আমি সাধারনত কোন লেখা রি-পোস্ট করি না। এই লেখাটা ১২ বছর আগে সামুতে পোষ্ট করেছিলাম। সে সময়ের মন্তব্যকারী একজন ব্লগারও ব্লগে আর নিয়মিত নন। ভীষন অনিয়মিত প্রিয় 'জুলভার্ন' ছাড়া আর সবাই হারিয়ে গেছেন। আমার খুব প্রিয় একটা লেখা-ফের পোস্ট দিচ্ছি;
ওই কাইল্যা শোন, স্টিশনে গিয়া কুলি নিয়া আয়। মুলায় নিস। পোকরে কইছি হাইত্যা ফুটি নিবে-আরচ্যা ফুটির বেশী দিবি না।
দুজন হোটেলের কর্মচারির কথপোকথন। আপনি কি পুরোপুরি বুঝেছেন ওরা নিজেদের মধ্যে কি কথা বলা বলি করছে? সম্ভবত বেশীর ভাগ লোকই বুঝতে পারবেনা এই ভাষা। এটা ওদের নিজেদের উদ্ভাবিত।
সবাই প্রায় মুখ্য সুখ্য ওরা, বেশিরভাগই নিজের নামটাও লিখতে পারেনা। এক'শ টাকাকে গোনে পাঁচ কুড়ি ভাগ করে।
বখে যাওয়া,অবিভাবকহীন,ঘর পালানো ছেলেগুলো ভাগ্যান্বেষনে ঘুরতে ঘুরতে এই ঘাটে এসে বসতি গড়ে। কারো হয়তো খোঁজ নেবার কেউ নেই- কেউ হয়তো ইচ্ছে করে নাম পরিচিতি ভাড়ায়। মাছ অথবা সব্জি বোঝাই ট্রাকের তাবুর উপর চড়ে কেউবা বাসের ছাদের রেলিং আকড়ে দুয়েকজন হেল্পার ড্রাইভারের হাতে পায় ধরে ~গলা ধাক্কা খেয়ে কিংবা ফুট ফরমায়েশ খেটে বিনে পয়সায় এখানে এসে জুটেছে।
প্রথম কদিন ছন্নের মত এদিক ওদিক ঘুরে চেয়ে চিন্তে এক আধ পেট খেয়ে ফেরির পল্টুনে স্টেশনে কিংবা সিরিয়ালে থাকা ট্রাকের পেটের নীচে রাত কাটায়।
দু’দিনেই ফন্দি ফিকির ছোট খাট চুরি-চামারি বাটপারি শিখে যায়। এদের মধ্যে বোকা-সোকার সংখ্যা নগন্য।বেশীর ভাগই দুরন্ত ও বুদ্ধিমান! দুয়েকজন ঘাটের দালালদের হেল্পার হয় প্রথমে। চাঁপাবাজি আর ভুজুং ভাজং এর যোগ্যতা থাকলে দু-য়েক বছরেই পুরোদস্তুর দালাল হয়। দু-য়েকজন হয় মলম বা গাছ গাছড়া বিক্রেতা কেউবা গাঁট কাটে বা মুট বয় কেউ হয় হোটেলের বয় বেয়ারা।
ঘাট বড় খারাপ জায়গারে বাপ! বারোয়াড়ি বাটপারের আড্ডা ওখানটায়। ছোট খাট ছল চাতুরি তো আছেই একটু বেতাল হলেই সর্বশান্ত হওয়া বিচিত্র নয়। যাত্রীরা তাই ভয়ে ভয়ে থাকে। দালালদের শত প্রলোভন এড়িয়ে চলে। তবুও অনেক চতুর যাত্রীও ধরা খায়, হর হামেশাই।
পেশা ভিন্ন হলেও জোটবদ্ধ ওরা সবাই-বিচিত্র ভাষায় কথা বলে।একদম নিরীহ চেহারার আড়ালেও একটু শয়তানী লুকিয়ে থাকে। তবে ওদের বন্ধু হল মাস্টার,সারেঙ, সুকানী,বাস-ট্রাক ড্রাইভার, ঘাটের সুপারভাইজার,পুলিশ আর পতিতা। এদের সাথে ছল চাতুরি প্রায় করেনা বললেই চলে। তবে দুয়েকজন থাকে ছন্ন ছাড়া। তাদের অপরাধের কোন বাপ-মা নাই। সুযোগ পেলেই ব্যাস! তাই ঘাড়ানি কিংবা নলী ছোটা (মাইরের রকমফের) ওদের ভাগ্যেই জোটে বেশী।(শুনেছি ওরা নাকি পুলিশ জি আর পি’র ও পকেট কাটত!)
