somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মাওলানা আকরম খাঁর বর্ণাঢ্য জীবন (৫ম পর্ব এবং সমাপ্ত)

২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ৮:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শেখ আবুল কাসেম মিঠুন
[পর্ব-৫]

সিরাজুদ্দীন হোসেন “ইতিহাস কথা কও” গ্রন্থে লিখেছেন, “১৯৪৭ সালের ৯ এপ্রিল বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীও হিন্দু নেতৃবৃন্দের বঙ্গভঙ্গের দাবির বিরোধিতা করেন।” অর্থাৎ কিছু হিন্দু নেতা চেয়েছিলেন বঙ্গদেশ ভাগ হয়ে হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন হোক। সিরাজুদ্দীন হোসেন আরো লিখেছেন, “২৭ এপ্রিল বাংলাকে পাকিস্তানের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার কথা না বলে তিনি (সোহরাওয়ার্দী) বাংলার জন্য অবিভক্ত ও স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দাবি করেন।”
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বঙ্গভঙ্গ হোক এটা প্রথমদিকে জিন্নাহও চাননি। তিনি অখণ্ড বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। মাওলানা আকরম খাঁরও সেই অভিমত ছিল। কিন্তু “মাউন্টব্যাটন পরিকল্পনা” পুরোপুরি গ্রহণ কিংবা বর্জনের প্রশ্ন দেখা দিলে বাংলা সম্পর্কে তাঁর মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে।
সোহরাওয়ার্দী কয়েকজন হিন্দু নেতার সঙ্গে পরামর্শক্রমে স্বাধীন বঙ্গভূমির দাবি করেন। সেইসব হিন্দু নেতাদের অন্যতম হলেন শরৎচন্দ্র বসু, কিরণ শঙ্কর রায় প্রমুখ। তারা স্বাধীন বঙ্গভূমির জন্য নানাবিধ পরিকল্পনাও পেশ করেন, এমনকি প্রধানমন্ত্রী কে হবেন তাও সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন।
মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ ১৯৪৭ সালের ১৪ মে তাদের পরিকল্পনার সমালোচনা করে বিবৃতি দেন- “বাংলার ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র সম্পর্কে মি. শরৎ চন্দ্র বসুর নয় দফা সম্বলিত ফর্মূলাটি বাংলার মুসলমানদের মুক্তি সংগ্রামকে চিরতরে সমাধিস্ত করিবার জন্যই রচিত হইয়াছে।”
মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ মুসলমানদের স্বার্থ বিবেচনা করেই ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ছিলেন। তার ধারণা ছিল দীর্ঘ শোষণ, শাসন, বঞ্চনা ও নির্যাতনের পর কেবলমাত্র মুসলমানের চেতনা জাগ্রত হচ্ছে, তাদের আলস্যতা কেটে যাচ্ছে, তারা নিজেদের চিনতে শিখছে- হয়তো বা আবার তারা ভারতবর্ষে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিতে পারবে, এই মুহূর্তে বঙ্গভঙ্গ হলে মুসলমানদের স্বার্থে বিরাট আঘাত পড়বে। তাছাড়া মুসলমানরা কেবল সংঘবদ্ধ হতে শিখছে, এই স্রোতেও ভাটা পড়বে। বাংলা ভাগ হলে দুই বাংলার মুসলমানদের মধ্যেও একটা বিভাজন হয়ে যাবে। ঐক্যবদ্ধতায় ফাটল ধরলে তারা দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই তিনি উক্ত সময়ে সাংবাদিকতার পাশাপাশি শুধুমাত্র মুসলমানদের স্বার্থরায় কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।
বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করার আরো কারণ ছিল, সে প্রসঙ্গে তিনি নিজে কিছুটা কৈফিয়ত দিয়েছেন, “তখন পূর্ব-বঙ্গের মুসলমান নেতাদিগকে আশ্বাস দেয়া হইয়াছিল, নতুন ব্যবস্থায় পূর্ববঙ্গ একটা মুসলমান প্রদেশে পরিণত হইবে, ইহাতে ঐ অঞ্চলের মুসলমানদিগের সুখের অবধি থাকিবে না। হিন্দুরা এই জন্যই বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ করিতেছে। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক তাহারা তখন ভাবিয়া দেখে নাই যে বিভাগের ফলে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদিগের তুলনায় পশ্চিম বঙ্গের মুসলমানদিগকে অধিকতর তিগ্রস্ত হইতে হইবে।”
