ওহ্ আরো দুটো আনাজের কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম; একটা হচ্ছে গাবলু গুবলু রশুন আর 'সালাদকাইয়া প্যারিস! সালাদকাইয়া প্যারিসের বাংলা করলে হয় মিষ্টি মরিচ।আমরা যেটাকে ক্যাপসিকাম হিসেবে চিনি জানি। নব্বুইয়ের দশকে অমন গাবলু রশুন, ভোদকা পেয়াজ আর ক্যাপসিকাম আমাদের একেবারেই অচেনা ছিল। রাশিয়ায় ক্যাপসিকামের বরাবরই ব্যাপক কদর। টম্যাটো শশা আর গাজরের পরেই ক্যাপসিকাম আর তার সাথে রশুন। ওরা আলুর মত রশুন ভক্ত জাতি! প্রায় সব রান্নায় আমরা যেমন কাঁচা মরিচ ঠেসে দেই তেমনি ওরা দেয় রশুন! ( ওদের রশুন খাওয়া নিয়ে গল্প হবে একদিন 'খেয়েছিলুম বটে'র কোন এক পর্বে)
***
বাজারে চাল ডাল কিছু খুঁজে পাই নি। অগত্যা 'বাতন' বা সাদা পাউরুটিই বিকল্প! রান্নার উপকরন যা পেয়েছি তা দিয়েই হয়তো চালিয়ে দেয়া যাবে কিন্তু হাড়ি-পাতিল পাই কই? হস্টেলের ছেলে মেয়ে সব ক্যান্টিনে খায়। রান্না ঘরে কালে-ভদ্রে! মুলত যারা 'লিভ টু গেদার' করে তারাই একটু আলু, সসেজ কাটলেট ভেজে খায় কিংবা স্যুপ করে বড়জোর। ছোট্ট ফ্রাই প্যান ছাড়া ওদের কাছে আর কিছুই নেই। আমাদের বুড়ি আখরান মহিলার (গার্ড) বিশাল বপুর মত তার মায়াবতি মন।
ছেলেগুলোর মন খারাপ দেখে তিনি তার পাহাড়া শিকেয় তুলে ছুটলেন তার বাড়িতে। আধাঘন্টা পরে নিয়ে হাজির হলেন ইয়া বড় দু খানা সনপ্যান আর বড় হাতাওয়ালা চামচ। পুরো হোস্টেল যেন তাই দেখে নেচে উঠল!
চলছে রান্নার যোগাড় যন্ত! চারিদিকে রুশ ছেলেমেয়ে কিলবিল করছে। হস্টেলে এমন হুলস্থুল রান্নার দৃশ্য তাদের বাপ দাদার জন্মে কেউ দেখেনি! ওদের কাছ থেকে চপার বোর্ড ছুড়ি, পিলে'র ধার নিয়ে হাত পা ছিলে কেটে আমরা কাটা ছেড়া করছি।
একমাত্র আনাড়ি শেফ আর তার চ্যলা চামুন্ডা। আমি ভীষন গম্ভীর মুখে সবাইকে আদেশ নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি। পিয়াজ কি জুলিয়ান না কিউব হবে, আলুর সাইজ কেমন হবে, মুরগীর চামড়া ছিলে কাটবে নাকি চামড়া সহ কাটবে এই নিয়ে বেশ তর্কাতর্কি থেকে মান অভিমান হয়ে গেল! দুয়েকজন রাগ করে রান্নাঘর ছেড়ে দুরে গিয়ে গ্যাট হয়ে অভিমানে মুখ ফুলিয়ে বসে রইল।
এতবড় মুরগী কাটতে গিয়ে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা! আমারও সব এলেমদারি শেষ! অবশেষে রুশীয় এক মেয়ে এসে উদ্ধার না করলে আস্ত মুরগীই রাধতে হোত।
আমাদের অর্ধেক ছেলেরা এদেশে আসবার আগে মাখন নামক বস্তুটা শুধু দলা পাকিয়ে ঘোল দিয়ে চেখে দেখেছি। সেটা দিয়ে রান্না কি প্রকারে হয় তার তরিকা জানব কি ভাবে? যা করা আল্লা খোদা ভগবান হাশেম কিংবা ঈশ্বর (কয়েক ধর্মের লোক ছিল সেখানে); চুলায় প্যান চাপিয়ে মায়ের কথা স্মরণ করে একসাথে দু'কেজি মাখন ঢেলে পিয়াজ ক্যাপসিকাম আর গোল মরিচ দিয়ে বেশ খানিক্ষন কষাতেই বেশ একটা সুগন্ধ ছুটল চারিদিকে! অবস্থা গুরুতর তখন- হস্টেলের ওদেশি বোর্ডারদের ভীড় ঠেকাতে তখন মনে হচ্ছিল লাঠি চার্জ করতে হবে। আমাদের নিকটজন রুশীয় ছাত্ররাতো গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে যেন পাতিলে সেঁধিয়ে যেতে চাচ্ছিল।
