Little darling, don't shed no tears
No, woman, no cry
Little sister, don't shed no tears
No, woman, no cry
গুরুর বারোয়ারী বাড়ি!
মস্কোর পেত্রোবোভাস্কাইয়া স্টেশনের অদূরে একটা ১২ তলা পুরনো এপার্টমেন্টের আট তলায় একটা মাত্র বেশ বড় একটা রুমে ওরা দশ বারোজন মিলে থাকে। রুম লাগোয়া ছোট্ট একটা কিচেন কাম ডাইনিং, ডাইনিং এ গোল একটা টেবিল আর চারপাশ ঘিরে চারটে ওকে কাঠের চেয়ার –সাথের করিডরে পাশাপাশি দুজন মানুষ যেতে কষ্ট হয়।
ওদের দশ বারোজনের সেখানে থাকতে বিশেষ একটা কষ্ট হয়না- মাঝে মধ্যে গেস্ট বেড়ে যায় দু’চারজন, তখন আরো বেশী মজা হয়। সারা রাত পান ভোজন হেঁড়ে গলায় গান আর ভোরের দিকে জড়াজড়ি করে দুপুর অব্দি ঘুমানো। ওদের কোন চাকুরী নেই ব্যবসা নেই কাজ কর্ম কিছু নেই। খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বেরুতে হয় না বিশেষ- বাজার আনার লোক আছে। শুধু রান্না করা খাওয়া আর ঘুম- ও হ্যাঁ আরো কিছু একটার জন্য প্রতীক্ষা করা।
ছেলেগুলোর বয়স বাইশ থেকে পঁচিশের মধ্যে। তখন টগবগে যৌবন সবার।
গুরু আব্দুল্লাহর গল্প এর আগেও করেছি আমি। ছোট খাট গড়ন,ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুল, একটু চাপা গায়ের রঙ,উজ্জ্বল দুটি চোখ আর টিকালো নাকে তাকে অন্যরকম লাগে। কথা বলে কম-মুচকি হাসি আর চাহনীতে অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়।
ব্যক্তিত্বহীন মানুষেরও ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে পরিবেশ ও তাঁর অবস্থানগত কারণে। গুরু ব্যক্তিত্ববান ছিলেন নিঃসন্দেহে- কিন্তু তাঁর অবস্থানগত কারনে সেটা আরো বেশী পোক্ত মনে হোত। তিনি যা বলতেন সবাই সেটাকে বেশ গুরুত্বের সাথে নিত- তাঁর কথা বলার স্টাইল,খাওয়ার স্টাইল, চলাফেরা সবাই অনুকরণ ও অনুসরণ করার চেষ্টা করত। তিনি যে খাবারটার প্রশংসা করতেন সেটার প্রশংসা বাকি সবাই মিলে আরো দশগুণ বেশী করত।
আবদুল্লাহ এখানে থাকত না বিশেষ- সে অন্য বন্ধুদের এপার্টমেন্টে না হোস্টেলে থাকত। তিনি মাঝে মধ্যে কয়েকজন সাঙ্গ-পাংগ নিয়ে সবার দুহাত ভর্তি বাজার আর লিটার লিটার মদের বোতল নিয়ে আসতেন। তখন একটানা সপ্তাহ খানেক পান ভোজনের উৎসব হোত।
আসরের শুরুতেই আব্দুল্লাহ বলত মাগ্নিতোলায় তাঁর প্রিয় গানটা বাজাতে। বাংলাদেশ টিভিতে তখন শুরু হয়েছে হুমায়ুন আহমেদের চরম জনপ্রিয় নাটক কোথাও কেউ নেই। তারা জানতও না এর খবর। এখানে বাকের ভাই শুনছেন- হাওয়া মে উড়তা যায়ে মেরা লাল দুপাট্টা মল মল কি আর আট হাজার কিলোমিটার দূরে রিয়েল লাইফে আব্দুল্লাহ শুনছে ~ নো উইম্যান নো ক্রাই~সাথে সে পেগের পর পেগ গিলছে ,হাতে তাঁর গাঁজার স্টিক।
