somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মানুষ কেন অনন্য - পর্ব ৪

০৫ ই মার্চ, ২০২৩ সকাল ১১:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পেনডোরার বাক্সের ঘটনা তো সবার জানা। গল্পটা এ রকম; পেনডোরাকে একটা বাক্স দিয়ে বলা হলো, খবরদার এই বাক্স তুমি খুলবে না। কৌতূহলের কারণে পেনডোরা সেই বাক্স খুলল, বাক্স থেকে বের হলো দুঃখ, কষ্ট, জরা, দুর্ভিক্ষ, ভয়ঙ্কর সব জিনিস... উঁহু পেনডোরার সেই বাক্সে আরো কিছু ছিল যেগুলো ধীরে সুস্থ্যে অতি সঙ্গোপনে বের হয়ে এসেছে – যেমন; লজ্জা, বিব্রতবোধ, সঙ্কোচ, হতাশা সহ অসংখ্য বাজে ব্যাপারগুলো সেই থেকেই এসব পৃথিবীতে আছে। পেনডোরা কৌতূহলী না হলে হয়তো আজ আমরা চির সুখে থাকতাম।
আচ্ছা অন্য প্রাণীদের কি দুঃখবোধ বা কষ্টবোধ আছে, তারা কি হতাশ হয়? ধরুন একটা চিতা তার সর্বোচ্চ গতিতে এক মিনিটের কাছাকাছি সময় দৌডুতে পারে- সে গতিতে এর থেকে বেশী সময় ধরে দৌড়ুলে তার হৃদপিণ্ড ফেটে যেতে পারে। একটা শিকারের পেছনে দোড়ানোর তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা ততটুকু। সেই সময়টাতে সে যদি শিকার ধরতে বিফল হয় তবে কি দুঃখে কষ্টে ভিতরে ভাংচুর হয় কিংবা সে ভীষনভাবে হতাশ হয় কিংবা বিব্রত? চিতা-বাঘিনী হয়তো তার বাচ্চাকাচ্চা সমেত দাড়িয়ে দেখছিল বাঘের শৈর্যের প্রদর্শনী- সেখানে শিকার ধরতে বিফল হওয়া বিব্রতকরই বটে! প্রাণীদের দুঃখ বা কষ্টবোধ আছে, তারা ব্যাথা পেলে চিৎকার করে কিন্তু সম্ভবত বিব্রতবোধ করে না। বিব্রতবোধ প্রাণী জগতে শুধু মানুষের মধ্যেই আছে হয়তো।
*****
এবার আসি ব্লাশিং-এ ব্লাশ অর্থ আচমকা রক্ত ছলকে ওঠা যাকে আমরা সংক্ষেপে বলি ‘আরক্তিমতা’যেটা মুলত লজ্জার কারনকেই ব্যাখ্যা করে- ছোটখাট অপরাধ বা আকাম করে বিব্রত হলে সেখানে 'আরক্তিমতা' ব্যাবহৃত হতে দেখিনি তেমন। যে কারনে বাংলায় প্রতিশব্দটা যুতসই মনে না হওয়াতে আমরা ইংরেজী ব্লাশ বা ব্লাশিং শব্দটাকেই ব্যাবহার করছি।
অতি বিখ্যাত বিবর্তনবাদ তত্ত্ববিদ চার্লস ডারউইন স্বীকার করেছিলেন; তার ১৮৭২ সালের বই ‘দ্য এক্সপ্রেশন অফ দ্য ইমোশনস ইন ম্যান অ্যান্ড অ্যানিম্যালসে’র ১৩তম অধ্যায়টি আত্ম-মনোযোগ, লজ্জা, সংকোচ, বিনয় এবং ব্লাশিং সহ জটিল মানসিক অবস্থা একান্ত মানবীয় গুণাবলি হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তন্মধ্যে তিনি ব্লাশকে "...সবচেয়ে অদ্ভুত এবং সবচেয়ে মানবিক অভিব্যক্তি" হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
লজ্জা পাওয়ার জন্য ডারউইনের ব্যাখ্যা
ডারউইন যখন দ্য এক্সপ্রেশন অফ দ্য ইমোশন্স ইন ম্যান অ্যান্ড অ্যানিম্যালস লিখেছিলেন, তখন তিনি অনেক আবেগের ব্যাখ্যা করেছিলেন, কিন্তু, লজ্জা কেন পায়; এ বিষয়ে তার কেবল কিছু পর্যবেক্ষণ ও বিভ্রান্তি ছিল, ব্যাখ্যা ছিল না। আসলে, তিনি মনে করেননি ব্লাশ আধুনিক মানুষের সার্ভাইভালে কোন সুবিধা বহন করছে।
ডারউইন বিশ্বাস করতেন যে,পর্যবেক্ষকদের জন্য ব্লাশিং কিছু অসুবিধায় ফেলে। তিনি ভেবেছিলেন যে লোকেরা যখন তাদের শরীরের একটি নির্দিষ্ট অংশে ফোকাস করে তখন সে লাল হয়ে যায়। নিজেদের প্রতি তাদের মনোযোগ অন্য অংশের রক্তনালীগুলির সংকোচনের সাথে ওই ওঞ্চলের শিরা/উপশিরাগুলো প্রসারিত হয়।
ব্লাশিং বিষয়ে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, মুখ রক্তিম হওয়ার কারণ হল আমাদের মুখের প্রতি অন্য লোকের মনোযোগ। যখন কেউ আমাদের নিজের মুখের দিকে বিশেষভাবে মনোযোগ দেয় তখন মুখের রক্তনালি বা শীরা-উপশিরাগুলো সঙ্কোচিত হয় ও ত্বক প্রসারিত হয় যার ফলে আমরা লাল হয়ে যাই। ডারউইনের যুগান্তকারী কিছু বিবর্তন তত্ত্ব থাকা সত্ত্বেও, তার ব্লাশিংয়ের এই ব্যাখ্যা ছিল চরম ভুল।