মোটকথা মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁর সমস্ত চিন্তা-চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি, পছন্দ-অপছন্দ, তার প্রেম-ভালোবাসা, টান ও আকর্ষণ- সবকিছুই ছিল মুসলমানদের কল্যাণের জন্য নিবেদিত। তাইতো তিনি একজন কংগ্রেসী হয়েও শুধুমাত্র মুসলমানদের প্রতি আন্তরিক টান উপলব্ধি করেই ১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গ সমর্থনকারী মুসলিম লীগের শিা সম্মেলনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
আমরা দেখতে পাই, যে সমস্ত নেতৃবর্গ মুসলিম স্বার্থে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম তাদের “প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি” বলে অভিহিত করছেন এবং মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদ করে তাদের বলছেন কমিউনিস্ট ও কাদিয়ানী, এবং এই বলে প্রচারও করছেন।

১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। জমিদারী শোষণের বিরুদ্ধে গ্রামে-গঞ্জে প্রজা তথা কৃষকশ্রেণী একতাবদ্ধ হতে শুরু করে। তারা বিভিন্ন স্থানে সমিতি প্রতিষ্ঠা করে। এইসব সমিতির মাধ্যমে প্রজারা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে জমিদারবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত করে।
সাপ্তাহিক মুহাম্মদী পত্রিকার মাধ্যমে মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ বাংলার কৃষক-প্রজাদের দাবি-দাওয়া এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা জনসমে তুলে ধরেন। তার লেখনী সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মধ্যে প্রজাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে যথেষ্ট সাড়া জাগাতে সম হয়। এভাবে সাংবাদিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই মাওলানা আকরম খাঁ প্রথমে “প্রজা দরদি” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এবং পরে তিনি সরাসরি প্রজা-আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। এর ফসল ঘরে তোলেন এ.কে ফজলুল হক। ১৯১৭ সালে এ.কে ফজলুল হক প্রজা-সমিতি গঠন করেন। পূর্ব থেকে বিভিন্ন কার্যক্রমে মাওলানা আকরম খাঁ জড়িত থাকলেও ১৯২৯ সালে চূড়ান্তভাবে তিনি প্রজা আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন। এই সময়ে তিনি হিন্দু নেতাদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে কংগ্রেস ত্যাগ করেন।
১৯৩৬ সালে দুটি ঘটনা ঘটে। ১. ফজলুল হকের নেতৃত্বে “প্রজা-সমিতি” “কৃষক-প্রজা” পার্টিতে রূপান্তরিত হয়। ফজলুল হকের সঙ্গে মাওলানা আকরম খাঁর বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এ পর্যায়ে আকরম খাঁ কিছু অনুসারীসহ কৃষক-প্রজা পার্টির বিরুদ্ধে কমিউনিজমের অভিযোগ উত্থাপন করে নিজস্ব উদ্যোগে প্রজাদের সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ১৯২৬-২৮ খ্রিস্টাব্দে মুসলমানদের চরম শত্র“ মনোভাবাপন্ন বালগঙ্গাধর তিলক-এর নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট বিপ্লবী পার্টি তথা “শ্রমিক ও কৃষক পার্টি” কলকাতায় গঠিত হয়। ১৯৩৬ সালের দিকে এসে কমিউনিস্টদের বিপ্লবে সারা ভারতে এক জোয়ার সৃষ্টি হয়।
