আগের পর্বঃ Click This Link
দিনের বেলায় তো ভয় লাগেনা কিন্তু মাথায় টেনশন ছিল,এমন ভুতুড়ে ঘটনাটা ঘটল কেমনে সে ভেবে ভেবে অস্থির!
সম্ভাব্য অসম্ভাব্য সবখানেই ফের খুঁজে খুঁজে দেখলাম! শুধু বেড়াল হলেও কথা ছিল- সাথে ছানা পোনাও ছিল চার পাঁচখানা!
সবগুলো একসাথে উধাও হল কেমনে? এখানে কোন বাড়িতে ভেন্টিলেটরও নেই সান-শেডও নেই যে,ওই ফাঁক দিয়ে গিয়ে সেখানে গিয়ে লুকাবে!
জানালার বিশাল পর্দা তুলে কাঁচের বিশাল ডালাটা অনেক কসরত করে খুললাম! কারন ছিল দুটো; একটা হল চারপাশের সব কিছু ভাল করে অবলোকন করা আর বিপদ আসলে এসকেপের রাস্তা খোঁজা। রাস্তা বেরুল একটাই; হাত-পা ভাঙ্গার! যে বিষয়টা ভাবতে গিয়ে ভড়কে গেলাম সেটা হোল,-নীচ থেকে বা উপর থেকে কোন বিড়াল কুকুর লাফ-ঝাঁপ দিয়ে এখানে আসার উপায় নেই।
কেন যেন মনে হোল জো’র(সাবাকা ‘জো’ আনিসের কুকুরের নাম) ছোট বেলায় আসার কোন গোপন রাস্তা ছিল এ বাসায়! গোপন পথ খুঁজতে গিয়ে আমি ঘেমে নেয়ে একাকার। বাসার কোথাও একটা ফু্টো পর্যন্ত পেলাম না। কোন একটা সমাধান না পেয়ে মনের মধ্যে খচ খচ করছিল।
তাহলে এটা কি ইলিউশান?
----------------------------------------------
বেশ ক’দিন আগে আমার এক পাঁড় মাতাল বন্ধু সুদর্শন ইকবাল তিনদিন ধরে লাপাত্তা ছিল! একা একটা বাসা ভাড়া করে সবার থেকে অনেক দূরে থাকত।
ফোন ধরছে না- কারো সাথে যোগাযোগ করছে না কেন এই নিয়ে সবাই খুব চিন্তিত ছিলাম! অবশেষে একদিন সকালে ওর বাসায় গিয়ে হামলা দিলাম। মিনিট দশেক ডোর বেল বাজানোর পরে সে দরজা খুলল। ঢুলু ঢুলু রক্তের মত লাল চোখ আর বিধ্বস্ত অবস্থা।
আমাদের দেখে একটু রাগ – এত সকালে ঘুম ভাঙ্গাইলি ক্যান?
ঘুম ভাঙ্গাইলাম মানে- এই কয়দিন তুই কই ছিলি?
-এই কয়দিন কই? সে যেন আকাশ থেকে পড়ল! গতকালই না তোদের সাথে দেখা হইল!
-শালায় কয় কি? এই শালার পুত- তোরে খুঁজতে খুঁজতে জান শেষ! তুই এই কয়দিন কই ছিলি ক?
- সে কোনভাবেই স্বীকার করে না তার সাথে আমাদের তিনদিন দেখা হয় নাই।
শেষে আজকের তারিখ আর দিন দেখালে সে ঝিম মেরে বসে রইল কিছুক্ষণ। তার মাথায় কাজ করছে না কিছু।
বেশ সময় নিয়ে অনেক চাপাচাপির পরে সে স্বীকার করল; তিনদিন আগে নাকি সে এর জিউস বন্ধুর চাপাচাপিতে এল এস ডি এক্সপেরিমেন্ট করছিল!