গাঁজায় কষে দম দিয়ে মুদিত চোখে ঝাঁকড়া কোঁকড়ানো চুল দুলিয়ে দুলিয়ে হেঁড়ে গলায় চীৎকার করছে ~ নো উইম্যান নো ক্রাই~ তাঁর সাথে সাথে সবগুলো ছেলে পিলে মলে কোরাসে চীৎকার করছে ~নো উইম্যান নো ক্রাই। এর মধ্যে লাউয়া ফরহাদের গলার জোর সবচেয়ে বেশী। পাঠানদের মত বিশাল দশাসই ফিগার আর কোমর অব্দি লম্বা চুলের জন্য সবাই তাকে স্পেশাল খাতির করে। গুরু বাইরে গেলে এমন একটা ছেলেকে নিয়ে হাটতে বেশ গর্ব বোধ করে- তাই তাঁর প্রিয়ভাজন সে,স্পেশাল কোন অকেশানে লাউয়া’র ডাক পড়ে(কেউ কেউ ‘চুলা’ ফরহাদ ও বলে)।
গুরুর আরেকজন শিষ্য আছে,নাম ফেরদৌস। কেউ জিজ্ঞেস করলে খুব ভাব নিয়ে বলে ফেরদাউস! ভীষণ চাপা গায়ের রঙ- অন্ধকারে না হাসলে ঠাহর করতে কষ্ট হয়। বেশ হৃষ্টপুষ্ট শরীর- বয়সেও সবার থেকে বড়, বঁপুখানা বেশ পুষ্ট।
তাঁর বিশেষ বৈশিষ্ঠ হল,তিনি আমেরিকা যাবার জন্য রাশিয়া থেকে কেমনে কেমনে কিউবা গিয়ে পৌঁছেছিলেন। কিউবার সমুদ্রতট থেকে মায়ামি বিচ মাত্র তিনশ মাইল পথ। দ্রুতগামী নৌযানে মাত্র দশ/বার ঘণ্টা লাগে। তিনি সেরকম এক দুঃসাহসিক যাত্রার অভিযাত্রী ছিলেন আন্তর্জাতিক নৌ-সীমানা পেরিয়ে একটু এগিয়ে যেতেই ফ্লোরিডার কোষ্টগার্ডের নজরে পড়ে যান। প্রথমে তারা হ্যান্ড মাইকে হুশিয়ারি করে – তারপরে হেলিকপ্টার থেকে নৌকার গা ঘেঁষে গুলি বর্ষণ। সবার লাইফ জ্যাকেট ছিল। ভয়ে তারা মাঝ সমুদ্রে ঝাঁপ দেয় সবাই- সেই খালি নৌকা নাকি কোষ্টগার্ড গুলি করে ডুবিয়ে দেয়। স্থানীয় জেলেদের তৎপরতায় কোন রকম জীবন বাঁচিয়ে ফরতে পেরেছিলেন নাকি। ঘটনা সত্য নাকি চাঁপাবাজি- সেটা বোঝা মুশকিল ছিল তখন। তাদের পরিচিতদের কেউ কখনো কিউবাতে যায়নি- তারপরে আমেরিকার এত কাছ থেকে ফিরে আসার জন্য সবাই তাকে নিয়ে বেশ গর্বিত ছিল। আব্দুল্লাহ নতুন কোন আড্ডা বা আসরে তাকে নিয়ে যেতেন। সবখানেই তিনি আমেরিকা আর কিউবার গল্প করে জমিয়ে দিতেন।
কারো হাতে মদের গেলাস –কারো হাতে গাঁজার স্টিক। সবাই গুরুর দেখাদেখি মাথা ঝাঁকিয়ে নিবিষ্ট মনে গাইছে ~ নো উইম্যান নো ক্রাই~
গাইতে গাইতে আবেগ কন্ট্রোল করতে না পেরে কেউ কেউ আবেগে কেঁদেও ফেলছে। ওদের মাঝে অর্ধেকের বেশী প্রথম লাইনটা বাদে বাদবাকি গান মন দিয়ে শোনে ও না- শুনলেও মানে বোঝেনা বিশেষ। তারা সবাই অপেক্ষা করে গানের ওই লাইনটার জন্য~ নো উইম্যান নো ক্রাই~
মদ খেতে খেতে পুরো লোড হয়ে গুরু মাঝে মধ্যে উঠে টয়লেটে যায়। গোপন খবর এসেছে তিনি নাকি গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করতে যান।এজন্য নাকি সারারাত মদ গিলে, গাঁজা টেনেও তিনি কখনো মাতাল হন না।