তাই সঙ্গত কারণেই মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ এ.কে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে কমিউনিজমের অভিযোগ এনেছিলেন। তিনি বিচার করেছিলেন মুসলিম ও মুসলিম বিরোধী চরিত্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে।
১৯৩৬ সালের দ্বিতীয় ঘটনা হলো- এই বছরের আগস্ট মাসে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ কলকাতায় আগমন করেন। আর এ সময় তার প্রচেষ্টায় মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমান নেতা বাংলায় মুসলিম লীগকে শক্তিশালী করতে উদ্যোগী হন। ১৯৩৭-এ এসে মুসলিম লীগ বাংলা ভূখণ্ডে প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে জনপ্রিয়তা পায়। আর এবছরের ১৫ অক্টোবর লèৌতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে বাংলার প্রধানমন্ত্রী একে ফজলুল হক আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম লীগে যোগ দেন।
মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ সারাজীবন মুসলমানদের স্বার্থরায় সংগ্রাম করে গেছেন। মুসলমানদের প্রধান নেতা হওয়া সত্ত্বেও নিজে কখনো সরকারি মতা চাননি। চাননি মন্ত্রিত্ব। এদিক দিয়ে তিনি ছিলেন মুসলমানদের অন্যতম সংগঠক এবং আল্লাহ ও তার রসূলের সঠিক পথ-প্রদর্শক মাওলানা আবুল আলা মওদূদীর পর দ্বিতীয় এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। মাওলানা আকরম খাঁ ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ঘোষণা করেন, “মন্ত্রী সাজার সাধ বা বাসনা আমার কোনোকালে ছিল না, ভবিষ্যতেও থাকিবে না বলিয়াই বিশ্বাস করি।” উক্ত ঘোষণার পূর্বে বা পরে তিনি কখনো সরকারি মতা গ্রহণ করেননি।
মুসলমান ও ইসলামকে ভালোবেসে চির সংগ্রামী মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ মাওলানা আবুল আলা মওদূদীকেও ভালোবেসেছিলেন। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৬ সালের দিকে একবার বর্তমান বিশ্বের অন্যতম ইসলামী রাজনীতিবিদ ও মুসলিম জননেতা অধ্যাপক গোলাম আযম রাজনৈতিক কারণে প্রায় নব্বই বছর বয়সের মাওলানা আকরম খাঁর সাথে সাাত করতে গেলে তিনি বলেছিলেন, “তুমি তো নিশ্চয়ই জানো যে আমি মাওলানা মওদূদীকে কত ভালোবাসি।... সর্বত্র কমিউনিস্টরা তাদের আদর্শের জন্য যেমন নিষ্ঠার সাথে কর্মতৎপর, ইসলামের জন্য জামায়াতে ইসলামীকে তেমনি তৎপর দেখে আমি অত্যন্ত উৎসাহ বোধ করি। ইসলামের জন্য আর কোনো সংগঠনকে এ সুন্দর কর্মপদ্ধতিটি অবলম্বন করতে দেখি না।”
১৯৫৬ সালে ২৬ জানুয়ারি মাওলানা মওদূদী ঢাকায় এলে মুসলিম লীগের কঠোর সমালোচনার মুখেও তিনি বিমানবন্দরে তাকে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়েছিলেন। মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে সরকারবিরোধী এক দলের নেতাকে সম্বর্ধনা জানাতে তার যাওয়া উচিত হয়নি বলে নেতারা সমালোচনা করেন। তিনি অধ্যাপক গোলাম আযমকে তখন বলেছিলেন, “মাওলানাকে অভ্যর্থনা জানাতে না গেলে পূর্ব-পাকিস্তানি মুসলিম নেতা হিসাবে আল্লাহর নিকট কৈফিয়ত দেবার আশঙ্কায় আমি গিয়েছি। ওরা মাওলানার মর্যাদা জানে না।”
এই হলো মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ। মুসলমানদের নেতা, মুসলিম জাগরণের নেতা। ১৯০০ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত যে সমস্ত বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতা নিগৃহীত, বঞ্চিত, নির্যাতিত ও অধঃপতিত মুসলিম জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে তাদের স্বাধীন সত্তা বিকাশের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, তাদের বেঁচে থাকার জন্য একটা সম্মানজনক অবস্থান তৈরি