ভাবছি এরপরের আলোচনাটা আমরা কোত্থেকে শুরু করব? প্রথম পর্বে যেভাবে আমাদের বিজ্ঞ, ঋদ্ধ ও শ্রদ্ধেয় ব্লগারগন দারুণ প্রানবন্ত আলোচনায় সমালোচনায় জমিয়ে তুলেছিলেন, তাতে করে দ্বিতীয় পর্বটা লেখা বেশ জটিল হয়ে যাচ্ছে।
যাই হোক এই পর্বে আমরা বানান ও ব্যাকারণ কিংবা ভাষার দুর্বলতা থেকে সরে আসি। আমরা আসলে কতটুকু জানি 'ইশারার ভাষা' সন্মন্ধে? 'ইশারার ভাষা' যা সহজ ভাষায় বোবা ও কালা ( আরো সহজ ভাষায় বোবা ও বয়রা) আর কেতাবি ভাষায় শ্রবন ও বাক্ প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্যাবহার হয়।
আপনি কি 'বডি ল্যাংগুয়েজ' বা দেহের ভাষাকে ইশারার ভাষা বলবেন? না মোটেও তা নয়- দেহের ভাষা ভিন্ন বিষয়, সেটা নিয়ে আলোচনায় আসছি। আর অন্ধদের যে ভাষা যাকে আমরা 'ব্রেই্লি' বলি সেটা কিন্তু কোন ভাষা নয় সেটা শুধুমাত্র লিখন পদ্ধতি। কিন্তু আমাদের ভাষার বানান ও ব্যাকারণরীতিতে সেটা জানারও প্রয়োজন আছে বলে ওই বিষয়ে ( যদিও আমার জ্ঞান শুন্যের কোঠায়) আমরা কিছু আলোচনা করব।
আপনি কি বোবা-কালা কোন মানুষকে বাংলা উপন্যাস পড়তে দেখেছেন, কিংবা এমন কেউ কি বাংলা কবিতা লিখেছেন? আমি অন্তত দেখিনি, কিংবা দেখলেও হয়তো বুঝিনি। তবে উন্নত বিশ্বের এমনটা অহরহ হচ্ছে। ইউরোপ আমেরিকায় আপনার চোখে পড়বে হয়তো কোথাও জটলা পাকিয়ে একগুচ্ছ ছেলেমেয়ে নিঃশব্দে শুধু হাত নাড়িয়ে অঙ্গভঙ্গী করে দারুণ আড্ডা দিচ্ছ- আপনি হতভম্ভ হয়ে লক্ষ্য করবেন সেই আড্ডার মজা আমাদের মত শ-শাব্দিক আড্ডার থেকে কোন অংশেই কম নয়।
ইশারার ভাষা বা সাইন ল্যাংগুয়েজ- নিয়ে একটু তাত্ত্বিক আলোচনা সেরে নেই আগে;
আমাদের মধ্যে কিছু কিছু মানুষ রয়ে গেছেন যারা শ্রবণ ও বাক্ সীমাবদ্ধতা নিয়ে জন্মেছেন। তারা আমাদের মতো বাচনিক ভাষায় তাদের মনের ভাব প্রকাশ করেন না। তবে তারা ভাষাহীনও নন। তাদেরও আমাদের আমাদের মতো ভাষা রয়েছে। তারা আমাদের মতো বাচনিক ভাষায় তাদের মনের ভাব প্রকাশ না করে বরং সংকেত ভাষায় যোগাযোগ করে থাকে।
সারা বিশ্বে সংকেত ভাষা বহুল ব্যবহৃত একটি ভাষিক যোগাযোগ মাধ্যম। ন্যাশনাল সেনসাস অব দ্য ডিফ পপুলেশন- এনসিডিপির তথ্য মতে, ইংরেজি ছাড়া আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে যে ১৩টি ভাষা সবচেয়ে বেশি প্রচলিত তার মধ্যে স্প্যানিশ ও চীনা ভাষার পরই রয়েছে আমেরিকান সংকেত ভাষা। যেখানে প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ এই ভাষায় পারস্পরিক ভাব বিনিময় করে থাকেন।
ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ দ্য ডেফ-এর তথ্য মতে, সারা বিশ্বে প্রায় সাত কোটি বাক্ ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী রয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশেই আছে প্রায় ৩০ লাখ। তবে দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত বাক্ ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩৯৭ জন। যার মধ্যে ১ লাখ ১৮ হাজার ৯০৭ জন বাক প্রতিবন্ধী ও ৪৭ হাজার ৪৯০ জন শ্রবণ প্রতিবন্ধী( জন্ম থেকে শ্রবণ প্রতিবন্ধী হলে সে বাক্ প্রতিবন্ধী হবে)। এই বিশাল বাক্ ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য ১৯৯২ সালে ‘জাতীয় বধির সংস্থা’ ব্রিটিশ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের আলোকে এ দেশে সর্বপ্রথম বাংলা ইশারা ভাষা ও বিধান প্রণয়ন ও প্রকাশ করে।
আসুন আমরা দেখে নিই বাংলা প্রণীত সাইন ল্যাংগুয়েজ;
দেখুন ঠিক সেই বর্ণ-গুলোই আছে যা আমরা চাচ্ছিলাম ?