ব্লাশ কি? কপোল জুড়ে এক রাশ রক্তের ঝলক। এমন ব্যাপারটা কি জন্য ঘটছে?
অনেক বিজ্ঞানী এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু একটি ব্যাপক এবং বৈজ্ঞানিক উত্তর এখনও উপস্থাপন করা হয়নি। স্পষ্টতই, এটি মুলত জনসাধারণের উপস্থিতিতেই কিতু কিছু ক্ষেত্রে লজ্জাজনল বা বিব্রতকর কোন কিছু কল্পনা করার সময়ে ব্লাশিং হতে পারে, তবে কেন এটি ঘটে তা খুব স্পষ্ট নয়। এমনকি ডারউইন এবং ফ্রয়েডের ব্লাশিং এর ব্যাখ্যাও বিশ্বাসযোগ্য ছিল না।

প্রশ্নঃ ডারউইন ব্লাশিং সম্পর্কে কি ভাবতেন?
ডারউইন ব্লাশিং এর জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা খুঁজে পাননি এবং এটিকে একটি অত্যন্ত রহস্যময় কাজ বা একটি অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর (উলটাপালটা) ফাংশন বলে মনে করেছিলেন।

প্রশ্ন: অবদমিত প্রদর্শনীবাদের (অশ্লীলভাবে দেহকে অনাবৃতকরণ) কারণে কি লাল হয়ে যায়?
ব্লাশের একটি ব্যাখ্যা হল যে এটি একজন ব্যক্তির নিজেকে "দেখানো" এবং মনোযোগ আকর্ষণ করার অচেতন আকাঙ্ক্ষার ফলে ঘটে, যখন সামাজিক নিয়মগুলি সেটির অনুমতি দেয় না। একে বলা হয় 'অবদমিত প্রদর্শনবাদ'

প্রশ্ন: টমাস হেনরি বার্গেস কীভাবে ব্লাশিং ব্যাখ্যা করেছিলেন?
বার্গেস ব্লাশিংয়ের জন্য একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন: এটি অন্য লোকেদের কাছে এটা একটি অনুভূতিমূলক শারিরিক চিহ্ন যে আমরা স্বীকার করি যে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বা নৈতিক নিয়ম লঙ্ঘন করেছি।

~ ব্লাশিং কেন যেন পুরুষদের থেকে নারীদের ভাল মানায় :) কেন? হয়তো আমাদের মাথায় গেথে গেছে- 'লজ্জা নারীর ভূষণ' ব্যাপরটা! (নেটে ব্লাশের যে কয়টা ছবি মেলে তাঁর নব্বুইভাগ মেয়েদের ছবি!!

