somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাজের মেয়ে!

১৬ ই মে, ২০১৬ সকাল ৮:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শিরোনাম দেখে মনে হতে পারে অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমজীবি অর্থাৎ গৃহকর্মীদের কথা বলছি। না বিষয়টা তেমন না। বলছি আমার কথা অথবা আপনার কথাও। অথবা আপনারই পরিবারের বোন, স্ত্রী বা এমন কোন মেয়ের কথা, যে মেয়েটি কাজ করে। শুধু ঘরের কাজ নয়, ঘরের বাইরেও কাজ করে এবং উপার্জন করে। একটা সময় ছিল যখন এদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। দিন বদলেছে। এবং দিন বদলের এই চিত্র খুব সহজেই বোঝা যায় যখন দেখি বেড়েছে কর্মজীবি নারীর সংখ্যা। উচ্চ, মধ্য বা নিম্নবিত্তের বিচারে যে কয়ভাগই থাকনা কেন সমাজে, সব ভাগেই বেড়েছে শ্রমজীবি মেয়ের সংখ্যা। হয়তো প্রথম ভাগের মেয়েরা সুযোগ পেয়েছে বিদেশে পড়ার, ছোটবেলায় দেশের ইংরেজি মাধ্যমে। এখন ঠিক ঠিক দেশে ফিরে কাজ করছে। মাঝের ভাগ চিরাচরিত বাংলা মাধ্যম। দেশের কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই যতটা সম্ভব শিখে নিয়েছে। খুব বেশি মেধাবীরা বৃত্তি নিয়ে বিদেশেও পড়েছে। এখন কাজ করছে দেশেই। আর শেষ অংশের যারা পড়াশোনা হোক বা না হোক, দেশ পাল্টে দেয়া বিপ্লব এনেছে নিপুন আঙ্গুলে, সুই সুতার ফোঁড়ে। ঘুরে ফিরে সবাই কিন্তু কাজের মেয়েই। একজন একজন করে দেখতে গেলে দেখা যাবে এদের সবার পেছনে একটা করে গল্প আছে। গল্প বাঁধা ডিঙ্গোবার, গল্প প্রতিকূলতা জয় করার।

