somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভারত উপমহাদেশের প্রথম সম্রাজ্ঞী দুর্ধরা ও তার ছেলে বিন্দুসার!

২০ শে জানুয়ারি, ২০২৩ রাত ৮:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


গধের সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত রাতের খাবার গ্রহণ করছেন-তার পাশেই উপবিষ্ট তাঁর প্রানিধিক প্রিয় স্ত্রী দুর্ধরা! দুর্ধরা তখন নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা! রাজ চিকিৎসক বলেছেন আর মাত্র সপ্তাহ-খানেকের অপেক্ষা। তিনবছর আগে দুর্ধরা’র যমজ পুত্রের জন্ম হয়েছিল- কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে জন্মের তিন দিনের মাথায় দু’জনই মৃত্যুবরণ করে। এর পর থেকেই দুর্ধরা বেশ কিছুদিন চরম মানসিক পীড়া বা বিষণ্ণতায় ভুগেছিল। সে আহার নিদ্রা প্রায় ত্যাগ করেছিল। চন্দ্রগুপ্তের ভালবাসা আশ্বাস ও স্নেহে সে ফের সজীব হয়েছে। এবার চন্দ্রগুপ্ত রাজকার্যের পাশাপাশি যথাসম্ভব কাছে থেকে তার দেখভাল করছে।
দু’জনে একটা থালা থেকেই আহার করছিল। আচমকা দুর্ধরা ব্যথায় কঁকিয়ে উঠে ঢলে পড়ছিলেন! চন্দ্রগুপ্ত দ্রুত হাতে তাকে ধরে ফেললেন। তিনি ভাবলেন দুর্ধরার প্রসব যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। তিনি চিৎকার করে সেবাদাসীকে ডেকে রাজ চিকিৎসককে খবর দিতে বললেন। দুর্ধরা প্রচণ্ড ব্যথায় নীল হয়ে গেছে! তাঁর চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে আর শরীর যেন বরফের মত শীতল হয়ে আসছে।
রাজ-গৃহে একান্ত অনুগত দাস দাসীদের সমাবেশ – তারা তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করছে রোগীর শুশ্রূষা করার, চন্দ্রগুপ্ত কিন্তু তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর হাত ছাড়েননি। অমঙ্গল চিন্তায় তিনি ভীষণ বিষণ্ণ।
রাজ চিকিৎসক দ্রুতই চলে আসলেন। তার সাথে এসে উপস্থিত হয়েছেন ইতিহাসের সর্বকালের সর্বসেরা, অর্থশাস্ত্রবীদ, কূটনীতিক, দার্শনিক, তক্ষশীলার সবচাইতে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, চন্দ্রগুপ্তের গুরু-মেন্টর চাণক্য! তিনি দুর্ধরার চেহারা দেখেই আশংকিত হয়েছেন- তাঁর অভিজ্ঞতায় এটা প্রসব বেদনা নয় অন্য কিছু।
রাজ চিকিৎসক রোগীকে পরীক্ষা করে ভীষণভাবে কেঁপে উঠলেন! তিনি চাণক্যকে ইশারায় কাছে ডেকে নিচু স্বরে কি যেন বললেন।
চাণক্য এমনই আশঙ্কা করছিলেন! তিনি চন্দ্রগুপ্তের কাঁধে হাত রেখে সেকথা বলতেই, চন্দ্রগুপ্ত হুঙ্কার দিয়ে উঠে তাঁর তলোয়ার কোষমুক্ত করে রাজ চিকিৎসকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলেন। তাকে দৃঢ় হাতে থামালেন চাণক্য।
চন্দ্রগুপ্তের চোখে জল! কিভাবে সম্ভব- আমি বিশ্বাস করিনা। আমরা দুজনে একই থালা থেকে আহার করেছি। ভয়ঙ্কর বিষক্রিয়ায় সে মৃত্যুমুখে কিন্তু আমিতো দিব্যি সুস্থ আছি!!!