ব্লাশিংয়ের ব্যাপারে বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিকবিদেরা অনুমান করেছেন: “ব্লাশিং একটি ব্যাপার যা চেহারাকে এমন কিছু পরিবর্তন আনে তা থেকে বোঝা যায় যে কোন একটা কিছু অন্যরকম ঘটেছে। আমরা যখন লজ্জা বোধ করি, তখন আমরা আমাদের আবেগগুলি অন্যদের কাছে প্রকাশ করি এবং এভাবেই তাদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত পাঠাই৷ ... এটা অন্যপক্ষকে আমাদের সম্পর্কে কিছু বলে। এটি দেখায় যে আমরা লজ্জিত বা বিব্রত, আমরা সচেতন, যে কিছু ভুল হয়েছে। এটা দেখায় যে আমরা এই জন্য দুঃখিত. এটি দেখায় যে আমরা জিনিসগুলি সঠিকভাবে করতে চাই।
ব্লাশ এর পরিণতি সম্পর্কে সচেতনতা প্রদর্শন করা এবং বিনয় দেখানো, যা বোঝায় যে আপনি অহংকারী এবং নির্লজ্জ নন। ব্লাশিং একটি বিশেষভাবে কার্যকর সংকেত কারণ এটি অনিচ্ছাকৃত ও নিশ্চতভাবে অনিয়ন্ত্রিত।
পৃথিবীর তাবৎ তুখোড় সব অভনয় শিল্পীরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে পারেন, হাপুস নয়নে ক্রন্দন করে দু’গণ্ড ভিজিয়ে ফেলতে পারেন- চেষ্টা করে তারা শরির ও মুখের যে কোন অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে পারলেও ব্লাশ করতে অপারগ! সেজন্য মেকাপ আর্টিস্টের সুক্ষ তুলির আচড়ে সেই অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন।
শুধু মাত্র মনস্তাত্ত্বিক কারণেই একজন ব্যক্তির মুখ লাল হয়ে যায়।এটি সাধারণত অনৈচ্ছিক এবং আবেগ, বিব্রত, লজ্জা, ভয়, রাগ বা রোমান্টিক উত্তেজনার সাথে সম্পর্কিত মানসিক চাপের কারণে ঘটে।
তবে লালচে ভাব যদি অস্বাভাবিক সময়ের জন্য ব্লাশ করার পর থেকে থাকে, তাহলে এটাকে ‘রোসেসিয়া’র (রোসেসিয়া একটি দীর্ঘস্থায়ী ত্বকের অবস্থা যা সাধারণত মুখকে প্রভাবিত করে।এর ফলে লালচেভাব, ফুসকুড়ি, ফোলাভাব এবং ছোট এবং উপরিভাগের রক্তনালীগুলির প্রসারণ ঘটে। নাক, গাল, কপাল এবং চিবুক প্রায়ই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। রাইনোফাইমা নামে পরিচিত একটি গুরুতর অবস্থায় একটি লাল বর্ধিত নাক দেখা যায়। যারা মনে করেন বিজ্ঞান প্রায় সবকিছু জেনে বসে আছে তারা জেনে রাখুন; মানুষের অনেক অনুভূতি আবেগের মত রোসেসিয়ার কারণও অজানা।) প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে আবার ‘ইডিওপ্যাথিক ক্র্যানিওফেসিয়াল এরিথেমা’(ইডিওপ্যাথিক ক্র্যানিওফেসিয়াল এরিথেমা হল একটি ব্যাধি যা মুখের অনিয়ন্ত্রিত এবং প্রায়শই অনাকাঙ্ক্ষিত লাল হয়ে যায়।)