করেছিলেন এবং অবশেষে তাদের জন্য পৃথক আবাসভূমি পাকিস্তান এনে দিয়েছিলেন, সেই সমস্ত বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সুকৌশলে এবং পরিকল্পিতভাবে মুসলমানদের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চক্রান্ত ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। অন্যদিকে মুসলিম জাতির জাতিগত স্বার্থকে ধ্বংস করে হিন্দুজাতির আদর্শিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সত্তার কাছাকাছি অথবা কখনো কখনো একান্ত তথাকথিত “বাঙালি জাতিসত্তার” ধ্বজাধারী নেতৃত্বকে বাংলাদেশের মুসলিম জাতির ইতিহাসে জাতীয় নেতৃত্ব হিসেবে পূজা দেয়া হচ্ছে এবং চিরস্থায়ী করার অবিরাম প্রচেষ্টা চলছে।
মুসলমানদের নাম ব্যবহার করে কথায় কথায় “আলহামদুলিল্লাহ” “স্লামুআলাইকুম” ও “বিসমিল্লাহ” বলে, ধর্মকে হাতিয়ার করে বাংলাদেশের কোটি কোটি সাধারণ সহজ সরল মুসলমানকে অন্ধকারে রেখে যুগ যুগ ধরে তাদের নেতা সেজে বসেছে যারা তারাই মুসলিম জাগরণের অন্যতম নেতা মুনশী মেহেরুল্লা, ইসমাঈল হোসেন শিরাজী, শেখ জমিরুদ্দীন ছাড়াও এমন কি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, আফজল চৌধুরী, জামেদ আলী, কবি গোলাম মোহাহাম্মদ, শাহাবুদ্দীন আহম্মদ, আব্দুল মান্নান তালিব, আব্দুল মন্নান সৈয়দ, কবি মতিউর রহমান মল্লিকের মত কবি-সাহিত্যিক ও সাংবাদিককে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলছে। বিশ্ব মুসলমানদের গৌরব মহাকবি ইকবালকে শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার অপরাধে বাংলাদেশের নামধারী মুসলিম নেতৃত্ব মুছে ফেলেছে।
যে পাকিস্তান না হলে মুসলমানরা পেশাগত জীবনে ঝাড়–দার, মেথর, পিয়ন এবং চাকর-বাকর হয়েও বেঁচে থাকতে পারতো কিনা সন্দেহ- সেই পাকিস্তানের কারণেই আজ বাংলাদেশ সম্ভব হয়েছে এবং মুসলমান তাদের জাতিসত্তা নিয়ে স্বাধীন হয়ে বেঁচে আছে, সেই পাকিস্তানের স্রষ্টা জিন্নাহকে ঘৃণ্য করে তোলা হয়েছে, মুছে ফেলা হয়েছে ইতিহাস থেকে। তাদের বৃহত্তর কর্মকে সংকীর্ণতার পর্যায়ে ফেলে ভুল ও মিথ্যে ইতিহাস লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে যে, মুসলমান এবং ইসলাম এত সংকীর্ণ চিন্তার একটা ধর্ম যে, এ ধর্মের কোনো ব্যক্তি বড় কিছু করতে পারে না। যা-ও দু’একজনের নাম আসে তারা অত্যন্ত ঘৃণ্য পর্যায়ের। (যদিও পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান তথা আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম অর্থনৈতিক শোষণ, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, নির্যাতন, বৈষম্য ও বঞ্চণার হাত থেকে রা পেয়ে একটা স্বাধীন দেশের মানুষ হয়ে বাঁচার জন্য, কিন্তু ইসলামের চিরশত্র“রা সেই মহান মুক্তিযুদ্ধকে ধর্ম যুদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তথা মুসলমান ও ইসলামকে কলঙ্কিত করতে চায়।)
মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁকে নিয়ে স্কুল কলেজের বইতে কিছু নেই, তাকে নিয়ে মিডিয়াতে কোনো প্রোগ্রাম হয়নি, হয় না। তার নামে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো হল বা কোনো শহরে কোনো রাস্তা হয়নি। কারণ তিনি বাঙালি মুসলমানদের স্বাধীনতার জন্য লড়েছিলেন। তিনি নাকি সাম্প্রদায়িক নেতা।