আর নামের কি ছিড়ি ওদের! বাপ দাদার আকিকা দেওয়া নামের উপর অনেক পুরু ময়লা জমে কেউ হয় কাইল্যা কেউ ট্যাবলেট কেউ নুনজান কিংবা মাইনক্যা আর বুলেট- বন্দুক- টায়ার- টিউব তো আছেই। সিনিয়র কিংবা পালের গোদাদের নামের আগে পরে গুরু কমন।খিস্তি খেউড় ওদের মুখে খইয়ের মত ফোটে।
একসময়ের বিখ্যাত রেল ও স্টিমার ঘাট পরবর্তীতে স্টিমার বিলুপ্ত হয়ে ফেরি লঞ্চঘাট। সেই গোয়ালন্দী জাহাজের কথা কত বিখ্যাত লেখকের লেখাতেই না পাওয়া যায়। এখান থেকে ট্রেন যেত সরাসরি পশ্চিম বঙ্গের শিলিগুড়িতে। সেই শিলিগুরি ট্রেন তার পুরোনো নাম নিয়ে এই সেদিনও টিকে ছিল।য দিও তার চলার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃস্ট হয়েছিল অনেক আগেই।
সেদিনের সেই দুরন্ত কৃর্তিনাশা পদ্মা নাব্যতা হারানোয় বিখ্যাত সেই ঘাটও উজান বেয়ে চলে এসেছে দৌলতদিয়ায়। ঘাট তার রুপ লাবন্য আদি ঠিকানা হারিয়েছে, সেই সাথে দালালরা হারিয়েছে তাদের স্বকীয়তা।
আমি বলছি সেই আশির দশকের কথা!
বহু পথ জার্নি করে আসা যাত্রীরা জাহাজ ফেরি কিংবা লঞ্চ থেকে নেমে যখন ছুটছে স্টেশনের পানে ট্রেন ধরার উদ্দেশ্যে-অনেকেই জানেনা ট্রেন কখন ছাড়বে। স্টেশন-ও সবাই চিনতনা। আনাড়ির মত দিকভ্রান্ত হয়ে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করত আর একে তাকে ধরে জিজ্ঞেস করত ট্রেন কখন আসবে? সেই সযোগে কুলিরা ট্রেন এখুনি ছাড়বে বলে তাড়াহুড়ো করে মুটে নিয়ে কয়েকগুন পয়সা কামিয়ে নিত। সামনে কুলির মাথায় মাল দিয়ে যখন মিয়া বিবি পরিজন নিয়ে উর্ধশ্বাসে ছুটছে তখনি পথ রোধ করে দাড়াত হোটেলের দালালরা। কুলির সাথে কথা হত সেই সাঙ্কতিক ভাষায়!
যত্রীর পথ আটকে বলত কই দৌড়ায় যান ছার- টেরেনতো এহনো আসে নাই। যাত্রীরা থমকে গিয়ে হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞস করত ‘তার মানে?’
মানে ওইটা হইল মাল গাড়ির ইঞ্জিনের হুইসেল! ওই ব্যাটা ভাবছিল আপনার টেরেনের!
কুলি তখন কাঁচুমাচু হয়ে দুঃখ প্রকাশ করত। কিন্তু ভাড়ায় ছাড় দিতনা এক পয়সা। হোটেলের সেই দালাল তাদের হোটেলের গুন কীর্তন করে কোনক্রমে ভিতরে সেঁধিয়ে বেয়ারার হাতে বুঝিয়ে দিয়েই আরেকজন ধুর পোক(বোকা কাস্টমার) ধরার উদ্দশ্যে বেরিয়ে পড়ত।
ট্রেনের হুইসেলেরও রকমফের আছে। ইঞ্জিন সানটিঙ(ট্রেনের বগি পরিবর্তন কিংবা ইঞ্জিনের দিক পরিবর্তন)এর হুইসেল একরকম ট্রেন ছাড়ার হুইসেল অন্যরকম। ট্রেন ছাড়ার আগে ফলস্ হুইসেল বাজে যা যাত্রীদের সতর্ক করে বা সংকেত দেয় ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে। ওদিকে সিগন্যালে আটকে গেলে( স্থানীয় লোকদের মুখে এই শব্দটা কখনো আমি শুদ্ধ ভাষায় শুনিনি-কেউ বলে সিনগেল কেউবা সিংগ্যাল বলে। ছোট বেলায় এই ধরনের অশুদ্ধ শব্দ শুনতে শুনতে আমারও ধারনা হয়েছিল এইটে সিনগেলই হবে।) হুইসেলের ধ্বনি পাল্টে যায়;
অনেকটা টেলিগ্রামের টরে টক্কা টক টক টক্কার মত -যা আমাদের মত অজ্ঞদের কানে একই রকম ধ্বনি মনে হলেও অভিজ্ঞরা এ ধ্বনির মর্ম বোঝেন। আবার চলন্ত পথে চালক বিপদের আভাস পেলে অন্যস্বরে হুইসেল বাজায়। ট্রেন লাইনচ্যুত হলেও হুইসেল বাজে আর্ত কন্ঠে , আমাকে বাঁচাও বাঁচাও বলে!