ব্লাশিং যেকোন সময় ঘটতে পারে এবং প্রায়শই বন্ধুদের সাথে রোমান্টিক বা অশ্লীল বিষয় নিয়ে কথা বলা, দোকানে অপ্রচলিত বা গোপনীয়তার সাথে জড়িত পণ্যগুলো ক্রয় করা (যেমন আন্ডার গার্মেন্টস, পিল, কন্ডোম, ন্যাপকিন), দিকনির্দেশের জন্য জিজ্ঞাসা করা বা এমনকি অন্য ব্যক্তির সাথে শুধুমাত্র চোখের যোগাযোগ করার মতো জাগতিক ঘটনাগুলির দ্বারাও এটি ট্রিগার হয়। বহু বছর ধরে, এই অবস্থার কারণ একটি মানসিক ব্যাধি দ্বারা সৃষ্ট উদ্বেগ বলে মনে করা হয়েছিল। যাইহোক, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, এই ব্যাধির ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে এটি সহানুভূতিশীল স্নায়ুতন্ত্রের অতিরিক্ত সক্রিয়তার কারণে ঘটে, একটি স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়া যা আক্রান্তরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।) হল এমন একটি অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি সামান্য বা কোনো প্ররোচনা ছাড়াই তীব্রভাবে লাল হয়ে যায়। প্রায় যেকোনো পরিস্থিতি তীব্র লালভাব সৃষ্টি করতে পারে এবং লালভাব অদৃশ্য হওয়ার আগে এক থেকে দুই মিনিট সময় লাগতে পারে।
কিছু লোক মানসিক চাপের প্রতি খুব সংবেদনশীল। বিব্রত হওয়ার মতো বিরক্তির উপস্থিতিতে, মানুষের সহানুভূতিশীল স্নায়ুতন্ত্রের কারণে রক্তনালীগুলি প্রশস্ত হয়ে যায়, ত্বকে রক্তে প্লাবিত হয় এবং মুখের লালভাব সৃষ্টি করে। কিছু লোকের কান, ঘাড় এবং বুকের উপরের অংশে লালভাব থাকতে পারে। লাল হওয়া ছাড়াও, ব্লাশিং কখনও কখনও প্রভাবিত এলাকায় তাপ সংবেদন হতে পারে।
যেমন; অনেকের কান লাল ও গরম হয়ে যায়- এমনি কপোল বা গণ্ডস্থলেরও তাপ বেড়ে যেতে পারে

~ ব্লাশিং এর এই ছবিটা আমার কাছে অকৃত্রিম মনে হয়েছে। যে কারনে সম্ভবত উইকিতেও একমাত্র এই ছবিটা ব্যবহার করা হয়েছে!

পনি জানেন কি?পৃথিবীতে মানুষের ভিন্ন অভিব্যক্তির যতগুলো ফটোগ্রাফ আছে তার মধ্যে ব্লাশিং ফটোগ্রাফি উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এটা খুবই জটিল ও কঠিন কাজ সঠিক মুহুর্তে ক্লিক করা- যেখানে ব্লাশিং করা ব্যাক্তি তার অভিব্যক্তিতে আড়াল করার জন্য অতিদ্রুত মুখ লুকিয়ে ফেলেন।
এ বিষয়ে চাইলে গুগল করে দেখতে পারেন। ছবিগুলোর বেশীরভাগই কৃত্রিম!
অন্যপ্রাণীদের কি ব্লাশিং হয়? হয়তো হয় কিন্তু পশমে মুখ ঢেকে থাকার জন্য সেই অভিব্যক্তি আমাদের নজরে আসে না। তবে প্রাণি বিজ্ঞানীরা বলছেন পৃথিবীতে সম্ভবত; লজ্জা, আবেগ বা বিব্রতবোধের কারনে একমাত্র মানুষেরই ব্লাশিং হয়। কেননা ব্লাশিং একটা সিগন্যাল, এটাও এই বুদ্ধিমান প্রজাতির বিশেষ এক অভিব্যক্তি যা তার স্বজাতিদের সেটা উপলব্ধি করতে বাধ্য করে।
ধরে নিন আপনি ঝাল খেয়ে বেশ বিপদে পড়েছেন; আপনার চোখমুখ লাল দেখেই অন্য কেউ এক লহমায় বুঝে ফেলবে ঝালে আপনি বেজায় কাহিল।