মোট ৩৬ টি বর্ণ। ৬টি স্বর ও ৩০ টি ব্যঞ্জন-বর্ণ। এখানে দুটো নাসাল ধ্বনি নেই, 'স' একটাই, চন্দ্রবিন্দু নেই। ঙ, নেই, ঞ নেই, দীর্ঘ-ঈ নেই, ঐ নেই ঔ নেই। আমরা সহজ সরল বাংলা ভাষা এমনটাই চাচ্ছিলাম। সাইন ল্যাংগুয়েজ বা ইশারার ভাষা যদি এমন আধুনিক হতে পারে তবে মুল স্রোতে যারা আছেন তাদের লেখ্য বাংলা ভাষা এমন হতে দোষ কি?
এবার অন্য প্রসঙ্গ যাদের জন্য বর্ণ তারা আসলে কতটু বোঝে?
তাঁর আগে আসুন এই 'ইশারার ভাষা' সন্মন্ধে ভাষা বিজ্ঞানীরা কি বলে দেখে নিই;
একটি সাধারণ ভুল ধারণা আছে যে, সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ কোনো না কোনোভাবে কথ্য ভাষার উপর নির্ভরশীল: যে এগুলি লক্ষণে প্রকাশ করা একটি কথ্য ভাষা, অথবা সেগুলি মানুষের কথা শুনে উদ্ভাবিত হয়েছে। স্বাক্ষরিত (আমি 'লেখ্য' ভাষা হিসেবে উল্লেখ করব) এবং কথ্য ভাষার মধ্যে মস্তিষ্কে ভাষা প্রক্রিয়াকরণের সাদৃশ্য এই ভুল ধারণাটিকে আরও স্থায়ী করেছে। বধিরদের জন্য স্কুলে শ্রবণকারী শিক্ষক, যেমন চার্লস-মিকেল ডি ল'পে বা 'থমাস হপকিন্স গ্যালাউডেট'কে প্রায়ই ভুলভাবে ইশারা ভাষার "আবিষ্কারক" হিসাবে বর্ণনা করা হয়। পরিবর্তে, সাংকেতিক ভাষাগুলি, সমস্ত প্রাকৃতিক ভাষার মতো, যারা তাদের ব্যবহার করে তাদের দ্বারা বিকশিত হয়, এই ক্ষেত্রে বধির লোকেরা, যাদের একটি কথ্য ভাষার সামান্য বা কোন জ্ঞান থাকতে পারে না ও পারে।
কি বুঝলেন? আপনি কীভাবে একজন বধিরকে বোঝাবেন ‘এ’ ‘ও’ ‘আ’ –এর মত স্বর-বর্ণ বা ক-খ এর মত ব্যঞ্জনবর্ণ। এগুলো শুধু বিমূর্তভাবে ধারনা করতে পারবে সে। বাংলা যুক্তাক্ষর,বর্ণের সাঙ্কেতিক চিহ্ন অদ্ভুত সব ব্যাকারণের মারপ্যাঁচ বোঝা ভাষায় বোঝানো অসাধ্য তাঁর কাছে। আমরা বাংলার মত ভাষায় বধির মানুষের কথ্য ভাষার আলোচনা করতে পারি- কিন্তু স্বভাবিকভাবে লেখা পড়া করবে কীভাবে?
