শেখ আবুল কাসেম মিঠুন
(৪র্থ কিস্তি) মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ যখন তাঁর সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার আধুনিকীকরণ এবং নারী-শিক্ষার দিকে দৃষ্টি দেন এবং প্রভূত সফলতা অর্জন করেন তখন ‘অজ্ঞ আলেম’ শ্রেণী “আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা”কে ‘কাফির’ ফতওয়া দেন। এতদসত্ত্বেও মাওলানা আকরম খাঁর অবিরাম প্রচেষ্টায় মাত্র চার বছরের মধ্যে সংগঠনটি ১৩ জন বেতনভোগী ও ১৪ জন অবৈতনিক “মুবাল্লেগ” [ধর্ম প্রচারক] নিয়োজিত করতে সক্ষম হয়। এই মুবাল্লেগদের অব্যাহত প্রচারের ফলে বাংলার মুসলমানগণ শুধু ধর্মীয় বিপর্যয়ের হাত থেকেই রেহাই পায়নি বরং শিক্ষা, সমাজ ও স¤প্রদায়গত স্বার্থের দিক দিয়েও উপকৃত হয়। মুবাল্লেগগণ “খাঁটি ইসলাম” প্রচার ও ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি মুসলমানদের [ক] সাধারণ শিক্ষার প্রতি উদ্বুদ্ধকরণ [খ] মামলা-মোকাদ্দমার কুফল সম্পর্কে জ্ঞানদান ও যথাসম্ভব চালু মোকাদ্দমা আপোষ করে দেয়া [গ] একতার প্রয়োজনীয়তা এবং পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের কুফল বিশদভাবে বুঝিয়ে দেয়া [ঘ] অপব্যয় ও সুদী ঋণ গ্রহণের পরিণাম সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া [ঙ] স্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ প্রভৃতি সমাজকল্যাণমূলক দায়িত্বও পালন করতেন।
আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালার প্রচেষ্টায় মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ ও ঝগড়াঝাটির পরিসমাপ্তি ঘটেছে, তাদের পারস্পরিক শতশত মোকাদ্দমার নিষ্পত্তি হয়েছে। এবং মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যভাব এবং জাতীয়তাবোধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ১৯১৭ সালে বিহারের দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকায় মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ছুটে যান এবং মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাদীর সহায়তায় বত্রিশ হাজার টাকা সংগ্রহ করে দু’মাস অবধি ঘটনাস্থলে অবস্থান করে ক্ষতিগ্রস্ত, দু:স্থ মুসলমানদের মধ্যে উক্ত অর্থ বন্টন করেন। এ ছাড়াও বন্যাপীড়িতদের মধ্যে রিলিফ ঔষুধপত্র বিতরণ করে “আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা” জনসেবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বাংলা ভূখন্ডে এন. জি. ও তথা খ্রিষ্টান ও হিন্দু মিশনারীরা যা করতো- মাওলানা আকরম খাঁর “আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাঙ্গালা” মুসলমানদের মধ্যে সর্বপ্রথম সে কাজের সূচনা করে। ফলে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে এক নব জাগরণের সূত্রপাত হয়। মুসলমানরা হিন্দু ও খ্রিষ্টান স¤প্রদায়ের সঙ্গে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মানসিক ও নৈতিক শক্তি ফিরে পায়।
মুসলমানদের ক্ষতি হতে পারে বা তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে পারে এমন কথা ও কাজ মাওলানা আকরম খাঁ করতেন না বা বলতেন না। আর কেউ যদি মুসলমান হয়ে মুসলমানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করতো তাকে তিনি ছাড়তেন না। পত্র-পত্রিকায় লেখনীর মাধ্যমে বা জনসভায় ভাষণ বক্তৃতার মাধ্যমে তিনি তার প্রতিবাদ করতেন। যাকে শেরে বাংলা বলা হয় সেই এ.কে ফজলুল হককেও তিনি ছাড়েননি। পূর্বে বলা হয়েছে ‘হিন্দু মহাসভা’ ‘আর্যসভা’- এসব দলগুলি ছিল প্রচন্ড মুসলিম বিদ্বেষী। ‘হিন্দু মহাসভা’ ‘আর্যসভা’ জোর করে মুসলমানদেরকে হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করতো। এই কাজটি বৈধ করার জন্য সরকারি আইনসিদ্ধ করার প্রয়োজন ছিল। তাই তারা প্রথমে সাংগঠনিকভাবে ব্যাপারটিকে বৈধ করার চেষ্টা করে। ‘হিন্দু মহাসভা’ ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত হিন্দু মহাসভার অধিবেশনে ভারতীয় মুসলমানদের জোরপূর্বক হিন্দুধর্মে দীক্ষিত করার আবেদন জানিয়েছিল।