যারা সহজে ব্লাশ করে তারা বেশি নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হয়।
• গবেষণায় দেখা গেছে যে তারা বেশি সহানুভূতিশীল এবং উদার।
• তারা এক বিবাহের উচ্চ হারেরও রিপোর্ট আছে( অতএব সামান্য লজ্জা শরম বা বিব্রতকর অবস্থায় যাদের মুখমন্ডলে রক্তম আভা ছড়িয়ে পড়ে এমন পাত্র-পাত্রী খুঁজুন।)
ব্লাশিং একটি বিশ্রী পরিস্থিতিকে অনেক বেশী খারাপ করে তুলতে পারে, বিশেষ করে যখন কেউ আপনার মুখটি কতটা লাল হয়েছে সেইটে নিয়ে সবার সম্মুখে তামাশা করে।(ইঙ্গিত: সেই ব্যক্তি হবেন না।)
অনেক গবেষনা করে দেখা গেছে যে সহজে বিব্রত হওয়ার কিছু বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সুবিধা রয়েছে এবং এতে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই।

আপনি সেরা রোমান্টিক সঙ্গী
মনে হচ্ছে জ্বলন্ত লাল গাল আসলে কিছু লোকের কাছে বিশেষ আবেদন সৃষ্টি করে। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে-এর গবেষকরা বলেছেন যে, পুরুষ এবং মহিলারা যারা ব্লাশ করেন তাদের উচ্চ স্তরের একগামিতা’র রেকর্ড আছে।
আপনি আরো উদার
‘জার্নাল অফ পার্সোনালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকোলজি’র একটি প্রবন্ধ অনুসারে, "অধিক বিব্রতকর মানুষ...তাদের কম বিব্রতকর প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি উদার আচরণ করে"।
সম্ভবত আপনি আরো নির্ভরযোগ্য
২০১১ সালের একটি সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী কিছু ক্লাসিক বন্দীদের দ্বিধাদ্বন্দ্বের জন্য বিশেষ কম্পিউটার প্রোগ্রামিং পরিক্ষার মুখোমুখি করা হয়েছিল: আপনি যদি আপনার প্রতিপক্ষকে নিন্দা করেন, আপনি মুক্ত হবেন, যদি আপনি একে অপরের নিন্দা না করেন তবে আপনারা উভয়েই দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং যদি উভয়েই চুপ থাকেন, তাহলে আপনি উভয়ই পাবেন এক বছর। একে অপরের নিন্দা করার সময়ে যাদের বেশী ব্লাশিং হয়েছিল বেশ লজ্জার সাথে প্রতিপক্ষের নমনীয়ভাবে নিন্দা করে। আর যাদের ব্লাশিং হয়নি তারা বেশ আক্রমনাত্মক ছিল।
আপনি সংবেদনশীল
আপনি লজ্জা পান কারণ আপনি জানেন যে অন্যরা য়াপনার সন্মন্ধে কি ধারনা পোষন করে। এর মানে হল যে, আপনার প্রতি অন্য লোকেরা বেশি আকৃষ্ট হয়, তাই আপনি সাধারণত তাদের সাথে বাজে আচরণ করেন না।
আন্ডারস্ট্যান্ডিং ব্লাশ অ্যান্ড ব্লাশিং অ্যান্ড সোশ্যাল ইমোশনস-এর লেখক ডঃ রে ক্রোজিয়ার বলেছেন "বিব্রত হওয়ার একটি পূর্বশর্ত হল অন্যরা যা অনুভব করছে তা অনুভব করার ক্ষমতা – আপনাকে যে কোন সামাজিক পরিস্থিতিতে সহানুভূতিশীল, যুক্তিসঙ্গত হতে হবে"৷
বিবিসি খবর; ব্লাশ করলে অন্য লোকদের দ্বারা আপনার ভুলগুলি ক্ষমা করার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
কর্মজীবনের ভুল
ব্লাশিং একটি অ-মৌখিক ( ইশারা বা ইঙ্গিতমূলক) ক্ষমা হিসাবে কাজ করতে পারে যা সামাজিক নিয়মগুলিকে বলবৎ করে, এটি এমন একটি চিহ্ন যা আপনি আপনার ভুল স্বীকার করেন।
গ্রোনিংজেন এবং মাস্ট্রিচ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা একমত পোষন করেছেন যে, কারও উপর কফি ছিটানো বা লিফটে ফার্টিংয়ের মতো বিষয়গুলো - সহজেই ক্ষমা করা যায় যদি বিব্রতকর কর্মের সাথে যুক্ত মানুষের কপোল দুটি ব্লাশ করে লালচে রূপ ধারন করে।
সাধারণত ব্লাশিং কোন বিষয়ে বা কোন দিকে ফোকাস করে এবং কেন মানুষ ব্লাশ করে বিজ্ঞান তা ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ।