রেল স্টেশনের অদুরে আমার বাড়ি থাকায় ছোট বেলা থেকেই এমন ধারার ভিন্ন ভিন্ন ধারায় হুইসেলের শব্দ শুনেই চোখ বুজে বলে দিতে পারতাম রেল গাড়ির হাল-হকিকত। কোথাও যেতে হলে ট্রেনের সেই সানটিঙ এর হুইসেল শুনে বাড়ি থেকে বের হতাম।
ক্লান্ত ক্ষুধার্ত যাত্রী যখন ট্রেন ছাড়তে দেরী হবে ভেবে আয়েস করে হাত মুখ ধুয়ে বহুদিন বাদে পদ্মার টাটকা ইলিশের স্বাদ নেবে বলে খেতে বসে গরম গরম ঝোল সবে পাতে ঢেলেছে ঠিক তখুনি বেজে উঠল হুইসেল- আর বেয়ারার তখুনি তারস্বরে চিৎকার- 'ছার টেরেন ছাইড়া গেল!'
- হায় হায় একি অলুক্ষনে কথা? শালার ট্রেন ছাড়ার আর সময় পেলনা। টাটকা ইলিশের গরম ঝোলের স্বাদ ভুলে যাত্রীরা তখন লাফিয়ে উঠে হুমড়ি খেয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করত। হাত ধুবে না ব্যাগ গোছাবে নাকি সব ফেলে ট্রেন ধরতে ছুটবে এই নিয়ে দিশেহারা? কিন্তু বিপত্তি বাঁধত অন্যখানে- বেরুনোর মুখেই বেয়ারা গিয়ে পথ আগলে দাড়াত।
-ছার খাওয়ার টাকা?
যাত্রী তখন ভুলে গেছে কি খেয়েছে কি খায়নি! বড় নোট দিলে ভাংতি নাই- ছোট নোট গুনতে গেলে ট্রেন হারানোর ভয়! বিলের টাকা কোন মতে তার হাতে গুজে দিয়ে পড়ি-মড়ি করে স্টেশনে গিয়ে দেখে ট্রেন নেই।
হায় হায় এখন কি হবে? হতাশ ক্লান্ত দিশেহারা যাত্রীরা তখন হাতের কাছে যাকে পায় তাকেই ধরে বলে ভাইজান ট্রেন কি চলে গেছে। পুংটা কেউ হলে তাকে আরো ঘাবড়ে দেয়। কিন্তু সহৃদজন হাসতে হাসতে বলে, নারে ভাই ট্রেন ছাড়তে এখনো অনেক দেরি- কেবল সানটিঙ করতেছে। যাত্রীদের তখন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ত-ভাবত বেয়ারা হয়তো ভুল করেছে।
এমনি কত ধরনের জোচ্চুরি বাটপারি জালিয়াতি হত প্রতি দিন।
সব হোটেল মালিক আর সব বয় বেয়ারা দালালরা যে খারাপ ছিল তা কিন্তু নয়। দু-চারজনতো অবশ্যই ভাল ছিল।
বলছিলাম এদের ভাষা নিয়ে। সেই ভাগ্যান্বষনে বের হওয়া মুখ্য সুখ্য পোড় খাওয়া মানুষগুলো নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান প্রদান করার জন্য উদ্ভাবন করেছিল নতুন নিজস্ব এক ভাষার। এমন কিছু শব্দ তারা ব্যাবহার করত যা বোঝার সাধ্যি বাইরের কারো ছিলনা- শুধু তাইনা এর পরিবর্তন হত দ্রুত। একই শব্দ বেশীদিন ব্যাবহারের ফলে এর গুঢ় অর্থ বুঝে ফেলা ধুর্তদের অসম্ভব নয়। অনেকেই যাত্রীদের কৃপাদৃষ্টি লাভের আশায় কিংবা হৃদ্যতা গড়ে তোলার বাসনায় গোমড় ফাঁস করে দিত।