মাত্র কয়েক বছর আগেও যে দেশে স্কুল পাশ মেয়ের সংখ্যাই ছিল সামান্য। কয়েক দশকের ব্যাবধানে সেখানে কর্মজীবি মেয়ের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া একটা ঘটনাই বটে। ঘটনাতো ঘটে গেছে কিন্তু গভীরভাবে খেয়াল করলে দেখা যাবে সমাজ, পরিবার কতটা সহায়ক হয়েছে এই মেয়েদের পক্ষে। হয়তো একটা সময় ছিল মেয়েরা কাজ করতো শখে অথবা অমুকের মেয়ে, তমুকের স্ত্রীর পাশাপাশি একটা বাড়তি আইডেন্টিটির জন্য। এখন কিন্তু বিষয়টা এর মধ্যে সীমিত নেই। মেয়েরা কাজ করে এখন প্রয়োজনে। যুগের সাথে চাহিদা বেড়েছে। বেঁচে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজনগুলো হয়ে উঠেছে ব্যয়বহুল। বিভিন্ন জরিপেই বলে দেয় ব্যয়বহুল শহরগুলোর তালিকার প্রথম দিকে আছে ঢাকা। সুতরাং একজনের আয়ে আর চলছেনা, কাজ তাই আমাদের করতেই হবে। আমরা করছিও। মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী একদম অফিসপ্রধান থেকে শুরু করে যেকোন পদে, সরকারে, অসরকারে বা উন্নয়নে। কোন ছাড় না দিয়ে দিনে ন্যূনতম আটঘন্টা, সপ্তাহে নিদেনপক্ষে পাঁচদিন, মাসে কুড়ি বা একুশ দিন। ঠিক আছে। এরপর ফিরি ঘরে। শুধু অফিস করলেতো আবার হবেনা। বাড়িতে আমি আছি, গিন্নি আছেন, আছেন আমার পাঁচ ছেলে, সবাই মিলে কামড়ে দিবে যদি সবকিছু ঠিকঠাক না মেলে। হয়তো ব্যাপারটা এতোটা ভয়াবহ না, কিন্তু ছোট হোক বড় হোক সংসার, সেতো সামলাতেই হয়। তাই যতই অফিসে কাজ করুক,যতই ভালো হোক পারফর্মেন্স, দিনশেষে তার কাছে প্রত্যাশা কোন অংশে কম নয়। এরপর আছে আত্মীয়, স্বজন, বন্ধু বান্ধবদের অভিযোগ বাসায় গেলে পাওয়া যায়না, একটা ফোনও কখনো দিলানা, ফোন করলাম ধরলা না, ওমুকের ম্যারেজডেতে গেলানা, তমুকের অসুখ দেখতে গেলানা, অন্তত শুক্রবারে তো একটা ফোন করতে পারো। আমি পুরুষবিদ্বেষী নই, কিন্তু তারপরও বলবো এই অভিযোগগুলো কিন্তু পুরুষের প্রতি এতটা হয়না, যতটা হয় নারীদের প্রতি। এবং অভিযোগকারীরা শুধু পুরুষ নয়, আশ্চর্যজনকভাবে এইভাগেও মেয়েদের সংখ্যা বেশি। একদিন দুপুরে এক বন্ধু ফোন দিল, মিটিং এ ছিলাম সুতরাং কথা বলতে পারিনাই। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে রান্নাবান্না শেষ করে একটু সময় বের করে ফোন দিলাম। ফোন দেয়ামাত্র আমার বন্ধুর হাজারটা অভিযোগ শুনতে হলো, দীর্ঘদিন তার কোন খবর নেই না বলে। অতপর সে নিজের থেকেই বলে গেল তার পরসমাচার। একটা সার্বক্ষণিক আর একটা পার্টটাইম গৃহকর্মী নিয়ে সে ক্লান্ত দু দুটো বাচ্চার যত্ন নিতে, রান্নাবান্না করতে। সারাদিনে একটুও সময় পায়না! তার উপর সেদিন ভুলেই গেছে বড় বাচ্চাটাকে ওষুধ খাওয়াতে। অথচ আমরা কেউ একটু তার খবর নিলাম না! ধৈর্য্য ধরে মন দিয়ে শুনলাম ওর কথা। নিজের কথা বাদ দেই, ভাবতে থাকলাম আমার এক সদ্য বিধবা সহকর্মীর কথা। যে কিনা, এই ঢাকা শহরেই অফিস করে আবার দুটো মেয়ে তার স্কুলে পড়ে, বাসায় কোন গৃহকর্মী নেই। কিভাবে তাইলে সে সব ম্যানেজ করে? এরকম অনেক একলা মা আছেন, যারা একই সঙ্গে মা এবং বাবার ভূমিকা পালন করেন। তাদের হাত পা মাথা বা সময় কোনটাই অন্য কারো চেয়ে বেশি নাই। তারপরও তারা পারছেন।

মাসখানেক আগে কর্মজীবনের ১০ বছর পূর্ণ হয়েছে আমার। এই দশবছরে অভিজ্ঞতা কম হয় নি। কম দেখিনি আমার নারী সহকর্মীদের লড়াই। আমার সহকর্মীদের ভেতর আমি দেখেছি নারীর শক্তি, নারীর সাহস। এই নারীরা অফিস করে, বাসা করে, মা হয়, এরপর স্কুলও করে। সবকিছু একহাতে সামলায়। চার মাসের বাচ্চাকে বাসায় রেখে এসে অফিস করে। তার বাচ্চাও মানুষ হয়, পাশের বাড়ির ভাবিদের বাচ্চাও মানুষ হয়। কর্মজীবি মায়েদের বাচ্চারাও স্কুলে পড়ে, স্কুলের সামনে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বসে থাকা মায়েদের বাচ্চারাও স্কুলে পড়ে। রান্নার স্কুলে রান্না শেখা ভাবিদের বাচ্চাদেরও ভুল হয়, দুই একজনের কাছে প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তি মিলেনা। কর্মজীবী মায়েদের বাচ্চারাও দু একজন অন্যরকম হতেই পারে। কিন্তু দোষ তখন মায়ের, দোষ মায়ের কাজের!

আগেই বলেছি এখন মেয়েরা কাজ করে প্রয়োজনে। বাড়তি আয়ের জন্য নয়। বরং কখনো সখনো মূল আয়ের জন্যই। তারপরও কথায় কথায় শুনতে হয় ‘চাকরী ছেড়ে দিলেই পারো’। কারা বলে? এবারো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েরাই বলে। বাড়িতে কোন কিছুর উনিশ বিশ। ব্যাস! এর মূলে যেন মেয়েটির চাকরি। ছেলেরা অফিস ট্যুরে গেল ঢাকা বা দেশের বাইরে। কোন অসুবিধা নেই বরং তৃপ্তির ঢেঁকুর, বড় চাকরি করে! কিন্তু মেয়েটা গেল! তখন আসবে ‘কি দরকার ছিল’! অথচ কেউ ভাবেনা, নিজের ঘর ছেড়ে, বিছানা বালিশ ছেড়ে, কাছের মানুষদের ছেড়ে দূরে যেতে একটা মেয়েরও কতটা কষ্ট হয়।

