন্দ, বেদনা ছুঁয়ে যেত এক পাড়া বা কলোনীতে থাকা সব গুলো মানুষকে। তখনও প্রতি বাড়িতে দরজা থাকতো ঠিকই কিন্তু সে দরজা দিনে বা সন্ধ্যায় কখনো বন্ধ হতো না। হয়তো খুঁজতে গেলে দেখা যেত যতগুলো বাড়ি আছে যতগুলো দরজা আছে ততগুলো তালা নেই পুরো মহল্লায়। তখনকার মায়েরা কম শিক্ষিত ছিলেন কিন্তু তাদের শিক্ষা ছিল উচ্চ। তখনকার বাবারা অল্প পয়সার চাকুরি করতেন কিন্তু তারা মানসিকতায় ছিলেন ধনী। তখন এত টিভি, পত্রিকা ছিলনা, ছিলনা নানা মুনির নানা মত, নানা বিভাজন। তাই সহজেই সেই মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো একত্রিত হতে পারতো। তথ্যের অবাধ প্রবাহ ছিলনা কিন্তু আকাশেও রঙ দেখেই তারা অনেক কিছুই আঁচ করতে পারতেন, তাইতো তাদের একটা নিজস্ব অবস্থান ছিল।
সে সময়ের তুলনামূলক বড় পরিবার গুলোতে ভাইবোনের সংখ্যা ছিল বেশি কিন্তু ভরা ছিল মধ্যবিত্ত সুখে। এবং এ সুখের সূচক ছিল বই বা পাঠাভ্যাস। তাদের হয়ত পয়সা ছিল কম, খাবার ছিল হিসেবের, আলমারিতে কাপড় থাকত মাথা গুনে, কিন্তু বাসায় বই থাকত অগুনতি। বই কিনে যে কেউ দেউলে হয়না তার প্রমান ছিল সেই পরিবার গুলো। বিকাল পাঁচটার আগে টেলিভিশন চলত না। পাঁচ টাতেও শুরু হতো মুখস্থ অনুষ্ঠানমালা। পবিত্র কোরান থেকে তেলায়াত, তর্জমা ও তাফসির। তারপর পবিত্র গীতা, বাইবেল বা ত্রিপিটক থেকে পাঠ। এরপর ধরাবাঁধা একটা কার্টুন ছবি। সপ্তাহে একদিন ছোটদের অনুষ্ঠান। তারপর গানের অনুষ্ঠান পল্লীগীতি, রবীন্দ্র, নজরুল মিলিয়ে একেকদিন একেক সঙ্গীতানুষ্ঠান। আটটায় বিখ্যাত আটটার সংবাদ (আসলে হতো এরশাদ সংবাদ) । এরপর নাটক। প্রতি মঙ্গল আর বৃহস্পতিবার। বুধ বার হতো ইংলিশ সিরিয়াল। আবার রাত দশটায় ইংরেজি খবর। সুতরাং আমাদের জন্য টিভিতে বিনোদন ছিল সব মিলিয়ে দিনে বড় জোর দুঘন্টা। বন্ধুর সঙ্গে ফোনে গল্প করার মতো ফোন বা বন্ধু কোনটাই খুব বেশি ছিলনা। মাগরিবের আজানের সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ফেরার অলিখিত নিয়ম ছিল প্রায় সব বাড়িতে। অতএব আমাদের সেইসব চাকুরিজীবি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিনোদন বলতে ছিল বই, বই আর বই। পরিবারের বড় ভাইবোন দুয়েকজন পড়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকায় বা অন্য কোথায়। তাদের তারুন্যও ছিল গেম অব থ্রনময় নয় বরং বই কেন্দ্রিক। ছোটদের কাছে মূলত তারাই ছিল বইয়ের সবচেয়ে বড় যোগানদার। শুধু নিজের ভাইবোনের জন্য না প্রতিবেশি ভাইবোনদের জন্যও। তাদের হাত ধরেই আমরা হয়ে উঠতাম একেকজন পড়ুয়া। বইয়ের কালো অক্ষরে আমরা বিশ্ব দেখতাম, জীবন চিনতাম। আমাদের বন্ধু হতো অপু দূর্গা, আমাদের বন্ধু হতো সেরিওজা, তিমুর। আমরা এ্যানা ফ্রাঙ্কের প্রেমে পড়তাম। আমরা টুটুল নামে এক কিশোরের স্বপ্ন দেখতাম। আমরা কেউ ললি