লেখক হওয়ার খানিকটা জ্বালা আছে! দুরের মানুষেরা অনেক কাছে চলে আসে আর কাছের মানুষেরা দূরে চলে যায়। ধর তুমি একখানা কবিতা লিখলে, ছড়া প্রবন্ধ কিংবা গল্প- সৃজনশীল সৃষ্টিতে সব স্রষ্টা’র-ই আমোদ হয়। ভাল সৃষ্টিতে তোমার খানিকটা গরব হবে বৈকি! কিন্তু তোমার কাছের মানুষেরা মুখ বাঁকাবে-তারা তোমার সৃষ্টির সাথে তোমাকে মেলাবে। বলবে উঁহু লোকটা-তো এমন নয়,এই লেখার সাথে ওর চরিত্র মিল খায় না। কি আশ্চর্য ! আমার লেখার সাথে মানুষ আমার মিল থাকতে হবে কেন? লেখাতে আমাতে যদি মিলেই যায় তাহলে আর কিসের সৃষ্টি?
আর দুরের মানুষেরা লেখার সাথে লেখককে মেলায়। তারা ভাবে যিনি লিখেছেন তিনি মনে হয় এমন-ই মানুষটা।
আমরা আমদের স্রস্টাকে দেখিনি সেটা মনে হয় ভালই হয়েছে। এখন তার সৃষ্টির সাথে তাকে মেলাই-তাকে দেখলে হয়তো তার সাথে তার সৃষ্টিকে মেলাতাম! ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে হত!!
***
সিডান কারের পিছনে বসে আছি আমরা তিনজন! মাঝখানে যেই বয়স্ক পুরুষটি বসে আছেন তার চোখে ভারি চশমা সেটা শ্যামলা মানুষটির খাড়া নাকের উপর অতি আলতো করে ঝুলে আছে; মনে হচ্ছে গাড়ির হালকা ঝাঁকুনিতেই সেটা টুপ করে খসে পড়বে। চশমার ফাঁক দিয়ে নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন সামনের মাইক্রো বাসটার দিকে। চোখের নেত্রে স্পষ্ট জলের আভাস। কি ভয়ঙ্কর ভাঙচুর চলছে তার সর্বান্তকরণ জুড়ে সেটা আমাদের টের পাবার কথা নয়। তবে অনুভব করছি? না সেটাই বা করি কেমনে? এই মুহূর্তে তার মনের ভাব বোঝা অসম্ভব!
আমার পাশে যে বয়স্ক পুরুষটি বসে আছেন তার মিহি কুঞ্চিত গণ্ড বেয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। তিনি এই আধ অন্ধকারে অতি সন্তর্পণে সেটা মুছে ফেললেন। পুরুষ বলেই হয়তোবা নিজের স্ত্রী বিয়োগে তার চিৎকার করে কান্নার অধিকার নেই। তার শেষ ইচ্ছে ছিল হয়তোবা সহধর্মিণীর অন্তিম যাত্রায় তার শিয়রে বসে হিমশীতল কপালে হাত রেখে অঝোরে কাঁদবেন। বলবেন সেই কথা গুলো তিন যুগের এই দাম্পত্য জীবনে বলা হয়নি কখনো! ভীরু ও দুর্বল এই মানুষটি সব ভার সঁপে দিয়েছিল যাকে তিনি অতি নিষ্ঠুরের মত একাকী চলে যাচ্ছেন। তার অসহায়ত্বো, কষ্টবোধ,মানসিক দৈন্যতার কথা যাকে বলে তিনি নির্ভার হতেন। যে মানুষটা তার মধ্য যৌবন থেকে পৌঢ়ত্য ছুঁয়ে বার্ধক্যের প্রারম্ভিক লগ্ন পর্যন্ত পায়ে পায়ে পথ চলেছে, তার ভীরুতা ও দুর্বলতাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে সামনে এগিয়ে যাবার সাহস যুগিয়েছে। সেই মানুষটা আজ একাকী-ই চলে যাচ্ছেন...
***
ছোটকা মানে আমার ছোট কাকাকে নিয়ে এ গল্প! তিনি আমার মায়ের থেকে বছর দুয়েকের ছোট ছিলেন। জন্মের আগের তাঁর বাবা মানে আমার দাদা মারা যান। বরাবরই ভীরু দুর্বল ভীতু মা ন্যাওটা আমুদে ও অতি অল্পতে সুখী ব্যাতিক্রমী ফোবিয়া আক্রান্ত একজন মানুষ ছিলেন। গ্রামে ভাল স্কুল না থাকায় কিশোর বয়সেই আমার দাদী তাঁর বড় ভাই মানে আমার বাবার কাছে তাঁকে পাঠিয়ে দেন। তিনি কোনভাবেই তাঁর সেই গ্রাম আর মা-কে ছাড়তে চাননি। সারাজীবন কেদেছেন তাঁর মা আর গ্রামের জন্য। তাঁর একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার মা তাঁকে সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হবার জন্য অনুপ্রেরণা ও সাহস যুগিয়েছেন। মাত্র বছর দু'য়েকের বড় ভাবীর অনুশাসনে তিনি নিতান্তই বাধ্য হয়েছিলেন পরিবারের ব্যাবসার বাইরে অধ্যাপনায় যুক্ত হতে।
তাঁর ভীরুতা, দুর্বলতা ও ফোবিয়ার ছোট্ট একটু উদাহরণ দেই;
কোন একবার পত্রিকায় দেখলেন ঘুর্নয়মান ফ্যান আচমকা খসে পড়ে কোন এক ব্যাক্তি নিহত হয়েছেন।
আর যায় কোথায় তাল পাকা গরমেও তিনি আর ফ্যান চালাবেন না। পাশে ঘুমিয়ে থাকা আচমকা বেড়াতে আসা অন্য কোন কুটুম যদি বাধ্য করত ফ্যান চালাতে তবে তিনি সারারাত না ঘুমিয়ে এক দৃষ্টিতে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।
এমনি ইলেক্ট্রিক সুইচে কে শক খেয়ে মারা গেছে- এ খবর শুনে পরদিনই তিনি মিস্ত্রি ডেকে বাড়ির সব সুইচ সবার নাগালের বারে লাগিয়ে দিলেন। তখন থেকে চেয়ার বা টুলে দাঁড়িয়ে সবাইকে লাইট ফ্যান জ্বালাতে হয়। তাতেও তাঁর শান্তি নেই- ফের মিস্ত্রি ডেকে বাসার বিদ্যুৎ লাইনটাই কেটে দিয়ে সন্ধ্যের পরে হারিকেন জ্বালিয়ে ভুতের মত বসে থাকেন।
আমাদের আট ভাই বোনের বিশাল পরিবার দু-তিন বছর বয়সেই আমরা মায়ের উষ্ণ সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছি। যে কারনে মায়ের সাথে তেমন করে হৃদ্যতা জমেনি। সেই থেকেই আমার ঠাই হয়েছে কাকার বিছানায়। কৈশরের প্রথম পর্যন্ত তাঁর সান্নিধ্যেই কেটেছে। ভীষণ ভুতের ভয়ে ভীত আমাকে আরেকজন ভিতু মানুষ রাতের পর রাত সাহস জুগিয়েছে-ব্যাপরটা বড় অদ্ভুত!
এই মানুষটাকে নিয়ে বেশ বড় ক্যানভাসে লেখার ইচ্ছে ছিল আমার। লিখব হয়তো কিংবা লিখব না, কে জানে...
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুন, ২০২৩ রাত ৮:২৯