-দোস্তরে কি ফিলিংস; আমি আর এই দুনিয়ায় নাই! মন চাইলে হালকা হয়ে ভাসতেছি,মন চাইলে ছোট হই,একদম হারায় যাই,আবার ছাদ এসে মাথায় লাগে।
চারিদিকে যে কত রঙ- এত রঙ জীবনে আমি দেখি নাই! জানালা খুলে গাড়ি ঘোড়া সব উল্টায় দিলাম। কাউরে হাত টেনে লম্বা করে দেই, কারো পা চেপে খাটো করি- সে এক এলাহি ব্যাপার! ক্যামনে কি কিছুই বুঝলাম না। পুরাই উরা ধুরা ব্যাপার- যা মন চায় তাই করি!
কিন্তু ফাঁক দিয়ে তিন দিন গেল ক্যামনে???? ( আলাপটা আরো দীর্ঘ ছিল- এই ড্রাগসের প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে আমি বেশী কিছু বলতে চাইনা। কেউ কেউ আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে, মনে হয় নামটা দিয়েই ভুল করলাম।)
সেইদিন ধরে এনে ওকে মার্কেটে হেভি ঝাড় দিয়েছিলাম। কান ধরে শপথ করিয়েছিলাম, আর কোনদিন এসব করবে না বলে। না করে উপায় নাই একজন টেলিফোনে ডায়াল করছিল ওর দেশের বাড়িতে। মায়ের একমাত্র ছেলে সে। মা-কে পাগলের মত ভালবাসে। মা যদি এইসব শোনে তাহলে হার্টফেল করবে।
সারাদিন মদ গাঁজা খাও আর রাতভর বমি কর-সমস্যা নাই, বন্ধুরাই গালিগালাজ করতে করতে সাফ করবে। কিন্তু হেরোইন,এল এস ডি,কোকেন এসবের ব্যাপারে কোন ছাড় নাই! আমাদের বন্ধু আর সিনিয়র ভাইদের এই বিষয়টা খুব ভাল লাগত।
----------------------------------------
তবে আমিতো কোন ড্রাগস সেবন করি নাই। এমন কি এই কয়দিনে একটা বিয়ার পর্যন্ত পান করিনি; তবে আমার কেন ইলিউশান হচ্ছে? ভাবছি আর টেনশন হচ্ছে, দিনের বেলাতেও ভয় ভয় লাগছে। খাবার গলা দিয়ে ঢুকছে না।
দিন না হয় যেমন তেমন রাত কাটাব ক্যামনে? একবার ভাবলাম ষাঁড়ের মত চেঁচাই- পুলিশ টুলিশ এসে দরজা ভেঙ্গে না হয় জানালায় মই দিয়ে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে! আবার ভাবি দেখিই না কি হয়?
ভাগ্যিস গ্রীষ্মকাল- সন্ধে নামে দেরিতে! বাইরে অন্ধকার হতেই-সব ঘরের বাতি জ্বেলে ফুল ভলিউমে টিভি ছেড়ে; লিখতে বসে গেলাম!
কি লিখব ছাই? সাদা কাগজে শুধু বেড়ালের চোখ ভাসে! কি ভয়ঙ্কর কুতকুতে ছাইরঙা আর নীলচে চোখ- শুধু আমার দিকে ক্যাট ক্যাট করে চেয়ে থাকে।
তবুও একসময় লেখায় মশগুল হয়ে ভুলে গেলাম সবকিছু... মাঝ রাতে টিভি চ্যানেল বন্ধ হতেই বাড়িঘর কাঁপিয়ে তার ঝির ঝিরে শব্দে আমি ভয়ঙ্কর ভাবে চমকে উঠলাম!
টিভি বন্ধ করার পরেই ভয়টা বেশ জেঁকে ধরল! শব্দহীন সেই ঘরে আশে পাশে কোথাও কুট করে শব্দ হলেই কেঁপে উঠছিলাম!