চাণক্য পিতার আদরে তাঁর হাত ধরে ঘরের একপাশে নিয়ে নিচু স্বরে বলল, মহারাজ, আমি এমন একটা সময় আসার আশঙ্কা করেছিলাম আপনাকে আমার আশ্রয়ে নিয়ে আসার পর থেকেই। আমার মনে হয়েছিল কোন একদিন কেউ আপনাকে বিষ দিয়ে হত্যা করতে পারে। তাই বহু বছর ধরে আমি আপনার খাবারের সাথে অল্প অল্প বিষ মিশিয়েছি- সেটা আপনার অজ্ঞাতসারে। সেজন্যই আজকের বিষ আপনার উপরে ক্রিয়া করেনি।
চানক্য বলতে থাকলেন; দেখুন, সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে হবে। খাবারে যে পরিমাণ বিষ মেশানো হয়েছে, তাতে দুর্ধরা বেঁচে ফিরে আসার কোন সম্ভাবনাই নেই। তবে আমরা চেষ্টা করলে তাঁর পেটের সন্তান, সম্ভবত; সে আপনার পুত্র, এই বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারকে বাঁচাতে পারি।
সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত তখন বিস্ময়, হতাশা কষ্টে নির্বাক বিমুঢ় হয়ে গেছেন। কোন মতে জিজ্ঞেস করলেন, কিভাবে?
সম্ভবত বিষ এখনো তাঁর গর্ভাশয়ে ছড়ায়নি। যাতে ছড়াতে না পারে সেজন্য রানীর ধর থেকে মাথা আলাদা করতে হবে- তারপরে পেট কেটে আপনার সন্তানকে বের করতে হবে।
কি ভয়ঙ্কর কথা! চন্দ্র গুপ্তের যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না! তাঁর পিতৃসম গুরু চাণক্য তাকে এমন ভয়াবহ একটা প্রস্তাব দিবেন। তিনি একটিবার মাত্র ভীষণ করুন নেত্রে তাঁর অতি প্রিয়তমা, ঘনিষ্ঠ সহচর, প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঘর থেকে ছট ফট করতে করতে বেড়িয়ে গেলেন। শুধু কোনমতে চাণক্যকে বললেন; আপনাদের যা ভাল মনে হয় তাই করুন।

দুর্ধরা চন্দ্রগুপ্তের মা মুরা'র বড় ভায়ের মেয়ে। পঁয়ত্রিশ বছরের মধ্যবয়সী পুরুষ সে। শিক্ষা, যুদ্ধ, শত্রুকে ফাঁকি দিয়ে পলায়ন, বন জঙ্গলে আত্মগোপন, নতুন নতুন যুদ্ধের পরিকল্পনা, সৈন্য সংগ্রহ, রাজ্য জয় করতে করতেই ত্রিশটা বসন্ত কোথা দিয়ে চলে গিয়েছিল টের পায়নি।
প্রেম ভালবাসার সুযোগই আসেনি কখনো। নারী সঙ্গ পেয়েছে কিন্তু নারী হৃদয়ের অলিতে গলিতে প্রবেশ করেনি কখনো। তাকে এমন করে আদর করে, সোহাগ দিয়ে যত্ন করে ভালোবাসেনি কেউ।
তাঁর মায়ের আবদারে – মামাতো বোন দুর্ধরাকে প্রথম দেখাতেই ভাল লেগেছিল। কতই বয়স হবে তাঁর তখন –এই এগার বার বছরের কিশোরী সে তখন সবে।( ভারতবর্ষে তখন ৭ থেকে ১২ বছরের মধ্যে কন্যার বিয়ে দেয়ার নিয়ম ছিল। বয়স ১২ বা তাঁর ঊর্ধ্বে গেলেই সে কন্যার বিয়ে দেয়া ভীষণ কঠিনতর ছিল)।
এখন সতের বছরের যুবতী সে মাত্র। পৃথিবীকে বোঝার আগেই চেনার আগেই –তাকে বিদায় নিতে হোল।
সেদিন পৃথিবীর ইতিহাসের চিকিৎসা শাস্ত্রে এক অনন্য নজির স্থাপন হয়েছিল। এই প্রথম মৃত মায়ের পেট কেটে সুস্থ সন্তানকে বের করে আনা হোল। জন্ম হল সুদূর আফগানিস্তান থেকে কাশ্মীর হয়ে কন্যাকুমারী, নেপাল থেকে বাংলার অন্যতম ক্ষমতাধর নৃপতি ও সম্রাট অশোকার পিতা বিন্দুসারের! কপালে একটা কালো তিলক নিয়ে জন্মালেন তিনি- বলা হয় মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থাতেই বিষের ফোঁটা কপালে পড়েই তাঁর এই তিলকের সৃষ্টি!
