(লেখার বিষয়বস্তু ও কিছু শব্দ অশ্লীল মনে হতে পারে -তবে কোনক্রমেই শুধুমাত্র প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য নয়।)
প্রথম পর্ব-
মাগি ভাতার খাকি তোর এত খাউজানি –যা না নটী পাড়ায় গিয়্যা নাম লিখা!
কি ভীষন অশ্রাব্য কথা নয় কি? না- এটা ঝগড়ার সময় ওদের অতি সাধারন গালি।
প্রতিদিন কাক ডাকা ভোরে ঘুম ভাঙ্গে কারো না কারো ঝগড়া হৈ হুল্লোড় মারামারিতে। আমাদের বাড়ির সামনে ছিল বস্তি মতন। তখনো জানতাম না বস্তি কাকে বলে। বিঘে খানেক ভ্যাজাল জমিতে আবাস গেড়েছে কুড়ি থেকে ত্রিশটা পরিবার।ওদের পুরুষদের কেউ ড্রাইভারি করে কেউবা ঘাটের দালাল বেশ কয়েকজন পকেটমার আর চোরও আছে।
আমি ছোট মানুষ চোরদের তখন ভীষন ভয় পেতাম প্রতিদিন ভোরেই ঘুম ভেঙ্গে ভীত চোখে ডোয়া বা ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখতাম সিদ কেটেছে কিনা। রাতে খস খস শব্দে ঘুম ভাঙলেই চোর ঢুকেছে ভেবে শরিরের রক্ত হিম হয়ে যেত! দিনের বেলা ওদের বিশেষ দেখা যেত না কিন্তু হুলা পার্টি বা ছেলে ছোকড়ার দলেরা যদি আঙ্গুল তুলে কাউকে দেখিয়ে বলত,’ওই দেখ ওইডা কাইল্যা চোরা বা তোরাই চোরা’ তখুনি ভীষন সমীহের দৃষ্টিতে তাকাতাম।
ভাবতাম কি ভয়ঙ্কর সাহসী ওরা!
মাঝে মধ্যে গন পিটুনি বা পুলিশের মার খেয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ঘরে ফিরে আসত তখুনি শুরু হত তাদের মা খালাদের সেই পুলিশ বা জনগনের উদ্দেশ্যে শাপ শাপান্ত আর নাকি সুরে কান্না। সে কি ভাষার ছিড়ি!
মহিলারা বেশীর ভাগই টুক টাক কাজ কর্মে ব্যাস্ত থাকত। ঘুটে কুড়ানো থেকে শুরু করে গরু বাছুরও চড়াত।গেরস্তের ঘরে কাজ করতে গিয়ে একটু খুদ গোবর লাউটা মাছটা লাকড়ি কিংবা তুষ চুরি করতে গিয়েও ঘটত বিপত্তি কিল গুতো খেয়ে কিংবা চাকড়ি হারিয়ে উল্টে রুখে দাড়ানোর সাহস তাদের ছিলনা কিন্তু বস্তিতে বসেই দল বেধে সেই গেরস্তের গুস্টি উদ্দার করত।
পুরুষরা সেই সুরে খুব একটা সুর মেলাত না। ওরা ছিল বউ বোন মা পেটানোয় ওস্তাদ। সেই মার খেয়ে ঝগড়ায় ক্ষান্ততো দিতই না উল্টো গালির তুবড়ি ছুড়ত আরো ভীষন উচ্চ কন্ঠে।ঝগড়ায় অবশ্য হায়ার করার প্রথা ছিল ফুটবল খেলার মত। কারো গলার জোর কম থাকলে অন্যজনকে হায়ার করত এই বিষয়ে বিশেষ পারদর্শী ছিল গোলো নামে এক মহিলা। গৌড় বর্ণের দশাশই দেহ বল্লভীর অধিকারীনি সেই মহিলার বাজখাই কন্ঠ নোংড়া শব্দের যথাযথ প্রয়োগে ধরাশায়ি হত অনেক ডাকসাইটের পুরুষও। ওফ সেকি কন্ঠ! দুই গ্রাম দুরের বাসিন্দারাও কানে আঙ্গুল পুরত।
রাস্তার ওপারে ছিল ওদের বাস আর এপাড়ে থাকতাম আমরা তথাকতিথ ভদ্রস্থ কিছু আদম পরিবার।
মোটামুটি অভিজাত পরিবারে লালিত পালিত আমার মা সারাক্ষন ভয়ে কাটা হয়ে থাকতে –এই ভেবে তার ছেলে পুলেরা হয়তো ওদের পাল্লায় পড়ে গোল্লায় গেল।কখনো মনের ভুলে একখানা নোংড়া শব্দ মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়লে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলত।
বস্তির ভিতরে যাওয়া পুরোপুরি নিষিদ্ধ ছিল আমাদের কিন্তু গালি শোনা বন্ধ করবে কিভাবে!