মুসলমান নেতৃবৃন্দ হিন্দু মহাসভার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন। মুসলমান নেতাদের প্রতিবাদের ফলে “১৯২৩-২৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে অনেকমুসলমান নেতৃবৃন্দ হিন্দু মহাসভার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন। মুসলমান নেতাদের প্রতিবাদের ফলে “১৯২৩-২৭ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে অনেকগুলি হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সংঘটিত হয়, অনুষ্ঠিত হয় গণহত্যা।” ১৯৪১ সালে এ.কে ফজলুল হক এই হিন্দু মহাসভার মত প্রচন্ড মুসলিম বিদ্বেষী ও ইসলামের চিরশত্র“র সঙ্গে একাত্ম হয়ে মুসলিম লীগ বিরোধীদের সমন্বয়ে প্রগ্রেসিভ [প্রগতিশীল] কোয়ালিশন পার্টি গঠন করে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১৯৪১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ মুসলিম লীগের এক জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে ফজলুল হকের ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ তীব্র নিন্দা করেন। বলেন, ৪০ বছর কাল মি: হক মুসলিম স্বার্থ নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছেন। প্রত্যেক সঙ্কটকালে তিনি শত্র“দলে যোগদান করে বাঙ্গালী মুসলমানের মুখে কালী দিয়েছেন।
অবশ্য নিখিল ভারত মুসলিম লীগ সভাপতি জিন্নাহ ফজলুল হককে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করেন এবং ১৯৪১ সালের ১৭ ডিসেম্বর সে স্থলে লীগ সভাপতির কাজ পরিচালনার জন্য সমস্ত ক্ষমতা মাওলানা আকরম খাঁর উপর ন্যস্ত করেন। মাওলানা আকরম খাঁ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দীকেও ছাড়েননি। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং মুসলিম লীগ বিপুল বিজয় অর্জন করে। ২রা এপ্রিল মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টি সর্বসম্মতিক্রমে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দীকে নেতা নির্বাচন করে। সোহরাওয়ার্দ্দীও এ.কে ফজলুল হকের পথ অনুসরণ করেন। তিনি কংগ্রেস ও হিন্দুমহাসভার সঙ্গে কোয়ালিশন গঠনের আগ্রহ ব্যক্ত করেন। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ তাঁর দৈনিক আজাদে সোহরাওয়ার্দ্দীর এই আগ্রহকে মুসলিম বাংলার প্রতি তার বিশ্বাসঘাতকতার ও মন্ত্রিত্বকে নিরাপদ করার মতলব হিসাবে অভিহিত করেন। শেষ পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দ্দী কয়েকজন অকংগ্রেসী ও স্বতন্ত্র মুসলমান সদস্য নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন।”
১৯৪৬ সালের ১৬ আগষ্টকে জিন্নাহ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ঘোষণা করেন। ফলত কলিকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বাঁধে এবং তা অচিরেই বাংলার অন্যান্য অংশ, পার্শ্ববর্তী বিহার ও মোম্বাইয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী তখন প্রাদেশিক মন্ত্রী। নোয়াখালীতে ৮৬ জন হিন্দু নিহত হয়।
“কলকাতায় হিন্দু পরিচালিত সংবাদপত্রগুলো নোয়াখালীর খবর অতিরঞ্জিত করে প্রচার করে।” “সোহরাওয়ার্দ্দী সরকার সে সময় হিন্দু পরিচালিত সংবাদপত্রগুলোর অতিরঞ্জিত খবর পরিবেশনের উপর কোন বিধি নিষেধ আরোপ করেনি।” পক্ষান্তরে “মুসলিম সংবাদপত্রগুলোর সংবাদ প্রকাশে বিধি নিষেধ আরোপ করে।”ফলে মুসলমানরা হিন্দুদের হত্যা করেই চলেছে, এই খবরটাই দেশে বিদেশে প্রচার হতে থাকে। এতে হিন্দুরা আরো উত্তেজিত হয়ে ওঠে এবং মুসলমান নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠে। তখন বিহারে হাজার হাজার মুসলমান অত্যন্ত অমানবিক ও নিষ্ঠুরপন্থায় নিহত হয়।