হতাম, কেউ টুনি। সে সময় আমরা সবাই জানতাম আমাদের বড় হতে হবে। আমরা বুঝতাম, আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছে আমাদের পরিবার, আমাদের প্রতিবেশিরা, আমাদের দেশ। পরিবারের জন্য অক্লান্ত খেটে যাওয়া মা বাবা বড় ভাইবোনরা কোনদিন মুখে না বলেও আমাদের জানিয়ে দিতে পেরেছিলেন আমাদের কর্তব্য, পরিবারের প্রতি, দেশের প্রতি। কোন আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই আমরা ভালোবাসতে শিখেছিলাম দেশ। আমরা স্বপ্ন দেখতে শিখেছিলাম। খুব ছোট ছোট মধ্যবিত্ত স্বপ্ন, কিন্তু ঠুনকো নয়। আমাদের সেই বইয়ের পাতার মতো নিরবিচ্ছিন্ন মধ্যবিত্ত জীবনেও হঠাৎ চেনা পৃষ্ঠাটা, পড়া পৃষ্ঠাটা উল্টে গেল, খুব দ্রুত এবং প্রায় কোন প্রস্তুতি ছাড়াই। আগের পৃষ্ঠাটা খুব ভালোমতো আত্মস্থ করার আগেই দেখি আরেকটি নতুন পৃষ্ঠা, একেবারে আনকোড়া।
নব্বইয়ের দশকের বৈশ্বিক রাজনীতির পরিবর্তন, সোভিয়েতের পতন এবং আমাদের নব্য গণতন্ত্র প্রথম যে জিনিসটি উধাও করে দিয়েছে তা হলো মধ্যবিত্ত পরিবারপ্রথা। মধ্যবিত্ত চেতনা। নতুন শ্রেণী বিন্যাস হয়েছে। এক সময়ের সমবিত্তের কেউ হয়ে গেছে আকাশ ছোঁয়া ধনী। তৃতীয় প্রজন্মের চাকুরীজীবি পরিবারগুলোর পাশাপাশি প্রথম প্রজন্মের স্কুল পাশ পরিবারগুলো একই কাতারে দাঁড়িয়ে হাঁসফাঁস করছে। টেকনোলজির মাঠে চাইনিজ আধিপত্য খুব সহজেই সব আধুনিক ডিভাইস ধরিয়ে দিতে পেরেছে সব ধরনের মানুষের হাতে। জীবন এখন ডিভাইস কেন্দ্রিক। সেই সুখে দুখে সত্যি সত্যি পাশাপাশি থাকার সমাজ হারিয়ে বন্ধুত্ব চলে গেছে সোশ্যাল সাইটে। আমরা সবাই এখন ছুটছি। আমাদের স্বপ্ন মিলিয়ে গেছে কিন্তু আকাঙ্থা হয়েছে সীমাহীন। আমাদের চারপাশে তৈরি হয়েছে অনেক চোরাগোলি, সংক্ষিপ্ত পদ্ধতি। এইসব পথ পদ্ধতির চালু ব্যবহারকারীরা সহজেই হয়ে উঠেছে কেউকেটা। তারাই কখনো আমাদের দিক নির্দশনা দেয়। একই রাষ্ট্রের একটা অংশ আয় করে দেশে কিন্তু ধন সম্পদের পাহাড় বানায় বিদেশে। একটা অংশ কোনদিন যারা আগে কোন আলোকিত যাত্রায় অংশ নেয়ার সুযোগ পায়নি বিত্তহীনতার অজুহাতে। তারাও এখন তুলনামূলক আর্থিক বিবেচনায় ভালো অবস্থানে, ঘরে মজুদ হয়েছে কিছু পাশের সনদপত্র। অসংখ্য পিঁপড়ে পাখা গজিয়ে আজ পাখী হয়ে উড়ছে। হারিয়ে গেছে আমাদের বই মনস্কতা, হারিয়ে গেছে মূল্যবোধ, হারিয়ে গেছে শেকড়ের ঘ্রাণ। ধান শালিকেরা কবে কখন কোথায় চলে গেছে, আমরা জানিইনা। ঘুম না আসার মতো ফুলের গন্ধ নেই কোথাও। তবু আমাদের ঘুম আসেনা। তারপরও এই ক্ষয়ে যাওয়া গলে যাওয়া সিঁড়ির কাঠামোর একেক ধাপে দাঁড়িয়ে, গোড়া থেকে আগা আমরা সবাই স্বদম্ভে দাবি করি ‘আমরা মধ্যবিত্ত’।
কারণ আমরা জানি, ‘মধ্যবিত্ত’ শব্দটার মধ্যে একটা আভিজাত্য ছিল।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০১৫ সকাল ১১:৪৩