টয়লেট থেকে সত্যিই সে একদম একটুখানি না টলে সোজা এসে বসে হাঁক দেন ফরহাদ খাবার দাবার কি আছে? ফরহাদ হম্বিতম্বি করে খুব কিন্তু নিজে চরম ফাঁকিবাজ! সে একে ওকে জিজ্ঞেস করে হুকুম করে। যার হাতের রান্না ভাল তাকে ইশারা করলেই -সে উঠে গিয়ে রান্না চড়ায়।
রান্নার ফাঁকে ফাঁকে শেফ ফিরে এসে একপেগ গলায় ঢেলে দাঁড়িয়ে দাড়িয়েই সবার থেকে জোড় গলায় চীৎকার করে গায়~ নো উইম্যান নো ক্রাই~ সাথে সাথে ফেরদৌস আর ফরহাদ তাঁর দিকে গ্লাস তুলে মুচকি হেসে সুর করে আহা হা করে বলে ~ নো উইম্যান নো ক্রাই~
শেফ মহাশয় ভীষণ উদ্বেলিত হন নিজেকে বেশ সন্মানিতবোধ করেন। রান্নাটা যাতে আরো ভাল হয়, সে জন্য দ্রুত চুলার কাছে ফিরে যায়। সে রান্নার তালে তালেই রান্নাঘরে বসে সুর তোলে ~ নো উইম্যান নো ক্রাই~তখন সে এত আবেগী যে দু’এক ফোটা চোখের জল গানের সাথে গড়িয়ে পড়া বিচিত্র নয়।
শেফ মহাশয় অনেক্ষন আসছেন না – ফরহাদ একটা গ্লাসে খানিকটা মদ ঢেলে এক টুকরো লবনে জারান শসা বা পনির নিয়ে এগিয়ে যায় রান্না ঘরে- ‘ওস্তাদ এইটা মাইরা দেন।‘ বলে তাঁর হাতে গ্লাস আর জাকোজকা দিয়ে ব্যাপক বুদ্ধিমত্বার সাথে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে গেয়ে ওঠে~ নো উইম্যান নো ক্রাই~
সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়ে গভীর রাত অব্দি একটা গানই বাজে আর সবাই মিলে ওই লাইনটার প্রতীক্ষায় থাকে ...
এখানকার জোশ মাঝে মধ্যে একটূ কমে এলে গুরু লং ডিস্ট্যান্সে ফোন লাগায়- প্যারিস বা রোমে স্পিকারে দিয়ে তাদের বন্ধুদের গান শোনায় ~ নো উইম্যান নো ক্রাই~ ওদিক থেকে ওরাও মদ খেয়ে চীৎকার করে ~ নো উইম্যান নো ক্রাই~
-----------------------------------------------
গুরু, লাউয়া, আর ফেরদাউসের দেখা নেই অনেকদিন। দশ বারোজন যুবক ছেলের বদ্ধ ওই ঘরে রাত গুলো কেমন নিস্প্রভ মনে হয়- ওদের ছাড়া জোশ আসতে চায় না যদিও ওরা প্রতি রাতেই মদ খেয়ে মাতাল হয়, রান্না চলে ঢিমেতালে।~ নো উইম্যান নো ক্রাই ~গানের সাথে যথেষ্ট আবেগ নিয়ে সুর মেলায়- শূধু গানের তালটা আর গাঁজাটা মেলে না। সেটা গুরুর স্পেশাল ট্রিট! এখানে গাঁজা খাওয়া ও রাখা দুটোই বড় ধরনের ক্রাইম। এই অপরাধে নাকি কেউ কেউ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও ভোগ করছে।
বিষয়টা তবে গাঁজার অভাব নয় মুল সমস্যা গুরুর সঙ্গ। তাকে ছাড়া সবকিছু কেমন যেন ম্যাড়মেড়ে লাগে। তবুও দিন যায় রাত যায়- কেটে যায় কোন মতে।
* মাগ্নিতোলাঃ টেপ রেকর্ডার/ ক্যাসেট প্লেয়ার/ ডেক সেট
* জাকোজকাঃ মদের সহযোগী খাবার।
গানের লিঙ্ক( ব্লগার অপু তানভীরের আদেশে): https://www.youtube.com/watch?v=pHlSE9j5FGY
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০২১ সকাল ৮:২২