somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অকাল বোধন : বীর নয় সমর্পিতের নাগালে শুভ শক্তি

১৫ ই অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১০:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আশ্বিন মানেই নিশ্চিন্তিপুরের সেই মাঠ। নরম সাদা কাশবনে গা ভাসিয়ে ছুটছে দুর্গা সঙ্গে অপু। আমার বা আমাদের প্রথম ভালোবাসা। ভালোবাসা অপুর জন্য, ভালোবাসা, মন কাঁদা দুর্গার জন্য। আকাশে ভাসছে রেলের ধোঁয়া। মস্ত একটা হাতির শুঁড় মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশ ভরা সাদা মেঘের বাঁকে। সেলুলয়েডে দেখার আগে বইয়ের পাতার এই বর্ণনায় যা ছিল কল্পনা, হুবহু সেরকমই যেন ভেবেছিলেন রায় বাবু।
চলন্ত বা স্থির যে চিত্রই হোক না কেন এটাই আমার আশ্বিনকে বুঝে নেবার প্রথম পাঠ। এর আগেও দুর্গাপূজা এসেছে, দেখেছি প্রতিমা মণ্ডপ থেকে মণ্ডপে। খুব ছোটবেলায় স্কুলপড়া ভাইবোনের আঙ্গুল ধরে আজাদ মেলায় যাওয়া। চোখ ঝলসানো আলো। হলুদ প্রতিমা, রঙিন শাড়ি। অসুরের দিকে সিংহের হিংস্র চাহনি। মার্বেল বসিয়ে সিংহের চোখ। প্রথমবার যেমন দেখেছি এখনও একদম ফ্রেশ অনুভূতি। একই মেলায় সার্কাস থেকে শুরু করে কাগজের টমটম। বাৎসরিক উৎসবের একটা ব্যাপার। এরপর ধীরে ধীরে আবিষ্কৃত হয় উৎসবের পারিপার্শ্বিকতা। আশ্বিন মানেই চেনা চেনা সব গাছগুলো ভরে যায় শেফালিতে। ভোরের সঙ্গে সঙ্গে গাছতলা সাজিয়ে দেয় জাফরান দেয়া এক থালা বাসমতি ভাত। শিউলি মানেই শীতের পূর্বাভাস। শিউলি মানেই দুর্গাপূজার আবাহন। এখনও বাংলাদেশে আশ্বিনে কেউ যদি ট্রেনে ওঠে, একেকটা স্টেশন পার হতেই দেখবে রেললাইনের পাশের ডোবার পানিতে অজস্র শাপলা। সাদা, বেগুনি কিংবা লালচে গোলাপি। নগর জীবনে কাশবন যতটা দুর্লভ ভাবা হয়, আসলে ততটা নয়। মিরপুরের বেড়িবাঁধটা পেরোলেই কাশবনের হাতছানি। অথবা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা। কিছুটা দূরে যমুনা ব্রিজের নিচটা এসময় ভরে থাকে কাশের রাজত্ব। এতকিছু নাইবা দেখলাম, নাইবা ছুটলাম দূরে কোথাও। নিত্যদিনের যে পথ সে পথেরই এদিক ওদিক চোখ মেললেই দেখা যাবে দুয়েক চিলতে কাশের গুচ্ছ। আশ্বিনে কাশ যে না ফুটে পারবেই না।
এই শাপলা, এই শিউলি বা এই কাশের ফুল, এই আজ নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা সব কিছুর সঙ্গে কেন যেন অবিচ্ছেদ্য হয়ে মিলেমিশে একাকার দুর্গাপূজা। শারদীয় দুর্গাপূজা। প্রকৃতি যেন প্রত্যেকটি আচরণে দুর্গাকে সম্ভাষণ করে, দুর্গার জন্যই যেন তার সাজসজ্জা প্রস্তুতি সবকিছু। আশ্বিনের এই সব অনুষঙ্গ যখনই দৃষ্টিসীমায় আসে, কি এক অজান্তে ঢাকের বাদ্যি শুনতে হা পিত্যেস জাগে। কখন পড়বে ঢাকে কাঠি! আজ পর্যন্ত কখনো কেন যেন আমার মনে হয়নি দুর্গাপূজা কেবলই একটা ধর্মোৎসব। সবসময় মনে হয় এদেশের, এ ভূভারতের পরিবেশ, আলো, হাওয়া, সংস্কৃতি থেকে উৎসারিত একটি নিজস্ব উৎসব, সবার জন্য, সার্বজনীন।