( শুধু এটুকু দেখুন- বাকিগুলো নিয়ে পরে ভাবুন; ওষ্ঠ পঠন (ঠোট পড়া): এই পদ্ধতিতে বক্তার ঠোট এবং মুখাবয়বের নড়াচড়া দেখে বক্তব্য অনুধাবন করতে হয়। এই পদ্ধতির প্রবর্তক হলেন জয়ন পাবলো বুনেট (Juan Pablo Bonet)। যে শিক্ষার্থী ওষ্ঠ পঠন ক্ষমতা ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারে সে যে গতিতে কোন বিষয় মনে মনে পড়তে পারে, প্রায় একই গতিতে সে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় প্রকাশ করতে পারে। কিছু ওষ্ঠবর্ণ আছে যেমন— প, ফ, ব, য ইত্যাদি। বর্ণগুলি সরাসরি ওষ্ঠের উপর নির্ভর করে উচ্চারণ হয়। ফলে এই বর্ণগুলি সে সহজেই আত্মস্থ করতে পারে। আবার ক, খ, গ ইত্যাদি বর্ণমালা উচ্চারণের সময় সরাসরি ওষ্ঠের উপর নির্ভর করে না, সেগুলো বুঝতে পারা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাহলে স, শ, আর ষ এর কি হবে?)
(প্রকৃত অর্থে, বাংলা ইশারা ভাষা প্রমিতকরণে ভাষা বৈজ্ঞানিক ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে এর বৈশিষ্ট্য, গঠনরীতি ও ব্যাকরণ আবিষ্কার করা প্রয়োজন—যা এখনও করা হয়নি। ভাষা পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলা সংকেত ভাষা ব্যবহারবিধি উন্নয়ন, এ ভাষার বিভিন্ন উপাদান সংকলন ও মুদ্রণ এবং সর্বত্র এ ভাষার প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা করাও আবশ্যক। যেহেতু ইশারাভাষীদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে এ ভাষার উদ্ভব, তাই এ বিষয়েও যথেষ্ট গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।~প্রথম আলো। ২০২৪ সালে এসেও গবেষনার প্রয়োজন আছে!!! )
এ বিষয়ে পুরোটা জানতে চাইলে লিঙ্কে ক্লিক করুন;
বাংলা ইশারা ভাষা প্রমিতকরণ কেন জরুরী
আপনি নেট খুঁজে দেখুন ইংরেজী ভাষাভাষীর মত আধুনিক অনেক ভাষার বধির মানুষ কঠিন কঠিন বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রীধারী হচ্ছে- ড্রাইভিং লাইসেন্স পর্যন্ত পাচ্ছে। অথচ আমাদের দেশে দেখুন; ১৬৬০০০ শ্রবণ ও বাক্ প্রতিবন্ধী মানুষের জন্মই যেন আজন্ম পাপ। আপনার জানা মতে এমন কেউ কি এ ভাষায় উচ্চপর্যায়ে যেতে পেরেছে?
শুধু দেখুন জটিল বর্ণ ব্যবস্থা কিভাবে হাজার হাজার মানুষের জীবনকে সাধারণ জীবন-ধারার মুলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে, শুধু এই ভাষাভাষি হয়ে জন্মানোর জন্য এতবড় দায় চুকাতে হচ্ছে তাদের?