(প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য কবিতা, গান, সাহিত্য এবং ইতিহাসে মুসলমানদের পে লেখালেখি করলে বা বক্তৃতা মঞ্চে মুসলমানদের পে কথা বললে তারা হয়ে যান সাম্প্রদায়িক। এমনকি দাঙ্গার নামে মুসলমানদের যখন হত্যা করা হয় সেই ইতিহাসও যদি এখন কেউ লেখেন তবে সেই ইতিহাসবিদকেও সাম্প্রদায়িক বলা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে ‘কারা বলেন’! যারা বলেন তারা বেশিরভাগই মুসলমান। অর্থাৎ নামে মুসলমান। কিন্তু আদতে তারা নাস্তিক কমিউনিস্ট কিন্তু হিন্দুত্বে বিশ্বাসী। এদের চিহ্নিত করা হয়নি বলে দীর্ঘকালব্যাপী মুসলিম নাম নিয়ে মুসলিম সমাজে বসবাস করে প্রতারণার মাধ্যমে মুসলমানদের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বকে এরা কলঙ্কিত করে আসছে এবং প্রশাসনের মধ্যে ঘাপটি মেরে থেকে তাদের উদ্দেশ্য প্রশাসনিকভাবে সফল করে যাচ্ছে।)
হিন্দুরা লড়েছে হিন্দু জাতিসত্তার স্বার্থরায় অথচ তাদের এই দুষ্টুচক্র সাম্প্রদায়িক বলে না। মাওলানা আকরম খাঁ সত্যের পে লড়েছিলেন তাই তিনি সাম্প্রদায়িক। তিনি এই মুসলমানদের স্বাধীনতার জন্য জেল খেটেছেন। ১৯২১ সালে ১০ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকারের বিচার প্রহসনে মাওলানা আকরম খাঁর এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয় এবং তাকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে অন্তরীণ রাখা হয়।
তার পত্রিকা দৈনিক ‘সেবক’ তখনকার সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং এর জামানত বাজেয়াপ্ত করে নেয়।

তিনি খ্রিস্টানদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য অসহযোগ আন্দোলন করেছেন। তিনি নিজে বিলেতি কাপড় বর্জন করেন এবং দেশীয় খদ্দরের তৈরি সাদা লুঙ্গি কোর্তা ও টুপি পরতে থাকেন। এছাড়া ‘স্বদেশী খেলাফত স্টোরস লি.’-নামক একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ ছিলেন কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং কাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। মুসলমানদের তিনি খেলার মাঠেও সক্রিয় দেখতে চেয়েছিলেন। সমস্ত পৃথিবীর মুসলমানদের তিনি ভালোবাসতেন বলে বাংলা ভূখণ্ডে বসে তুর্কী খেলাফত রায়, তিনি খেলাফত আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
তিনি ছিলেন এক অসামান্য সাহিত্যিক। কবিতা চর্চাও করেছেন তিনি। অন্যদিকে তিনি একজন গবেষকের কাজও করেছেন। তার রচিত ১৪টি গ্রন্থের তালিকা পাওয়া যায়। যার মধ্যে ‘মোস্তাফা চরিত, উপক্রম ও ইতিহাস ভাগ, মোছলেম বঙ্গের ইতিহাস, বাইবেলের নির্দেশ ও প্রচলিত খৃস্টান ধর্ম’ অন্যতম। তার রচিত প্রবন্ধ অসংখ্য, যার সবগুলিই গবেষণামূলক। তার রচিত একটি কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়। “ইয়া মোহাম্মদ আন্তা রাসূলুল্লাহ” শিরোনামের কবিতাটি দৈনিক আজাদে প্রকাশিত হয়েছিল।
মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ চর্চা আজও মুসলিম জাগরণের একটা উপায় হিসেবে একান্ত জরুরি। তার জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন করে এই অসাধারণ সংগ্রামী মুসলিম জাগরণের নেতার আদর্শে জাতিকে উদ্দীপ্ত করার প্রেরণা দেয়া সম্ভব। হিন্দুজাতিসত্তার অনুসারী তথাকথিত নামধারী মুসলিম বাঙালি জাতিসত্তার কবি, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ চর্চা করার চেয়ে মুসলিম জাতিসত্তার মুসলমান কবি, সাহিত্যিক ও রাজনীতিবিদ চর্চা বাংলাদেশের জন্য একান্ত প্রয়োজন। যাতে বাঙালি মুসলমানরা তাদের সাহিত্যÑসংস্কৃতির মর্যাদা এবং মূল্যমান সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। অস্তিত্বের লড়াইয়ে মাওলানা আকরম খাঁসহ অন্যান্য মুসলিম প্রতিভা সৃজনশীল চিন্তার পথ নির্দেশনায় অত্যন্ত সহায়ক হবে।