প্রিয় বন্ধু শাশা দেখি আমার বগলের নিচ দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে রাজহাসের মত গলা বাড়িয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে সুঘ্রান নিয়ে তাড়াতাড়ি পেট ভরছে! কি এক জ্বালা!! এখান থেকে এক চামচ করে সুরুয়া সবাইকে চাখতে দিলে এই চারখানা মুরগীর ঝোলে অর্ধেক হোস্টেল ম্যানেজ করতে পারব না।
তবে আমি তখন নিজের রান্নার কারিশমাতে নিজে বিমোহিত! প্রথমবারেই বাজিমাত। আমাদের ছেলেরাও সবাই সুঘ্রানে মাতোয়ারা- তাদের সবার চেহারায় স্পস্ট সম্ভ্রমের ছাপ- দু চারজন পিঠ চাপড়ে দিচ্ছিল! নিজেকে তখন বিশ্বের সেরা শেফের কাতারে ফেলে দিচ্ছিলাম প্রায়! মনে হচ্ছিল এখনকার সবচেয়ে সুন্দরী এক রুশীয় ললনার সাথে দু'পাক ব্যলেরিনা নেচে নিই।
সবশেষে দিলাম মুরগী আর দু'ভাগ করা আলু। রান্নার শেষের দিকে মাখনে ভাজা একটু পেয়াজের বেরেস্তা ছিটিয়ে দিতেই যেন চারিদিকে হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল! রান্নার এমন সুঘ্রান রাশিয়ার জারের রসুইখানাতেও কেউ যেন কখনো পায়নি।
ও দেশী সবার জিভের আগায় লালা জমে টইটম্বুর হয়ে আছে - লোভাতুর চোখে চেয়ে আছে বড় প্যানটার দিকে। আমাদের কিচ্ছু করার নেই- সবাইকে উপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোন গতি নেই। তবুও একটা প্লেটে খানিক মাংস আর ঝোল উঠিয়ে শাশার হাতে দিয়ে বললাম, শাশা তুমি এখান থেকে তোমার বন্ধু বান্ধব নিয়ে চেখে দেখ। ও সেটা হাতে নিতেই যেন হুল্লোড় পড়ে গেল!
খাবারে যেন কারো তর সইছিল না। যার কাছে যা শানকি-থালা-বাটি ছিল তাই নিয়ে বসে পড়েছে। রুটির ভাগ নিয়ে আগেই একটা কাড়াকাড়ি হয়ে গেছে। যেই রুটির সবাই এদ্দিন ঘেন্না ভরে তাকাত - তার বেশ কদর আজকে।
যেহেতু শেফ আমি -তাই পরিবেশনের গুরু দায়িত্বটাও ছিল আমার হাতে। আমাদের সবার সিনিয়র রফিক ভাই- আমার সাথে তার ব্যক্তিগত খাতিরটাও বেশ প্রগাঢ়! মাঝে মধ্যেই আমার কাছে গিয়ে শুয়ে বসে গল্প করেন। অবশ্য আমাদের বেশীরভাগ গল্প জুড়ে থাকে খাবার কথা- তিনি এসেই কখনো বলেন;
তপন তোমার মা ওই 'কাঠালের বিচি আর ডাটা দিয়ে যেই তোলা শিকেয় করা নোনা ইলিশের চচ্চরিটা করত সেইটার রেসিপিটা কও তো?
কিংবা শোল মাছের দোসসা কোনদিন খাই নাই- দেশে গেলে আমারে খাওয়াইবা? ফের কও তো কেমনে রাঁধে?
আমি বলতাম; এটা শুধু শীত কালে হয়। শীতের শোল সবচেয়ে মজার। প্রথমে শোল মাছ ছোট ছোট করে কেটে ধুয়ে
বেশী করে লবন আর একটু হলুদ মেখে বাঁশের চালনে করে সারা রাত ছড়িয়ে রাখতে হয়। পরদিন মাছগুলো বেশ শক্ত হবে আর একটা শুটকি শুটকি ঘ্রান আসবে। সে মাছ গোল করে কাটা পেয়াজ, বেশী করে রশুন আর কাচা মরিচ দিয়ে বাটা মশলা সহ আচ্ছা মত কষিয়ে
ধনে পাতা মটরশুটি আর টক টম্যাটো দিয়ে রান্না করে গরম আউশ চালের ভাত দিয়ে খাইতে ভাইরে...