যদিও শরতের এ অকাল বোধন আদি দুর্গার রূপ নয়। কবি মধুসূদনের দেখানো পথে যদি বলি তাহলে বলতে হয় ‘আর্য’ রাম অনার্যদের বাসন্তী দেবীকে করেছে শারদীয়। যদি সংস্কৃতির চোখে দেখি তাহলে মনে হয় শরতের চেয়ে এত সুন্দর সময় সম্ভবত উৎসবের জন্য আর কিছু হতে পারে না। আর যদি দেখি ধর্মের দৃষ্টিতে, তাহলে খটকা লাগে পুরো অকাল বোধনেই। আমার চোখে রাবণ হিরো। বীর হিসেবে তো বটেই এমনকি রামের সঙ্গে তুলনা করলেও। পারিবারিক রাজনীতির শিকার রামের বনবাসে যাবার ভেতর কোনো বীরত্ব দেখি না, ভালো মানুষীর আড়ালে যুক্তির পরাজয় ছাড়া। বরং বীর সেই যে কিনা শক্তিতে সামর্থ্যে প্রাচুর্যে বুদ্ধিতে অতুলনীয়। রাম ছিল ভালো রাজা। কিন্তু রাবণ শক্তিশালী রাজা। অযোধ্যার চেয়ে লঙ্কার প্রাচুর্য অনেক। স্বর্ণে, রতেœ, প্রযুক্তিতে যে লঙ্কা রাবণের তৈরি সে তো সোনার লঙ্কা, বীরের লঙ্কা। রাবণ গৌর বর্ণের নয়, তাই রাবণকে মনে হয় নিজেদের মানুষ। আমার নয়, মধুসূদনেরও মনে হয়েছিল। সেই শক্তিশালী বীর রাবণের পরাজয় ঘটেছিল অকাল বোধনের ভেতর দিয়ে। অকাল বোধন হয়ত বলতে চায় যুক্তি নয়, দেবত্ব শক্তি সবসময় থাকে অন্ধ সমর্পিতের সঙ্গে।
চৈতালী দুর্গার ভক্ত ছিল রাবণ। রাম-রাবণের যুদ্ধ যখন চরমে তখনও দুর্গা রাবণকে স্বস্তি দিয়েছে। সবসময় ভক্তের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু হঠাৎই রামের স্তুতিতে দুর্গা সমর্থন সরিয়ে ফেলে রামের দিকে। গৌর বর্ণের প্রতি কি দেবতাদেরও পক্ষপাতিত্ব আছে? সে যাই হোক আমার কিন্তু রাবণের জন্য কেমন একটা মায়া হয়। বেচারা রাবণ! এত ভরসার দেবী দুর্গার শেষ মুহূর্তে পাশে না থাকাতেই পরাজয় পরাক্রমশালী রাবণের। রাবণের দীর্ঘদিনের প্রার্থনার চেয়ে রামের চক্ষু বিসর্জনের বাসনায় কি এত ভক্তি? দেবরাজ্যের এ হিসাব আমার পক্ষে হয়ত মেলানো সম্ভব নয়। তবে এত হাজার হাজার বছর পরও বাল্মীকি মুনির এই চরিত্র বিন্যাসের প্রতিফলন দেখতে পাই সর্বত্রই। সুপার পাওয়াররা কেন যেন স্পষ্টভাষী, সামর্থ্যবানদের পাশ ছেড়ে পুতু পুতু টাইপ সমর্পিত ‘ভালো’ মানুষদেরই পাশে দাঁড়ায়।