ছোটবেলায় শোনা সেই ভাষার অনেকটাই ভুলে গেছি আজ। মনে আছে অল্প কিছু শব্দ। ভুলভ্রান্তি হতেই পারে-তাই ত্রুটি মার্জনীয়।
আম দালালেরা ব্যাবহার করত প্রচলিত কিছু শব্দ! যেমন ‘পুরুষ যাত্রী’কে বলত-পোক, মেয়ে যাত্রীকে-ভাতি, টাকাকে-ফুটি। কেউ সর্বস্বান্ত হলে বলত- ‘মালে হুপড়ি খাইছে’ এমনি আরো কত-শত শব্দ ছিল তাদের অভিধানে। দুই টাকাকে বলত- দয়লা ফুটি, চারকে-আইরচ্য, পাঁচকে- হাইত্যা।
তবে বুদ্ধিমান বা চাল্লু ভাষাবিদ দালালেরা ছিল এক কাঠি সরেস। তারা কথা বলত কখনো ভাষাকে উল্টে পাল্টে আন্ধা কুন্দা ব্যাবচ্ছেদ করে, যেমন ‘উইতু ওইকো এছিল্যগ্যা?’ এমন কথা শুনে মনে হত বিজাতীয় ভাষা। প্রথমে খটকা লাগলেও একটু বুদ্ধি খাটালে মর্মদ্ধার করা সম্ভব-মুল শব্দ গুলোকে উল্টে ফেলে স্বর বর্ণের কিছু অতিরিক্ত ব্যাবহার হয়েছে! উইতু-তুই –বাকি শব্দ গুলো আলাদা করে কয়েকবার উচ্চারন করলেই আসল কথা বেরিয়ে আসবে! কিন্তু মুল ব্যাপার হচ্ছে এর অতিদ্রুত ব্যাবহার আর বোঝার ক্ষমতা। সেইখানেই ছিল ওদের এক্সট্রা অর্ডিনারি বুদ্ধিমত্বা!
এত দ্রুত ওরা এই ভাষায় কথা গুলো বলত যে অতি বুদ্ধিমানরাও হকচকিয়ে যেত! পাঠক তুমি এইটে বুঝে ফেললে কি হবে ওদের ঝুলিতে আরো অনেক কারিশমা ছিল। একই সাথে দুজনের কথপোকথন হত এই ভাবে,
‘আলেরমা আথেসা আতিভাডা ওসজো’এর উত্তরে ‘স্লেইরম, ইলামার ল্লোল প্লড়তেছে।‘‘শব্দার্থ শোভন নয় তাই পাঠকের হাতে ছেড়ে দিলাম এর মর্ম উদ্ধারের ভার।
সেই আগের দিন আর নেই। ঘাট মরে গেছে। সড়ক যোগাযোগ ব্যাবস্থা হয়েছে অনেক উন্নত- সেই সাথে মান নেমে গেছে আমাদের বি আর বা বাংলাদেশ রেলওয়ের। এখন আর কেউ পঞ্চাশ মাইল পথ পেরুতে দিন কাবার করেনা। নদীগুলো শুকিয়ে গেছে-কিংবা এর দু পারের দৈর্ঘ্য কমে গেছে। ব্রিজ হয়ে গেছে অনেকখানেই বাকিগুলো হবে হবে করছে। ব্যাবসার এই আকালে দালারেরা ভিন্ন পেশায় চলে গেছে।
তবু একসময়ের প্রমত্ত পদ্মা পাড়ের ক্লান্ত বিধ্বস্ত রুগ্ন সেই ঘাটের বাতাসে এখনো ভেসে বেড়ায় দেশের সুদুর প্রান্ত থেকে ভাগ্যান্বেষনে আসা ঘর পালানো একগুয়ে চতুর-চঞ্চল সদাহাস্য একদল তরুনদের উদ্ভাবিত ভাষার টুকরো শব্দগুলি।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০২১ রাত ৮:২৮