কি আর করার শুরু করলাম হেঁড়ে গলায় গান- বাংলা রাশিয়ান, উর্দু হিন্দি, হিপ হপ,রক, র্যা প, পপ কিছু বাদ গেল না। সমস্যা হোল সব গানেরই দু’তিন লাইন পরে আর মনে করতে পারছিলাম না।
ওহ হো মনে পড়ল। শব্দ করার আর একটা উপায় আছে- রান্না করা। ভাবতে ভাবতেই শুরু করে দিলাম রান্নার যোগারযন্ত- গ্যাসের চুলার শো শো শব্দ,পানির ছর ছর,ছুড়ি আর চপার বোর্ডের কচ কচ- খচ খচ সব শব্দই আজ বড় মধুর লাগছে! কেজি খানেক মাংস ফ্রিজ থেকে বের করে গাজরের পেস্ট দিয়ে মাখিয়ে নিলাম! তারপর বাটার,আলু,গোল মরিচ আর সামান্য কিছু মশলা দিয়ে অল্প জ্বালে চড়িয়ে উচ্চস্বরে গান গাইতে গাইতে ইচ্ছে করেই ঘন ঘন নাড়তে লাগলাম!ভোর পর্যন্ত মাংস কষিয়ে কাটানো যাবে! আমি নিজের বুদ্ধিতে নিজে বিমোহিত হয়ে গেলাম!
সে রাতে আর কোন সমস্যা হয়নি- মাংস প্রথমে লাল ভুনা, খানিক বাদে কালো ভুনা আর শেষ মেশ কয়লা ভুনা হয়েছিল শুধু!
দিনের বেলা আমি ঘুমাতে পারিনা- শুধু তন্দ্রার মত আসে আর শরীর ব্যথা হয়ে যায়। এরপরে জো’ ব্যাটা রাত ছেড়ে দিনে এসে উৎপাত করতে লাগল। সে এসে অখন তখন শরীর চাটে- ধাক্কা দিলে ঘেউ ঘেউ করে বাড়ি মাথায় করে নেয়, না হলে খানিকটা দূরে গিয়ে মায়াবী চোখে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আমার দিকে। আবার ক্রিং ক্রিং ফোনের শব্দে শব্দে ঘুম ভেঙ্গে দৌড়ে গিয়ে রিসিভার কানে ঠেকিয়ে বেকুব বনে যাই। এরপরে উটকো শুরু হোল ডোর বেলের শব্দ। কি এক মহা দিকদারিতে পড়লাম!
-----------------------------------------------
টুং টাং টুং বেশ অনেকক্ষণ ধরেই ডোর বেল বেজে চলছিল... সেবারও ভেবেছিলাম ইলিউশান। দরজার কাছে গিয়ে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম; কে?
- মিলিশিয়া!
খাইছে! পিপ হোলে চোখ রেখে দেখি দরজার ওপাশে নীল পোশাকে দু’জন ইয়াং রাশিয়ান পুলিশ। আমি আবার রাশিয়ান ভুতের থেকে পুলিশে ভয় পাই বেশী!
- কি সমস্যা?
- দরজা খোল
- চাবি নাই (ক্লুচি নিয়েতো)
- চাবি নাই মানে? তুমি ভিতরে ঢুকছ ক্যামনে? তাড়াতাড়ি দরজা খোল- পাশের বাসা থেকে কমপ্লেইন এসেছে তোমার নামে?
- কি কমপ্লেইন?
- এ বাসা থেকে নাকি কেউ বের হচ্ছে না ঢুকছে ও না। কিন্তু সারারাত ধরে বাতি জ্বলে!
আরেব্বাস সব খবরাদি লইয়া আইছেন!