বাল্মীকি মহাশয়ের লেখনীর যে সাধারণ চরিত্র বিশ্লেষণ করেছি আমরা সাধারণ মানুষ, তার একটি গত কিছুদিন আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। বিভীষণ চরিত্রের যে সরলীকরণ করা হয়েছে আমি কিছুতেই তার মর্মোদ্ধার করতে পারছি না। বিভীষণ ছিল রাবণের ভাই, শান্তিপ্রিয় মানুষ (রাক্ষস)। সে রাবণকে যুদ্ধ ধ্বংস থেকে সরে আসতে বলে। যুদ্ধ নয় শান্তি ছিল তার মূল কথা। কিন্তু রাবণ যখন তার বীরত্বেই আস্থা রাখে এবং যুদ্ধ করেই জিততে চায়, তখন বিভীষণ রামের কাছে আসে। রাম তখন অকাল বোধনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। বিভীষণ তখন বুদ্ধি বাতলে দেয় কিভাবে দেবীকে সন্তুষ্ট করা যাবে। সেই ১০৮টা নীল পদ্্্্্ে¥র কথা প্রথম বলে বিভীষণ। আমার খটকাটা এখানেই, পাঠক রাবণকে দেখে ক্ষতিকর চরিত্রে। তাহলে ক্ষতিকর চরিত্রকে পরিত্যাগ করে যে পাঠকের আদর্শের চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তার জয়ের কৌশল বাতলে দেয় সে কিভাবে শত্রু হয়? ঘরের শত্রু বিভীষণ। কার ঘরের শত্রু? রামায়ণের পাঠকের ঘর তো লঙ্কা নয়, অযোধ্যা । বিভীষণ তো শেষ পর্যন্ত অযোধ্যার পক্ষেই কাজ করে। তাহলে কার শত্রু বিভীষণ? যে রামের জন্য পাঠক উতলা সে রামের জন্য কাজ করা চরিত্রটিকেই একেবারে বিশ্বাসঘাতকতার চরম উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন। বিভীষণকে যদি কেউ নেতিবাচক বলেই থাকে তাহলে বলতে পারে রাবণের পক্ষের লোক। অথচ সমগ্র ভারতবর্ষ যারা কিনা রামের পূজারি, তারাই বিভীষণকে বলছি বিশ্বাসঘাতক। এখানেও কি গাত্রবর্ণ আর গড়ন আমাদের মাইন্ডসেটকে পরিচালিত করেছে।
তবে সে যাই হোক, সে রামও নেই সেই অযোধ্যাও যখন নেই, সে রাবণ বা পার্বতীও বহুদূর। এরচেয়ে ঢের ভালো নরম কুয়াশা মাখা শিউলি তলার আশ্বিনের ভোর। পরিপাটি নীল আকাশের নিচে হঠাৎ উড়ে আসা দুয়েকটা কাশের পাপড়ি। এই সুন্দর সময়ে সবাই মিলে যদি পৃথিবীর মঙ্গলবন্দনায় একটা উৎসব করাই হয়, এর চেয়ে ভালো তাহলে আর কি বা হতে পারে!
এই নব্য হানাহানির পৃথিবীতে মানবের মঙ্গল বন্দনার শারদীয় উৎসব কি শুধুই একটি বিশেষ ধর্মের নিজস্ব উপাচার হিসেবেই থেকে যাবে ? এখনও একে সার্বজনীন একটি বাঙালি উৎসবে রূপ দেয়ার সময় কি আসেনি?

পুনশ্চ : যেকোনো ধর্ম বিষয়ে জানতে গেলে যে বিপুল পরিধি নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়, স্বীকার করছি আমার পড়াশোনার পরিধি ততটা নয়। তারপরও যেটুকু পড়েছি তার ভিতর দিয়েই কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে মনে, যারই সামান্য অবতারণা করা হলো এখানে। এটা সম্পূর্ণই আমার ব্যক্তিগত মতামত। আশা করছি এতে ধর্মীয় অনুভূতিতে দাগ দেয়ার মতো কিছু নেই।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১০:৩৭
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×