এত বছর ধরে এবং আজো সাহিত্য সংস্কৃতির েেত্র, রাজনীতির একটা বিশাল অঙ্গ জুড়ে এদেশের মুসলিম শ্রেণীর সামনে সেইসব ব্যক্তিত্বকে ও নেতৃত্বকে মর্যাদার আসনে স্থায়ী করা হয়েছে যারা বাঙালি হিন্দু, খ্রিস্টান অথবা কাদিয়ানী জাতিসত্তার চেতনায় উদ্বুদ্ধ। তাদের অনুসারী ও পূজারীরা সুকৌশলে বাঙালি মুসলিম জাতিসত্তার মাঝে সূক্ষ্মভাবে [বর্তমানে বড় স্থূলভাবে] তাদের রচিত সাহিত্য-সংস্কৃতি, তাদের বক্তব্য, তাদের চিন্তা চেতনা ইত্যাদি প্রবেশ করিয়ে সহজ-সরল মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদা, দেশপ্রেম, আত্মমর্যাদা ও সম্মানকে দুর্বল এবং ধ্বংস করে দেবার চেষ্টায় রত। ঐক্যবদ্ধ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে তারা খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলছে এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে ইসলামের উপরেই মুসলমানদের প্তি করে তুলছে। ভয়াবহ এক কৌশল তারা অবলম্বন করেছে- তা হলো তারা মুসলমানী নাম রাখে, কেউ কেউ দাড়ি রাখে ও নামাজ রোজার ভানও করে। এটা প্রতারণা ও ভণ্ডামী ছাড়া আর কিছু নয়। এটা একটা জঘন্য অপরাধ।
মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ চর্চা- ঐ সব ভণ্ড ও প্রতারকদের মুখোশ খুলে দিতে পারে। এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাথে প্রতারণার জন্য তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যেতে পারে।
১৯৩৭-৪৭ সালে মাওলানা আকরম খাঁ ছিলেন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। এই সময়ে তার নেতৃত্বে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ বাংলার মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার ল্েয পরিচালিত করতে সম হয়।
এক সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁ বাংলার জটিল এবং চতুর্মুখী শত্র“তার রাজনীতিতে মুসলমানদের অস্তিত্ব রায় যে ভূমিকা রাখেন তা অবিসংবাদিত। ঘুমন্ত, কুসংস্কারে আবদ্ধ, নিঃশেষ প্রায় জাতির মাজহাবি কলহ-কোন্দল দূর করে তাদের জাগ্রত করা, উদার দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী করা, সঠিক পথ-প্রদর্শন করা, চেতনে ফিরিয়ে এনে একতাবদ্ধ করা, রাজনৈতিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হওয়ার মতো মানসিক ও নৈতিক শক্তি জোগাতে মাওলানা মুহাম্মদ আকরম খাঁর ভূমিকা এক পথিকৃতের ভূমিকা ছিল। রাজনীতির জটিল আবর্তে বসবাস করেও তার লেখনী মুসলমানদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করেছে। দিক নির্দেশনা দিয়েছে।
একদিকে খ্রিস্টানদের শোষণ শাসন ও দমননীতি- অন্যদিকে জমিদার শ্রেণীর অত্যাচার ও নিষ্পেষণ আর বর্ণ হিন্দুদের দ্বারা নিগৃহীত মুসলমান সমাজকে ভারত বিভাগপূর্ব প্রায় ২৫ বছর বর্ণ হিন্দুদের প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপ হিসেবে আবির্ভূত করে এবং মুসলমানরা তাদের একটা সম্মানিত জীবন অর্জন করে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান যখন স্বাধীন হয় তখন তার বয়স প্রায় ৮০ বছরের কাছাকাছি। তা সত্ত্বেও ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি মুসলীম লীগের সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন এবং এই সংগঠনের আদর্শ অনুসরণ করে পাকিস্তানের সংহতির নামে রাজনৈতিক তৎপরতায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখেন। ১৯৬৮ সালে ১৮ আগস্ট ১০০ বছর বয়সে অসুস্থতা ও বার্ধক্যজনিত কারণে তার সংগ্রামময় কর্মজীবনের অবসান ঘটে। আমরা তার মাগফেরাত কামনা করি। (সমাপ্ত)

০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×