( যুক্তাক্ষর দিয়ে একটা বাংলা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের উপন্যাস করতে গেলে সেটা কেমন দেখতে হবে আমার ধারনা নেই, তবে সেটা যে কলেবরে মুল বই এর আট-দশগুন বেশি হবে সেটা আন্দাজ করা যায়।) * বোবা-বধিরদের জন্য আসলে কোন সাইন ল্যাংগুয়েজ উপন্যাস করা সম্ভব নয়। এটা শুধু ধারনা মাত্র, বোবা-বধিরেরা স্বাভাবিকভাবেই প্রথাগত ভাষায় লেখা বই-প্রত্র পড়বে ও লিখবে। সাইন ল্যাংগুয়েজ শুধুমাত্র বর্ণ-ভাষা ও শব্দ শেখার জন্য।
সাইন ল্যাংগুয়েজ কেন সার্বজনীন হল না? সাইন ল্যাংগুয়েজ বা ইশারার ভাষা আধুনিক মানুষের সৃষ্টি- একজন বোবা কালা মানুষের কাছে মাতৃ-ভাষাই কি আর বিজাতীয় ভাষাই বা কি? শব্দ সুর ধ্বনি সেটা যত সু-মধুরই হোক না কেন তার কিছু আসে যায় না।
পৃথিবীর অন্যতম কঠিন ভাষা চৈনিক-সেটা কে না জানে। চায়না শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞানেই প্রভূত উন্নতি সাধন করেনি, সময়মতো জায়গামতো নিজেদেরকে ঠিকঠাক পাল্টে নিয়েছে, তাদের নিজেদের স্বার্থে -ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে জাতীয়তাবাদের গোড়ামীকে ছুড়ে ফেলেছে।
যেহেতু বিশাল দেশ, দেড়শ মিলিয়নের উপরে মানুষের বাস-সেখানে বোবা কালা মানুষ দু-এক কোটি থাকবে সেটা স্বাভাবিক! এত বিশাল জনগোষ্ঠীকে মুল স্রোতে না এনে অথর্ব বানিয়ে রাখবে সেটা হয় কেমনে? যেখানে আমরা 'ডেফ' মানুষের জন্য ইশারায় ভাষা উন্নয়নের জন্য উদ্যোগ নিয়েছি ১৯৯২ সালে( যা মুখ থুবড়ে পড়েছে-জ্ঞানী গুণী পণ্ডিতেরা কেউ আর ভেবে পাচ্ছে না কেমনে সামনে আগাবে?) সেখানে চায়নিজরা প্রথম ইশারা ভাষা স্কুল করে ১৮৮৭ সালে। নিজেদের ভাষায় 'সাইনে' আনা অসম্ভব দেখে তারা প্রথমে ফরাসী(LSF) ও পরবর্তীতে ইংরেজী(ASL) ভাষার সাহায্য নেয়। আবার ইংরেজী এসেছে ফ্রেঞ্ঝ ও স্প্যানিশ থেকে।
দেখুন;
চাইনিজ 'ইশারা ভাষার' দুটি প্রধান উপভাষা রয়েছে: দক্ষিণ সিএসএল (সাংহাই কেন্দ্রিক এবং ফরাসি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ দ্বারা প্রভাবিত) এবং উত্তর সিএসএল (শেফু স্কুল অফ ডেফ থেকে উদ্ভূত এবং আমেরিকান সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ দ্বারা প্রভাবিত) (এএসএল -আমেরিকান সাইন ল্যাংগুয়েজ)
অন্যান্য 'ইশারা ভাষা'র মতো, চীনা 'ইশারা ভাষা'র প্রাথমিকভাবে মুখের অভিব্যক্তির সাথে যুক্ত আকার এবং নড়াচড়ার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। CSL-এর একটি বর্ণানুক্রমিক বানান পদ্ধতি পিনইনের মতোই রয়েছে। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে "চীনা বানান স্কিম" হিসাবে গৃহীত হয়েছিল (সরলীকৃত চীনা: 汉语手指字母方案; ঐতিহ্যগত চীনা: 漢語手指字母方案; পিনয়িন: Hànyǔnǐngǔngǔngǐì)। এটি একটি এক-হাতে ম্যানুয়াল বর্ণমালা, যা ফ্রাঙ্কোসাইন পরিবারের ভাষা যেমন ফরাসি এবং আমেরিকান ম্যানুয়াল বর্ণমালার মতো। আঙ্গুলের বানানের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল পিনয়িন ZH, CH, SH et NGকে একক বানান চিহ্ন হিসাবে ব্যবহার করা, দুই-অক্ষরের চিহ্নের অনুক্রমের পরিবর্তে, পিনয়িন থেকে আশা করা যেতে পারে; এটি স্ট্যান্ডার্ড চীনা ধ্বনিবিদ্যায় এই মৌখিক শব্দগুলির ধ্বনিগত অবস্থা প্রতিফলিত করে।