আমরা কথায় কথায় নারী মুক্তির কথা বলি, নারীর ক্ষমতা, নারীর সমতা, নারীর সাম্যতা নিয়ে বক্তৃতা বিবৃতি দেই। সব কিছুই দরকার। দরকার নারীর এগিয়ে আসার, দরকার সমাজের আচরন পরিবর্তন তেমনি দরকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন। সকালবেলা গাড়ি নেই এমন একজন পুরুষ যেই কষ্ট করে অফিস ছোটেন একজন নারীও সেই একই কষ্ট করেই অফিস যান। উন্নত দেশে নারী পুরুষ সমানে সমান, অন্তত বাহ্যিকভাবে। সেই দেশের নারী বা পুরুষ কাউকেই এতটা কষ্ট করে মুড়ির টিন বাসে ঝুলে, ঘন্টা খানেক সময় নষ্ট করে সিএনজি পেয়ে অফিস পৌছতে হয়না। এই যে সকাল বেলা দুই ঘন্টা আর বিকেলবেলা দুইঘন্টা এই চার ঘন্টার যুদ্ধে কিন্তু আমাদের কর্মশক্তি কমে যায় অনেকখানি। এমনিতেই আমাদের দেশের আবহাওয়া খুব সহজেই ক্লান্ত করে দেয় তার উপর এই রকম প্রতিদিন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়তে একজন পুরুষের জন্য রাষ্ট্রের যত খরচ হয়, একজন নারীর জন্যও সেই একই খরচ। তারপরও দেখা যায় নারীদের একটা বড় অংশ লেখাপড়া শেষে কর্মজীবনে যুক্ত হন না অথবা হতে পারেন না। হয়তো পরিবার থেকে সমর্থন থাকেনা কিংবা অনেক সময় নিজেও আগ্রহী হন না। সবথেকে বড় বাস্তবতা হলো নারীর জন্য কাজের সুযোগও কম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী নিয়ে একটা মেয়ের যখন জীবনের সবচেয়ে কর্মক্ষম সময়টা ব্যয় করতে হয় অনুৎপাদনশীলখাতে, সেটা বড় বেদনার। ঘরের কাজের আর্থিক মূল্যায়ন অনেক দিন ধরেই করা হচ্ছে, হবে বলে এখনও করা হয়ে ওঠেনি। ঘরের কাজ মানে রান্নাবান্না, সন্তান পালন, পরিবারের দেখভাল করা, সন্দেহ নাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যারা দিবানিশা এই ব্যস্ততার ভেতর আছেন, কোন স্বীকৃতি ছাড়া তাদের প্রতি শ্রদ্ধা। আর যারা সেই যে সপ্তাহে ৪০ ঘন্টা অফিস করেন আবার ঘরে ফিরে ঘরকন্না করেন তাদেরই বা স্বীকৃতিটা কোথায়? নিজের শিক্ষাটা যারা কাজে লাগাতে চান, পরিবারকে আরেকটু ভালো রাখতে চান, আরেকটু সাম্যের জীবন চান সে যেই পটভূমি থেকেই উঠে আসুক না কেন কষ্টটা তার অনেক বেশি।

এরপরও কোন কষ্টই কষ্ট থাকেনা যদি স্বীকৃতিটা পাওয়া যায়। একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। একটা মেয়ের অফিসে পারফর্মেন্স এপ্রাইসাল চলছে। সারা বছরের কাজের মূল্যায়নে কোথাও লাল আঁচড় দেয়ার সুযোগ নেই। এপ্রাইসালের শেষ পর্যায়ে আসলো ইনক্রিমেন্টের বিষয়টা। মেয়েটাকে হতবাক করে দিয়ে বস বললেন, আপনার বেতন বাড়ার কি দরকার, আপনার স্বামীরতো অনেক বেতন! এখানেই শেষ নয়। অবাক হলেন, ভাবছেন নিশ্চয়ই কোন পুরুষ বসের বাণী এটা। না, ভুল করলেন, সেই বসও একজন মেয়ে!

তারমানে ঘরে বাইরে নারী পুরুষ কারো কাছেই যেন স্বীকৃতি নেই এইসব কাজের মেয়েদের! তারপরও এরা আছেন, আমি আছি, যারা স্বপ্ন দেখি পাল্টে যাবে দিন, পাল্টে যাবে দেশ।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৬ সকাল ৮:৫৯
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

×