নটী বা নটীপাড়া শব্দ গুলো এত বেশী ব্যাবহার হত যে শুনতে শুনতে মনে গেথে গিয়েছিল।বুঝতাম এগুলো বাজে শব্দ কিন্তু মানে বুঝতামনা।একদিন মাকে এর মানে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে যে ধ্যাতানি খেয়েছিলাম তারপর থেকে আর ও শব্দ মুখে আনিনি।
সকালে দল বেধে স্কুলে যাই পড়াশুনা হয় লবডঙ্কা। ফাকিবাজ টিচারদের ক্লাস করতাম মৌজে শুধু অপেক্ষা করতাম কখন ঘন্টা বাজবে আর কড়া স্যারদের ক্লাস শুরুর আগেই ভাগতাম। স্যাররাও কম চালাক ছিলেননা। এক ক্লাস শেষ হবার আগেই অন্যজন এসে দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকত। আমরা অবশ্য থোড়াই কেয়ার করতাম। তার একটু অন্য মনস্কতার সুযোগে ক্লাসের ভাঙা বেড়ার ফাক গলে টুক করে ভেগে যেতাম।
স্কুল থেকে শ’মিটার দুরেই ছিল পদ্মা নদী। অন্য কোন পথ দিয়ে নদীপারে যাওয়া নিষেধ ছিলনা কিন্তু শুধু ওই পথে নদীর ধারে আমাদের যাওয়া নিষেধ ছিল। কাউকে জিজ্ঞেস করলে বলত ওখানে খারাপ লোকেরা থাকে- ছেলে পুলেরা গেলে তাদের হাত পা ভেঙ্গে ল্যাংড়া করে ঢাকায় নিয়ে ভিক্ষে করায় কিংবা কামরুপ কামাখ্যায় নিয়ে গিয়ে ভেড়া বানিয়ে রাখে!
যদিবা ওই পথে দিনের বেলায় লোক চলাচল একদমই কম ছিল। ইতর জনের চলাচলই ছিল বেশী-তাও যেত হাত দিয়ে নিজেকে আড়াল করে কিংবা চাদর গামছা মাথায় দিয়ে! কিন্তু দুর থেকে দেখতে পেতাম প্রচুর কাচা বাড়ি ঘর আর ভিড় ভাট্টা। ক্লাসে বসেই মাঝে মধ্যে হৈ হুল্লোড়ের শব্দ পেতাম।
আর কান খাড়া করে সেই শব্দের উৎস স্থল খুজতে গেলেই টিচারের ধমক খেয়ে ঝুপ করে বসে পড়তাম।
ক্লাস ফাকি দিয়ে স্কুলের সামনের দিকটায় আসার সাহস ছিলনা। পিছনের আধো আন্ধকার স্যাতস্যাতে জায়গাটায় বসে ফিস ফিস করে গল্প করত ঘন্টা বাজার অপেক্ষা করতাম।
আমার এক অসম সাহসী বন্ধুর উত্তরোত্তর প্ররোচনায় একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম যে ওই পথে নদীর ঘাটে যাবই।সেই বয়সে মলম বিক্রেতার ’ ডান পায়ে ভর দিয়ে দাড়ান –না দাড়াইলে বাসায় গিয়া রক্ত বমি হইয়া মরলে কিন্তু আমি দায়ী না’ এইরকম বয়ানে ঘাবড়ে যেতাম। বাসায় গিয়ে শরিরটা একটু কেমন কেমন করলেই ভাবতাম ডান পায়ে ভরটা মনে হয় ঠিকমত হয়নি। এখুনি হয়তো রক্তবমি হয়ে মারা যাব!