চীনা সংস্কৃতি এবং ভাষা দৃঢ়ভাবে CSL লক্ষণ প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ, CSL-এ "ভাই" এর জন্য কোন সাধারণ শব্দ নেই, শুধুমাত্র দুটি স্বতন্ত্র চিহ্ন, একটি "বড় ভাই" এবং একটি "ছোট ভাই" এর জন্য। এটি চাইনিজের মতো, যা শুধুমাত্র "ভাই" এর পরিবর্তে "বড় ভাই" বা "ছোট ভাই" উল্লেখ করে। একইভাবে, "খাওয়া" চিহ্নটি ASL-এর মতো হাত ব্যবহার না করে চপস্টিকের একটি সচিত্র উপস্থাপনাকে অন্তর্ভুক্ত করে।
***************
এইবার কয়-লাইন একটু 'ব্রেইল' নিয়ে আলোচনা;
~ এগুলো ছাড়াও কিছু আছে নিউমেরিক, যতিচিহ্ন,সাঙ্কেতিক চিহ্ন ও 'স্মল লেটার' বোঝানোর জন্য।
কাগজের ওপর ;ছয়টি বিন্দু'কে ফুটিয়ে তুলে লিখবার একটি পদ্ধতি। দৃষ্টিহীন ব্যক্তিরা এই উন্নীত বা উত্তল বিন্দুগুলোর ওপর আঙ্গুল বুলিয়ে ছয়টি বিন্দুর নকশা অনুযায়ী কোনটি কোন্ অক্ষর তা’ অনুধাবন করতে সক্ষম হয় এবং লেখার অর্থ বুঝতে পারে। ছয়টি বিন্দুর কোনোটিকে উত্তল করে আর কোনটিকে সমতল করে ৬৩টি নকশা তৈরী করা যায়। এক-একটি নকশা দিয়ে এক-একটি অক্ষর, সংখ্যা বা যতিচিহ্ন বোঝানো হয়। ৬টি বিন্দু বাম ও ডান দুটি 'উল্লম্ব স্তম্ভে' সজ্জিত থাকে। অর্থাৎ প্রতি আনুভূমিক সারিতে থাকে দুটি বিন্দু। বিন্দুগুলোর পরস্পরের আকার ও অন্তবর্তী দূরত্ব থাকে অভিন্ন। যেমন, যদি কেবল বাম স্তম্ভের ওপরের বিন্দুটি উত্তল থাকে আর বাকী ৫টি থাকে সমতল, তবে এ নকশাটি দ্বারা ইংরেজি বর্ণমালার 'a' অক্ষর বোঝায়। ছিদ্র যুক্ত বা উঁচু নিচু ধাতব পাত ব্যবহার করে বা ডট দিয়ে বিশেষ ধরনের কাগজের ওপর ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা যায়। বিকল্পে একটি বিশেষায়িত টাইপ-রাইটার ব্যবহার করা হয়।
সহজ সুন্দর বিষয়; কিন্তু এটা ইংরেজীতে যতটা সহজ মনে হচ্ছে আমাদের ভাষায় কিন্তু তেমন নয়। বাংলায় 'ব্রেইল' মোটেই এত নিরীহ দেখতে নয়। ভেবে দেখুন শুধু সাধারণ বর্ণ নয়- ছয়টি ডট দিয়ে ভয়ঙ্কর সব 'যুক্তাক্ষর' বিবিধ বিধান, মাত্রা, সাঙ্কেতিক চিহ্ন, ধ্বনি, ফলা, ঋ-এর পদ, হসন্ত, রেফ কেমনে পড়েন লিখেন অন্ধ মানুষেরা? আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি? ( ভেবে দেখুন; ৬ টি ডট দিয়ে শুধু ৬৩ টি নকশা করা যাবে, এর বেশী নয় কিন্তু।)
তবে অনেক অন্ধ মানুষ এদেশে পড়াশুনা করে এগিয়ে গেছে- যদিও তেমন বিখ্যাত কারো নাম জানি না। হুমায়ূন আহমেদের লেখায় পড়েছি, ঢাকা ভার্সিটিতে নাকি বেশ কিছু অন্ধ ছাত্র সাধারণ ছাত্রদের সাথে পড়াশুনা করে। নর্থ ডাকোটাতে 'কোয়ান্টাম মেকানিক্সে' তাঁর ক্লাসের সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল নাকি একজন কৃষ্ণাঙ্গ অন্ধ। তবে বাংলা লেখন পদ্ধতি যতটা জটিল ব্রেইল লেখন পদ্ধতিতে অন্ধদের খুব বেশীদুর এগিয়ে যাবার সভাবনা নেই বলে আমার ধারনা।
নীচের এই রিপোর্ট-টা দেখলে আপনি চমকে উঠবেন;
A study reported that approximately 40,000 children in Bangladesh are living with blindness each year. ~ আগের প্রজন্মের কথা বাদ দিলাম-এদের কি হবে?