~~~~~~~~~~~~~~~~
(দুর্ধরা ছিলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রথম স্ত্রী এবং প্রধান সহধর্মিণী। তার নামের অর্থ 'বিশিষ্ট'। জৈন গ্রন্থ অনুসারে মহাবংশতিকা দুর্ধরা ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মা মুরার বড় ভাইয়ের মেয়ে। দুর্ধরা এবং চন্দ্রগুপ্তের বিবাহ হয়েছিল ৩২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। তিনি একজন সাধারণ মানুষ থেকে ভারতের সম্রাট পর্যন্ত স্বামীর সাফল্য উপভোগ করতে বেশি দিন বাঁচেননি। পুত্র বিন্দুসারের জন্ম দেওয়ার ঠিক আগে তিনি মারা যান। বলা হয় বিষের এক ফোঁটা শিশুর কপালে পড়ে কালো গোলাকার দাগ তৈরি করেছিল। তাই তাঁর নাম রাখা হয়েছিল বিন্দুসার। বিন্দুসার চাণক্যের প্রিয় হয়ে ওঠেন যিনি তাকে চরম স্নেহের সাথে লালন পালন করেছিলেন এবং তাকে যুদ্ধ এবং প্রশাসন সম্পর্কে শিক্ষা দিয়েছিলেন।
দুর্ধরা ছিলেন মগধ সাম্রাজ্যের প্রথম সম্রাজ্ঞী এবং রানী মাতা (মরণোত্তর)। চন্দ্রগুপ্ত তার মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন কাউকে বিয়ে করেননি। চন্দ্রগুপ্ত দুর্ধরাকে খুব ভালোবাসতেন যদিও পরবর্তীকালে তিনি রাজনৈতিক বাধ্যতার জন্য সর্বপ্রথম ধনানন্দের (নাম অজানা) কন্যা নন্দ রাজকন্যাকে বিয়ে রানী করেছিলেন এবং পর আরও অনেক রাজকন্যাকে বিয়ে করেছিলেন, তবুও দুর্ধরা কেবল চন্দ্রগুপ্তের (মরণোত্তর) প্রধান স্ত্রী এবং মৌর্য সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী ছিলেন। চন্দ্রগুপ্তের আর কাউকে কখনো রাজরানী বা প্রধান রাণী বানাননি।)
********#********
ছুটির দিনে আকামে বসে থেকে ঐতিহাসিক একটা ঘটনা নিজের মত বয়ান করার চেস্টা। ভুল-ভাল থাকলে আওয়াজ দিবেন।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০২৩ রাত ৮:৫২
২০টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গাজার শিশুদের উদ্দেশ্যে - আমরা তোমাদের রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৫


তোমরা এসেছিলে মাথার উপর বোমা পড়ার ভয়ার্ত গল্প নিয়ে। যে বোমা তোমাদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে, লোকালয় ধ্বংস করেছে। আমরা কান বন্ধ করে উদাসীন হয়ে বসে ছিলাম। তোমরা এসেছিলে ছররা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রিকশাওয়ালাদের দেশে রাজনীতি

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৪৯

রিকশাওয়ালাদের দেশে রাজনীতি

সবাই যখন ওসমান হাদিকে নিয়ে রিকশাওয়ালাদের মহাকাব্য শেয়ার করছে, তখন ভাবলাম—আমার অভিজ্ঞতাটাও দলিল হিসেবে রেখে যাই। ভবিষ্যতে কেউ যদি জানতে চায়, এই দেশটা কীভাবে চলে—তখন কাজে লাগবে।

রিকশায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপিকেই নির্ধারণ করতে হবে তারা কোন পথে হাটবে?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:০৫




অতি সাম্প্রতিক সময়ে তারেক রহমানের বক্তব্য ও বিএনপির অন্যান্য নেতাদের বক্তব্যের মধ্যে ইদানীং আওয়ামীসুরের অনুরণন পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিএনপি এখন জামাতের মধ্যে ৭১ এর অপকর্ম খুঁজে পাচ্ছে! বিএনপি যখন জোট... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবিতে গণতন্ত্রের নামে মবতন্ত্র

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:১০



তথাকথিত গণতন্ত্রকামীদের পীর আল্লামা পিনাকী এবং ছোট হুজুর ইলিয়াস মোল্লার উস্কানীতে দেশজুড়ে চলছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে মবতন্ত্র। আল্লামা পিংকুর যুক্তি হচ্ছে- যে বা যারাই তাদের (গণতন্ত্রকামীদের) সূরে কথা না... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী বিপ্লবীর মৃত্যু নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৩৭



শরিফ ওসমান হাদি। তার হাদির অবশ্য মৃত্যুভয় ছিল না। তিনি বিভিন্ন সভা-সমাবেশ, আলোচনা ও সাক্ষাৎকারে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি অনেকবার তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা বলেছেন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদ ও ভারতবিরোধী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×