সে মাঝ পথেই থামিয়ে দিয়েই বলত, থাক থাক আর কইও না- আমার মনে হচ্ছে এক্ষুনি প্লেনের টিকিট কাইট্যা দেশে চইল্যা যাই।
কি শালার আজব দেশে আসলাম কও। কোন শালায় ঝাল খায় না। কাচা মরিচ ছাড়া একটা দেশের লোক বাঁচে কেমনে?
আমি ডিসিসান নিলাম, সিনিয়র আর আমার ঘনিষ্টজন হিসেবে রফিক ভাইরে সবার আগে দিব। তিনি প্রথম খাবার মুখে দিয়ে বউনি করবেন।
তার পাতে বেছে বেছে সবচেয়ে বড় মাংসের টুকরোটা দিলাম। তিনি আমার এমন শ্রদ্ধা-ভক্তিতে আবেগার্ত হয়ে পড়লেন। এক এক করে সবাইকে মাংস ঝোল দিয়ে শেষে নিজের পাতে বেড়ে নিয়ে আসন পেতে বসে তাকিয়ে আছি রফিক ভাইয়ের দিকে। শুধু আমি নই সবাই-ই তাকিয়ে আছে তার দিকে তার এক্সপ্রেশান দেখার জন্য। রফিক ভাই মাংসের টুকরোটা পরম মমতায় হাতে নিয়ে বড় একটা কামড় বসিয়ে গিলতে গিয়েও গিললেন না। মুখ বন্ধ করেই আমার দিকে তাকালেন। দেখি তার দু'চোখ জলে টলমল করছে।
তার এই আবেগ দেখে আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আহারে বেচারার মনে হয় মাংসের টুকরোয় কামড় দিয়ে মমতাময়ী মায়ের কথা মনে পড়ে গেছে। আমি নিজের জায়গায় যেন তার মাকে-ই কল্পনা করছি তখন।
আমার মনের মধ্যে সুর উথলে উঠল ' কতদিন দেখি না মায়ের মুখ -শুনিনা সেই কালা পাখির গান, হায়রে পরান-হায়রে পরান!'
কয়েক সেকেন্ড বাদে রফিক ভাই মুখগহ্বরে রাখা মাংসের টুকরোটা অতিকষ্টে পাকস্থলীতে চালান করে ফ্যাসফেসে বিকৃত কন্ঠে বললেন,~তপন তুমি কি বাল রান্না করছ- এ মানুষে খায়?
সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশের যারা হাতে করে মাংস নিয়ে যারা খেতে যাচ্ছিল বা খাব খাব করছিল তারা সাটা সাট করে প্লেটে মাংসগুলো যেন তেলাপোকা ছোড়ার মত করে ছুড়ে ফেলল!!!
আমার চোখের কোলে যে জলটুকু অতি আবেগে নিস্ক্রান্ত হবে বলে ঢলঢল করছিল সেটুকু সুরুৎ করে উল্টো পথে দৌড়ে পালাল।
***
সিন আভি বাকি হ্যায় মেরা দোস্তঃ
এর পর থেকে আর কোন রান্নায় শেফ হিসেবে তো দুরের কথা আমাকে কেউ হেল্পার হিসেবেও সুযোগ দেয়নি বহুদিন। এমনকি পেয়াজ কাটতে গেলেও রে রে করেছে। আমার মায়ের একমাত্র স্মৃতি এক বয়াম আচার নিয়ে গিয়েছিলাম- যেটা যক্ষের ধনের মত আগলে রেখে মুখের স্বাদ একেবারে মজে গেলে গভীর রাতে চুপি চুপি তার থেকে দুয়েক খন্ড মুখে দিয়ে মার কথা স্মরণ করে চোখের জল ফেলে স্বাদ ফিয়ে আনতাম। সে বয়াম ধরে একদিন হাপিস হয়ে গেল! আমার খানা-খাদ্যের গল্পের আখড়ার সভ্য কমতে কমতে শুন্যের কোঠায় নেমে এল!
শুধু লঙ্কান দিমিত ছিল ব্যতিক্রম। সে-ই একমাত্র মুচকি হেসে কানে কানে বলেছিল, ' আই নো ইউ আরএ গুড শেফ। বাট ইট ওয়াজ এন এক্সিডেন্ট ম্যান!!'
প্রথম পর্বের জন্যঃ খেয়েছিলুম বটে!!
****
এই লেখার জন্য ফের আন্তরিক ধন্যবাদ মিরোর আপুকে; তিনি একমাস তার ফ্রেন্ড লিষ্ট থেকে আমাকে বর্জনের হুমকি দিয়ে; স্মৃতি জাগানিয়া রান্না সমাচার (২) লেখাটা না দিলে পৌনে তিন যুগ আগের এই আমার জীবনের ঘটে যাওয়া 'এই করুণ রস কাহিনী'টা হয়তো মনেই পড়ত না।