শুধু কি তাই; বাংলাদেশে প্রতি বছর জন্ম নেওয়া এক লাখেরও বেশি শিশু অন্ধত্বের ঝুঁকিতে থাকে এবং সময়মতো তাদের চোখ পরীক্ষা করা না হলে এবং যথাযথ চিকিৎসা না পেলে তারা জীবনের জন্য দৃষ্টি শক্তি হারাতে পারে।
আপনি কি ভেবেছেন কখনো এদের কথা? বাংলা ভাষা তো এদেরও ভাষা- তাই নয় কি? আমরা শুধু আমাদের নিয়েই আছি। যে মানুষটা জন্ম থেকে পৃথিবীর কোন রূপ রঙ সৌন্দর্য দেখতে পায়নি- ভাষার কাঠিন্যে আমরা তাকে বিমূর্ত ধারনা দিতেও অপারগ! আমরা তো চোখে দেখি- তাদের দুর্ভাগ্য নিয়ে ভাববার বোধ আমাদের নেই। পৃথিবীর এত রূপ রস গন্ধ নিয়েও আমাদের শান্তি নেই - এমন চির বঞ্চিতদের নিয়ে ভাববার সময় কোথায় আমাদের???
~ বাংলা ব্রেইল( শুধু স্বর ও ব্যাঞ্জন-বর্ণ)
~ ইংলিশ গ্রেড-২ ব্রেইলি, যেখনে যুক্ত-অক্ষর শেখানো হয়।
***
* যে বিষয়গুলো নিয়ে আমি লিখেছি সে বিষয় নিয়ে আমি নিয়মিত ভাবি কিন্তু জানি খুব কম। সে জন্য তথ্যগত ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে প্রচুর। কেউ শুধরে দিলে উপকৃত হব। তবে আমি যা বলতে চেয়েছি সেটা আশা করি পরিষ্কার-ভাবে বুঝতে পারবেন। সময়ের অভাবে লেখা কিছুটা এলোমেলো খাপছাড়া হতে পারে, ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল।
*গতকাল লেখাটা দিতে গিয়েও ফের ড্রাফটে নিয়েগিয়েছিলাম। ব্লগমাতা জানা আপুর অসুস্থতার খবরে মনটা ভীষন ভারাক্রান্ত! বাংলা ভাষার প্রতি তার অদম্য টান ও ভালবাসা চিরকাল এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তার মত মানুষ জন্মেছে বলেই আজ আমরা মন খুলে নিজের ভাষায় মনের কথা কইতে পারছি। ভাষা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক ঝগড়া-বিবাদ খুঁনসুটি যাই করি না কেন এর পেছনে এই মানুষটার একক অবদান বিশাল। সারা বিশ্বের বাংলা ভাষা।-ভাষির কাছে অনন্তকাল তিনি চরম শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র হয়ে থাকবেন। আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কামনা থাকবে তিনি সব রোগ শোক কাটিয়ে উঠে নব-উদ্যোমে ফিরে আসুন আমাদের মাঝে খুব শীঘ্রই- প্রতিক্ষায় রইলাম .।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৩