- আমার বন্ধু আমাকে রেখে দাচায় গেছে। সে ভুলে চাবি নিয়ে গেছে! আমার কথা বিশ্বাস না হলে দরজা ভেঙ্গে আস।
আমার কাছে চাবি থাকলেও আমি দরজা খুলতাম না। এরা নির্ঘাত পুলিশের ছদ্ম বেশে হুলিগান!আমি জানি আমি দরজা না খুললে- ওরা ভেতরে আসতে পারবে না। এ দরজা খুলতে স্পেশাল যন্ত্রপাতি আর এক্সপার্ট লাগবে।
- তারা অনেক হুমকি ধামকি দিল।
- আমি জানতে চাইলাম তাদের মিলিশিয়া কোড আর দু’জনের নাম। দুজনেই তখন ঘাবড়ে গেল। তারপরে পুলিশের ইজ্জত রাখতে একটা কোড আর নাম বলল; আমি আসছি বলে ভিতরে গিয়ে আজইরা ডায়াল ঘুরিয়ে। চিৎকার চেঁচামেচি করে দা নিয়েত স্তো চিভো ( হ্যাঁ না কি তাই)
এইসব বলে ফিরে এসে পিপ হোলে চোখ রাকতেই দেখি মিলিশিয়া উধাও!
ভাবছিলাম এইটাও কি ইলিউশান!
সারাদিন আর ঘুম আসলনা- ফের লিখতে বসলাম।
সাদায় পাতায় দেখি বেড়ালের চোখ, মিলিশিয়ার চেহারা,জো’র অভিমানী মুখায়বব! সে রাতটাও গেল নির্ঘুম-উল্টা-পাটা লেখালেখির চেষ্টায়,গভীর রাত অব্দি উঁচু ভলিউমে টিভি আর টিভি চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেলে ভোর অব্দি রান্না বান্না করা। ইচ্ছে করে তেল মশলা বেশী করে দিই। আনিস এই মশলাগুলো বাংলাদেশ থেকে এনেছে- খুব যত্ন করে রাখে। আর আমি তার উপর রাগে ক্ষোভে প্রয়োজনের থেকে তিনগুণ মশল্লা খরচ করছি। প্রথম দিনের খাবার এখনো পরে আছে। অযথাই নিঃসঙ্গতা আর ভয় কাটানোর জন্য রাঁধছি।
নবম দিন সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমালাম। বসে থাকলেই ঝিমুনি আসে। সে রাতে টিভিতে দেখলাম আমার এযাবৎ দেখা সবচেয়ে হাসির ছবি!
রুশ ভাষায় নয়- সম্ভবত পোলিশ অথবা চেক ভাষা না বুঝেই !ছবি দেখে হাসতে হাসতে বহুবার চোখে পানি চলে এল। কাশি হোল- পেট ব্যথা হোল,বুকের বাঁপাশে চিলিক দিল।
রাত তখন পৌনে একটা হবে। ছবি শেষ। আমি তখনো মনে মনে দুলে দুলে হাসছি। সব ঘরের বাতি জ্বলানো হয়নি। এ দু’দিনে ভয় কেটে গেছে অনেকটা। তার উপরে হাসির ছবি দেখে বেশ একটা জোশ চলে এসেছে।
সারাক্ষণ দরজা জানালা আটকানো থাকায় কেমন যেন একটা গুমোট ভাব। আমি উঠব সবে জানালা খোলার জন্য- ডিভানে বসেই উঠব উঠব করে বা দিকে জানালার দিকে তাকাতেই শরীর হিম হয়ে গেল! দৃশ্যটা দু থেকে তিন সেকেন্ডের! শুধু দেখলাম ভারি পর্দার ওপাশ থেকে একজোড়া চোখ নির্নিমেষে চেয়ে আছে আমার দিকে। জানালার ওপাশ থেকে পর্দার এপাশে একদম স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি। শিরদাঁড়া বেয়ে বিদ্যুতগতিতে একটা স্রোত বয়ে গেল- পরক্ষনেই শরীরে একটা ঝাঁকুনি। আর কিছু মনে নেই আমার।
• সম্ভবত ভোরের দিকে আমার জ্ঞান ফিরেছিল। এ ঘটনার পরে কিছুটা মানসিক বৈকল্য ও ঘোরের মধ্যে ছিলাম কিছুদিন। সে সময়ের স্মৃতি ভয়ানক ঝাঁপসা- বলতে গেলে কিছুই মনে নেই। সেখান থেকে বেরিয়ে আমি আর আনিসের বাসায় যাইনি কোনদিন।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০২১ রাত ৮:২৬