মনস্তাত্ত্বিক পন্থা
মনোবিশ্লেষকরাও ব্লাশিং এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা বেশিরভাগ সিগমুন্ড ফ্রয়েডের চিন্তার উপর ভিত্তি করে। তাই বরাবরই অচেতন মন ছিল মুল প্লেমেকার।
মনস্তাত্ত্বিক পন্থাগুলি লাল হওয়ার কারণগুলির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে, তবে এটিও ব্যাখ্যা করতে পারে না যে, কিছু মানুষ ইতিবাচক সামাজিক মনোযোগ পেলে কেন লাল হয়ে যায়।
অনেক মনোবিশ্লেষক ধারনা পোষন করেন যে ব্লাশিং অবদমিত প্রদর্শনীবাদের ফলাফল। প্রদর্শনীবাদ বলতে বোঝায় একজন ব্যক্তির অবচেতন আকাঙ্ক্ষাকে অন্য কারো সামনে নিজেকে উজ্জীবিত করার চেষ্টার ফলে যখন এটি সামাজিক নিয়মের কারণে নিপীড়িত হয়, কেউ কেউ তখন লজ্জায় বা বিব্রতবোধে লাল হয়ে যায়। মুখের দিকে ছুটে আসা রক্ত যৌনাঙ্গ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়।
এই মনস্তাত্ত্বিক দাবীটির কোন বৈজ্ঞানিক সমর্থন নেই এবং এটি ব্লাশিং এর অনেক ক্ষেত্রে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে, তারা বেশিরভাগই ব্লাশিং-এর প্রক্রিয়ার পরিবর্তে কারণগুলিতে মনোনিবেশ করেছিলেন।

