শেখ আবুল কাসেম মিঠুন
সেই ১১ বছর বয়সে একই সঙ্গে বাপ-মার মৃত্যুর পর তিনি জীবনের আরো ২১টি বছর পার করে এসেছেন- একদিকে মাদরাসার ধর্মীয় এবং নৈতিক শিক্ষা, অন্যদিকে বাপ-দাদাদের জিহাদী রক্তের তেজ ও পারিপার্শ্বিক ঘাত-প্রতিঘাত। তিনি তীব্রভাবে অনুভব করেছেন মুসলমানদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও চিন্তাচর্চার ক্ষেত্রে পশ্চাদপদতা এবং দৈন্য। তিনি পলকে পলকে লক্ষ্য করেন মুসলমানরা জানেনা তাদের ঐতিহ্য ও উৎপত্তির উৎস কোথায়, জানেনা কেন তারা খ্রিষ্টান ও বর্ণহিন্দুদের পদানত কিংবা দেশীয় হিন্দুদের চেয়ে কতশতগুণ অনগ্রসর।
তিনি একসময় রোজগারের মাত্র ৬০ টাকা নিয়ে পত্রিকা প্রকাশে নেমে পড়েন। ১৯০৩ সালের ১৮ আগষ্ট প্রথম পত্রিকা “মোহাম্মদী”র প্রথম সংখ্যা তিনি প্রকাশ করেন। একটি মাত্র সংখ্যা বের করে প্রেসমালিক আর দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশে সম্মতি দেননি। দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ। অনেক সংগ্রাম, কষ্ট, দুশ্চিন্তা ও পরিশ্রমের পর মহান আল্লাহতাআলা তাঁকে সুযোগ করে দেন। হাজী আলতাফের “আলতাফী” প্রেস থেকেই তিনি ‘মোহাম্মদী’ প্রকাশ করতে শুরু করেন।
আবু জাফর সম্পাদিত “ মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ-তে বলা হয়েছে “আলতাফী প্রেসের” স্বত্বাধিকারী ছিলেন মাওলানা আবদুল্লাহ যিনি ধনী তেল ব্যবসায়ী এবং মাওলানা আকরম খাঁর পিতৃবন্ধু ছিলেন। যাই হোক- “তাঁর আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় প্রাণান্তকর কায়িক পরিশ্রম করে নিজের কর্তৃত্বাধীনে সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী’র প্রকাশ অব্যাহত রাখতে চেষ্টা করেন।” সাপ্তাহিক মোহাম্মদী ছাড়াও তাঁর মালিকানায় ও সম্পাদনায় পরবর্তীতে যে সব পত্রিকা প্রকাশ করেন সেগুলো হলো যথাক্রমে- ১. দৈনিক জামানা,[১৯২০] ২. সাপ্তাহিক ও দৈনিক সেবক [১৯২১] ৩. দৈনিক মোহাম্মদী [১৯২২] ৪. মাসিক মোহাম্মদী [১৯২৭] ৫. দৈনিক আজাদ [১৯৩৬] ৬. সাপ্তাহিক কমরেড [১৯৪৬] ৭. মাসিক আল-এসলাম [১৯১৫] ইত্যাদি।
উল্লিখিত পত্রিকাগুলো প্রকাশ করে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ শুধু যে মুসলমানদের সজাগ করেছেন, তাদের চেতনে ফিরিয়ে আনায় সাহায্য করেছেন তা নয়, মুসলিম সাংবাদিকতাকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এজন্যই দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ লিখেছেন, “তাঁকে মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার পথিকৃৎ এবং জনক হিসাবে অভিহিত করা যায়।”
“পত্রিকাগুলো প্রকাশের পাশাপাশি জোরালো লেখনী পরিচালনা করে তিনি তাঁর সমকালীন হতাশাগ্রস্ত মুসলমানদের জাগ্রত করেন এবং প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত করেন।” এসকল সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনমত গড়ে তুলে তিনি মুসলমানদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় পশ্চাদপদতা এবং কুসংস্কার-এর মূলে আঘাত করে তাদের সামনে সামগ্রিক উন্নতির নতুন দ্বার উন্মোচন করতে সক্ষম হন।
সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেই মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ প্রথমেই ঘরের কোন্দল মিটানোর প্রয়াস চালান। তিনি ছিলেন জ্ঞানী এবং সাংবাদিকতার পাশাপাশি অর্থ বুঝে বুঝে কোরআন ও হাদীস পড়ে সে বিষয়েও বিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি হিন্দু ও খ্রিষ্টানদের ষড়যন্ত্রে সৃষ্ট “মাযহাব” কোন্দলের সময় নিজে ‘আহলে হাদিস’ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। মূলত তিনি তাঁর পিতার মত সৈয়দ আহমদ বেরলভীর চিন্তা ও দর্শনে অনুপ্রাণিত ছিলেন। এবং তাঁর সমর্থক ছিলেন। “যে ওহাবী আন্দোলন একসময় সমগ্র ভারতে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়েছিল মাওলানা আকরম খাঁ সেই ওহাবীদেরই একজন, তাই তিনি মোহাম্মদী এবং তাহার পত্রিকার নামও “মোহাম্মদী”।
মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ আসলে মুসলমান দরদী ছিলেন। তাই মুসলমানদের সংকীর্ণ চিন্তাধারা থেকে মুক্ত করে মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তা চর্চার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন। তাঁর প্রথম পত্রিকা ‘মোহাম্মদী’কে তিনি বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতার বাহনে পরিণত করেন। ইতিপূর্বে হানাফী মাযহাবের আলেমগণ, আহলে হাদিস সম্প্রদায় সম্পর্কে যে সমালোচনা করতেন প্রধানত তার প্রত্যুত্তর দেয়াই ‘মোহাম্মদী’র উদ্দেশ্য ছিল। ফলে পত্রিকাটি পূর্বোক্ত সংকীর্ণ মতের পরিবর্তে অখন্ড মুসলিম সমাজের ঐক্য ও উন্নতি সাধনের মুখপত্রে পরিণত হয়।” আহলে হাদিস সম্প্রদায়ের মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তা চর্চার পরিবেশে প্রথম পর্যায়ে মাওলানা আকরম খাঁর রাজনৈতিক চেতনা গড়ে ওঠে এবং তিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৯১৩ সালে সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকার মাধ্যমে প্রচারাভিযান চালিয়ে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ বাংলার বিভিন্ন মাযহাবের আলেমগণকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। এর ফলে গঠিত হয়, “আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা” নামক আলেম সংগঠন। এ সংগঠনের মুখপত্র হিসাবেই তিনি ১৯১৫ সালে “আল-এসলাম” নামক মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন।
প্রকৃতপক্ষে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ সক্রিয় রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করেন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। তিনি প্রথমে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি ভাবতেন বৃটিশ খ্রিষ্টানরাই মুসলমানদের সকল দুর্দশার কারণ। ভারতকে বৃটিশ খ্রিষ্টানদের হাত থেকে মুক্ত করতে পারলে মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা সহজ হবে। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে তিনি পরিবর্তন করেন। কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতার বর্তমান বাস্তব আলোকে তিনি স্থির বিশ্বাসী হলেন যে হিন্দুরা স্বভাবগত কারণেই মুসলমানদের মঙ্গল চায় না। কোন মুসলমান ইসলামের সঙ্গে বেঈমানী করে যদি হিন্দুধর্মের লোকদের মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে চায়, ভালবাসে, তাদের সঙ্গে মিশতে চায় তবুও সেই মুসলমানকে হিন্দুরা অন্তরে ঘৃণা ও অবিশ্বাসের সঙ্গেই দেখে থাকে। মুসলমান যতই উদার মন নিয়ে হিন্দুদেরকে আপন ভ্রাতা হিসাবে গ্রহণ করতে চাউক না কেন, হিন্দুরা তাকে কখনোই আপন ভাবে না। কারণ হয়তোবা তৌহিদ ও শিরকবাদের চিরন্তন বিপরীত মেরুতে অবস্থান। তাই মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। কোরআন ও