সোহরাওয়ার্দ্দীর এই মুসলিম হত্যা এবং উল্টো মুসলিমদেরকে হত্যাকারী এবং দাঙ্গাবাজ হিসাবে কলঙ্ক লেপনের কৌশল দেখে মুসলিম বিবেক শিউরে ওঠে। মুসলিম দরদী, বাংলার মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় নেতা মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর প্রাণ কেঁদে ওঠে, মুসলমান হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত কৌশল অবলম্বন করায় তাঁর লেখনী প্রতিবাদ করে ওঠে- “আমি মনে করি মোছলেম বিহারের এই বিপদের জন্য প্রথম অপরাধী হইতেছেন বাংলার মোছলেম লীগ গবর্ণমেন্ট ও তাহার একমাত্র স্বত্বাধিকারী মি: হোছেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী।”
বর্ণিত দাঙ্গা ঘটানোর অপরাধে বহু মুসলমানকে সোহরাওয়ার্দ্দী গ্রেফতার করেছিলেন। সেজন্য ঐ সময়ে সোহরাওয়ার্দ্দী এবং আবুল হাশিম মুসলিম লীগের মূল স্রোত থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। সোহরাওয়ার্দ্দীওর øেহধন্য আবুল হাশিম ছিলেন বর্ধমান জেলা মুসলিম লীগ সভাপতি। ১৯৪৩ সালে ৬ নভেম্বর দলীয় নির্বাচনে তিনি দলের প্রাদেশিক সেক্রেটারী নির্বচিত হন। প্রথমদিকে হিন্দুয়ানী বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী হলেও পরবর্তীতে মুসলিম বাংলার সংস্কৃতির সমর্থক হন এবং ইসলামী চিন্তাবিদ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন।
কুমিল্লায় দাঙ্গা ঘটানোর অপরাধে [!] “সোহরাওয়ার্দ্দী সরকার বহু মুসলমানকে গ্রেফতার করেছিল। মাওলানা আকরম খাঁ সেই সব হতভাগ্য নিরপরাধ মুসলমানদের জেল থেকে মুক্ত করার জন্য অনেক চেষ্টা তদবীর করেন। দাঙ্গায় বিধ্বস্ত, হতাশাগ্রস্ত মুসলমানদের মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য ২২ ডিসেম্বর, ১৯৪৬ সালে কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে একটি সভার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মুসলিম লীগের পতাকা উত্তোলন কালে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ বলেন, “আল্লাহর নামে এই পতাকা উত্তোলন করছি। ভারতের দশকোটি মুসলমানের ইজ্জত এর সঙ্গে জড়িত, শির গেলেও ইজ্জত যেন না যায়, এটাই আমাদের সংকল্প। সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, “ইসলামের জন্য মুসলমান জাতির জন্য যা কিছু করার দরকার তা কোরবানী করার সংকল্প আমাদের গ্রহণ করতে হবে।...মুসলমানদের ন্যায্য অধিকার আদায় করা সম্ভবপর হবে ভালবাসার দ্বারা অন্যথায় প্রয়োজনীয় শক্তি প্রয়োগে অর্জন করতে হবে।”
উপরোক্ত ঘটনাবলী থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ মুসলমানদের পক্ষে যে অকল্পনীয় লড়াই চালিয়ে গেছেন তা এককথায বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তিনি জয়ী হয়েছিলেন সে লড়াইয়ে, তাই আজো বাঙ্গালী মুসলমান যারা ইসলামী সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী তারা বাঙ্গালা এবং নামধারী মুসলমানদের হিন্দু সংস্কৃতির বিরুদ্ধে জযলাভ করে টিকে আছে। হয়তো বা যখন একজন সত্যিকার মুসলিম নেতার অভাবে এ দেশের বাঙ্গালী মুসলমান-বাঙ্গালী হিন্দু সংস্কৃতির মধ্যে এতদিনে হারিয়ে যেতো।
১৯৪৭ সালে মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমি হিসাবে “পূর্ব-পাকিস্তানের” স্বাধীনতা শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী ও আবুল হাশিম চাননি। যদিও দু’জনেই ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা। সে সময় সোহরাওয়ার্দ্দী ছিলেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী। অখন্ড বাংলা খন্ডিত হয়ে মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র “পূর্ব পাকিস্তান” হোক উক্ত নেতৃদ্বয় তা চাননি, তারা চেয়েছিলেন পুরো বাংলা ভূখন্ড পৃথকভাবে স্বাধীন হোক। (চলবে)..