আর এটাতো তার থেকে ভয়াবহ ব্যাপার! ভীষন ভয়ে ভয়ে ছিলাম।ও রাস্তায় ঢুকতেই হাত পা কাপছিল তির তির করে ভয়ে কন্ঠতালু শুকিয়ে গেল। আমি ছিলাম সবার পেছনে। এডভেঞ্চারার অবশ্য আমরা সাকুল্যে তিনজন। বাকি সবাই পিঠটান দিয়েছে।
একটা মাত্র ক্ষয়ে যাওয়া ইটের রাস্তা- দুপাশ দিয়ে সারি সারি এক চালা কাচা ঘর। কোনটা খুপরি মত কোনটা আবার বেশ বড়সড়।তার পাশ দিয়ে সরু সরু অলি গলিসেই ঘর ঘেষে আর রাস্তার দুপাশে দাড়িয়ে আছে বহু তরুণী যুবতী আর অর্ধ বয়সী নারী। এমন ধারার শাড়ি পড়া চুল বাধা ঠোটে মুখো রঙ লাগানো কোন নারিকে এই প্রথম দেখা। এমন কটাক্ষ চাহনী ইশারা অঙ্গভঙ্গী আমার একেবারেই অপরিচিত। মনে হচ্ছিল অন্য ভুমে আমি সপ্নের মাঝে হেটে চলছি।এক পলেকেই বুঝে ফেললাম এরা ভাল না। আমার বয়সী ছোকড়ারা এই পথ দিয়ে যায়না বিশেষ। আমাদের তিনজনকে পেয়ে ওরা যেন মজা করার দারুন কিছু উপকরন পেল।
এ ধরে হাত টানে ও এসে বুকের ঢেউ তুলে গুতো দেয়। বলে ‘আস গো নাগর তোমার অপেক্ষায় ছিলাম এদ্দিন।‘ কেউবা আচল ফেলে দিয়ে অর্ধ উন্মুক্ত বক্ষ দোলায়।আমাদের ভীষন ঘাবড়ে যাওয়া লজ্জাবনত মুখ দেখে কেউ কেউ আরো ডেসপারেট ‘উরু অব্দি কাপড় তুলে ময়লা ঠ্যাং দেখিয়ে অশ্লীল ইঙ্গিত করে!’
আমার সেই অসম সাহসী বন্ধুরও তখন বেহাল দশা! এমন এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে সে সপ্নেও ভাবেনি।লজ্জায় ভয়ে চোখের কোলে তার জলের আভাস!
আর আমার কথা কি বলব-এমনিতেই ভীষন লাজুক ছিলাম। ক্লাসের মেয়েদের সাথে অতর্কিতে চোখাচোখি হয়ে যাবে বলে পিছনের বেঞ্চিতে বসতাম। এমন বান্দার অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
ইয়ার্কি ফাজলামি করছিল তুলনামুলক কমবয়সীরা। কিশোরী থেকে তরুণীরা-তবে বয়স বোঝার মত মনের অবস্থা কখন ছিলনা। অপেক্ষাকৃত বয়স্করা দুরে দাড়িয়ে হাসছিল আর বেশী বেশী আস্কারা দিয়ে ফাজিলদের তিরস্কার করছিল।‘এই ছেমড়ি ছাড়তো –পোলাপানগের সাথে এইরকম করতেছিস ক্যান।‘
আহারে নাগরদের একটু সখ জাগছে তোগো দ্যাহার!’
উপায়ান্তর না দেখে আমরা কোন মতে হুমড়ি খেয়ে দিগ্বিদিক ভুলে সোজা দিলাম দৌড়। পিছন থেকে ওদের কলহাস্য ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ আর হৈ চৈ কানে এল শুধু।
ফেরার পথে আর ও মুখো হইনি। বহু পথ ঘুরে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে স্কুলে এসেছিলাম।
...ক্রমশ
দ্বীতিয় পর্বের জন্যঃ Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:২২