হাদীসের জ্ঞান তাঁকে মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। তিনি স্বপ্ন দেখতেন মুসলমানদের মন-মানসিকতা থেকে কুসংস্কার ও সংকীর্ণতা দূরীভূত হোক। সঠিক ইসলামী চেতনায় তারা উদ্বুদ্ধ হোক। মুসলমানরা জীবনের সর্বক্ষেত্রে সম্মানের সঙ্গে প্রতিষ্ঠা পাক এবং জয়লাভ করুক। তিনি স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি স্বপ্ন পূরণের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। যেখানেই দেখতেন মুসলমানদের স্বার্থের অনুকূলে কোন কাজ হচ্ছে, কোন পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে বা কোন সংগঠন হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার সাথে নিজেকে যুক্ত করে ফেলতেন। স্বপ্ন পূরণের এটাই বাস্তব পদক্ষেপ। মুসলমানদের স্বার্থরক্ষাই ছিল তাঁর একমাত্র ব্রত। এইভাবে তিনি অসহযোগ আন্দোলন [১৯২০-২২], খিলাফত আন্দোলন [১৯২০-২২], প্রজা আন্দোলন [১৯১৪-৩৬] এবং পাকিস্তান আন্দোলনে [১৯৩৭-৪৭] সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে মুসলিম দরদী এবং বাংলাভূখন্ডের মুসলমানদেও মাযহাবী কলহ-কোন্দল দূর করে তাদের মধ্যে একতাবোধ ও রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টিতে, তাদেরকে জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত করে রাজনৈতিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার নৈতিক ও মানসিক শক্তি যোগাতে তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।”
উক্ত সংগঠনগুলিতে তিনি শুধু নিজেকে যুক্ত করেননি বরং নেতৃত্ব দান করেছেন। মুসলিম সমাজকে অন্ধকার ও কুসংস্কার থেকে উদ্ধার করে সত্যিকার আলোকময় ইসলামী পথের পথিক করতে তিনি ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমান ও সমাজ হিতৈষী আলেমশ্রেণীকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করেন, “আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা”। তিনি তার সম্পাদক নিযুক্ত হন। সে সময় খ্রিষ্টান ও হিন্দুদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিষ্পেষণে মুসলমানরা আত্মকেন্দ্রিক, সংকীর্ণ চিন্তাধারা এবং কুসংস্কারে ডুবে গিয়েছিল। কঠিন চাপে বস্তু যেমন বিকৃত হয়ে যায়, তেমনি মুসলমানদের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে গিয়েছিল বিকৃত। বিভিন্ন ধরণের অনৈসলামিক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন কর্মকান্ডে অংশ নিয়ে মুসলিম সমাজ ইসলাম থেকে তো দূরে সরেছিলই উপরন্তু চরম অধ:পাতে পৌছেছিল। সত্যিকার ইসলামী জ্ঞান ও আধুনিক পৃথিবীর কোন ধ্যান-ধারণা তাদের ছিল না। অন্যদিকে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যাদানকারী, অজ্ঞ, সংকীর্ণমনা আলেমদের খপ্পরে পড়ে মুসলমানরা ধীরে ধীরে সমাজের নিম্মশ্রেণীর মানবগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল।
মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ যখন তাঁর সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার আধুনিকীকরণ এবং নারী-শিক্ষার দিকে দৃষ্টি দেন এবং প্রভূত সফলতা অর্জন করেন তখন ‘অজ্ঞ আলেম’ শ্রেণী “আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা”কে ‘কাফির’ ফতওয়া দেন। এতদসত্ত্বেও মাওলানা আকরম খাঁর অবিরাম প্রচেষ্টায় মাত্র চার বছরের মধ্যে সংগঠনটি ১৩ জন বেতনভোগী ও ১৪ জন অবৈতনিক “মুবাল্লেগ” [ধর্ম প্রচারক] নিয়োজিত করতে সক্ষম হয়।(চলবে)।