থেরাপিউটিক দৃষ্টিকোণ
টমাস হেনরি বার্গেস তার বই দ্য ফিজিওলজি বা মেকানিজম অফ ব্লাশিং-এ ব্লাশিংয়ের জন্য একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এটি ১৮৩৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, এবং বার্গেস এতে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে ব্লাশিং হল অন্য লোকেদের দেখানোর একটি উপায় যে আমরা বুঝতে পারি যে আমরা একটি সামাজিক বা নৈতিক নিয়ম বা নিয়ম লঙ্ঘন করেছি।
যদি একজন ব্যক্তি একটি সামাজিক নিয়ম লঙ্ঘন করে ধরা পড়ে এবং ব্লাশ না করে তবে এটি দুটি সম্ভাব্য জিনিসগুলির মধ্যে একটি দেখায়: হয় সে বুঝতে পারে না যে সে আদর্শ লঙ্ঘন করেছে, অথবা সে সামাজিক নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয়ে চিন্তা করে না।
সামাজিক নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য অনুশোচনা না করা গ্রুপের অন্যান্য সদস্যদের জন্য একটি খারাপ লক্ষণ। যে ব্যক্তি নিয়ম ভঙ্গ করে লজ্জা পায় না সে বিশ্বাসযোগ্য নয়। অন্যদিকে, যে ব্যক্তি লালিত হয় এবং প্রমাণ করে যে সে কতটা দুঃখিত সে গ্রুপের একজন ভাল সদস্য হতে পারে। লোকেরা ব্লাশের উপর এত বেশি নির্ভর করার কারণ হল এটি ইচ্ছাকৃতভাবে করা যায় না।
স্পষ্টতই, যদি লোকেরা একটি সামাজিক নিয়ম লঙ্ঘন করার পরে আপনাকে ব্লাশ দেখতে পায়, তবে তারা আপনার সাথে আরও বিনয়ী আচরণ করবে। অন্য কথায়, ব্লাশিং হল আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থনা। বেশ কয়েকটি গবেষণায়, অংশগ্রহণকারীরা অন্যান্য লোকেদের অবাঞ্ছিত/ অপ্রত্যাশিতীত ব্যাপারগুলি করার একটি ভিডিও সিরিজ দেখেছিল এবং ভিডিও দেখার সময়ে অনেকেই চরম বিব্রতবোধ করছিল ও বার বার লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে যাচ্ছিল ও নিজেকে আড়াল করার জন্য মুখ ঢেকে ফেলছিল।
গবেষকেরা অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যারা খুব বেশী বিব্রতবোধ করেননি তাদের তুলনায় যারা বেশ বিব্রত হয়েছিল তাদেরকে বেশি ইতিবাচকভাবে রেট দিয়েছেন। অতএব, আপনি যদি সামাজিকভাবে ভুল কিছু করেন ও ব্লাশ করেন তবে তা লুকাবেন না। লোকেরা আরও ক্ষমাশীল হয় যখন তারা দেখে যে একজন ব্যক্তি লজ্জা পাচ্ছে এবং সে যা করেছে তার জন্য আন্তরিকভাবে অনুশোচনা করছে।
যাইহোক, যখন মানুষ খুশি হয় বা ইতিবাচক মনোযোগ পায় তখন সেই দৃষ্টিভঙ্গির ফল স্বরূপ লজ্জাবোধের ফলে ব্লাশিং-এর কোন ব্যাখ্যা দাড় করানো যায় না।
কেন কুসংস্কার এবং দ্বন্দ্ব এত সাধারণ সে সম্পর্কে আরও জানুন।
অবাঞ্ছিত জনসাধারণের মনোযোগ
কেউ লাল হয়ে গেলে আপনি কী করবেন? তুমি দূরে তাকিয়ে আছো। কেউ ব্লাশ করার সবচেয়ে সাধারণ এবং স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হল তাদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া বন্ধ করা। যে ব্যক্তির ব্লাশ করছে সে আর অন্যদের সাথে চোখের যোগাযোগ বজায় রাখতে পারে না, তবে তার আশেপাশের লোকেরাও যে ব্যক্তি ব্লাশ করছে তার দিকে তাকাতে অস্বস্তি বোধ করবে।
সম্ভবত ব্লাশও একটি সংকেত যে ব্লাশ আর জনসাধারণের মনোযোগ চায় না। এর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হল ব্যক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী আচরণ করা এবং মনোযোগ বিমুখ করা।
****
আগের লিঙ্কগুলোঃ
মানুষ কেন অনন্য? পর্ব~১
মানুষ কেন অনন্য? পর্ব~২
মানুষ কেন অনন্য? পর্ব~৩
____________________

লেখা সুত্রঃ
Scientific Explanations for Blushing (wondriumdaily.com)
Why Blushing Is Nothing to Be Ashamed of (insider.com)
Blushing - Wikipedia
Pale Skin: Common Causes (verywellhealth.com)
হুমায়ুন আহমেদ
(ছবি: ভাসান টিটা/শাটারস্টক)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০২৩ সকাল ১১:৩৫
১৬টি মন্তব্য ১৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×