somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীতে চিরতরে যুদ্ধ বন্ধের একটা সুযোগ এসেছিল!!

২৬ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মনে হয় শুধু মানুষের কল্পনাতেই এমন প্রস্তাবগুলো উপস্থাপন সম্ভব- যদি বাস্তবে হত তবে কেমন হত ভাবুন তো?
প্রত্যেকটি দেশের সমস্ত রকমের সৈন্যদল ভেঙে দেওয়া; সমস্ত অস্ত্র এবং সমর-সম্ভার, দুর্গ, নৌ আর বিমান ঘাঁটি নষ্ট করে ফেলা; সমস্ত ধরনের যুদ্ধজাহাজ আর যুদ্ধবিমান খুলে ফেলা; বাধ্যতামূলক সামরিক বৃত্তি তুলে দেবার এবং ট্রেনিংয়ের জন্যে রিজার্ভিস্টদের সমাবেশ করানো নিষিদ্ধ করে আইন জারি করা; যুদ্ধোপকরণ উৎপাদনের কারখানাগুলোকে ব্যবহার করার পক্ষে অকেজো করে ফেলা এবং সামরিক উদ্দেশ্যে সমস্ত রকমের ব্যয়বরাদ্দ বন্ধ করা, ইত্যাদি ইত্যাদি।

***এমন কি কখনো সম্ভব?? পৃথিবীর কোন পরাশক্তি কখনোই কোনকালে এমন কোন প্রস্তাব নিয়ে লীগ অব নেশন্‌স এ আনবে বলে কল্পনা করা যায়? আর সেটা যদি হয় আমেরিকা কিংবা রাশিয়ার মত কোন পরাশক্তি!!
আপনি যদি না জানেন তবে ধারনা করতে পারবেন না আজ থেকে প্রায় ৯৩ বছর আগে এই রাশিয়া নয় আরও বহুগুণ শক্তিধর প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন নিরস্ত্রীকরণ-সংক্রান্ত আপস-আলোচনায় ঐ সময়ে খুবই সক্রিয় অংশ নিচ্ছিল। লীগ অভ্ নেশন্‌স-এর পরিষদের যে-নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন বসাবার কথা ছিল তার প্রস্তুতি কমিশনের কাজে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম বার অংশগ্রহণ করেছিল ১৯২৭ সালে ৩০এ নভেম্বর। সোভিয়েত প্রতিনিধিদলের নেতা ছিলেন মাক্সিম লিৎভিনভ; সোভিয়েত সরকারের তরফে তিনি সর্বাত্মক এবং ষোল-আনা নিরস্ত্রীকরণের একটা সংক্ষিপ্ত আর মূর্ত-নির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরেছিলেন। এই প্রস্তাবের মধ্যে ছিল উপরোল্লেখিত দফাগুলি:
এই প্রস্তাব তোলার সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েত প্রতিনিধিদল ঘোষণা করেছিল যে, মূর্ত-নির্দিষ্ট প্রস্তাবের সঙ্গে অন্য যে কোন নিরস্ত্রীকরণ পরিকল্পনা থাকলে সেগুলি নিয়ে আলোচনা করতেও তারা প্রস্তুত। সোভিয়েত ইউনিয়নের পেশ করা খসড়া-প্রস্তাবটা ছিল অত্যন্ত সহজ-সরল আর অকপট। এতে ছিল মাত্র দুটো দফা: (১) প্রস্তাব করা হয়েছিল যে, সোভিয়েত প্রস্তাবের ভিত্তিতে সর্বাত্মক এবং ষোল-আনা নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে আলোচনার একটা সম্মেলন ডাকার বিস্তৃত পরিকল্পনা রচনার জন্যে প্রস্তুতি কমিশন অবিলম্বে কাজ শুরু করুক; এবং (২) সোভিয়েত প্রস্তাবের ভিত্তিতে রচিত সম্মেলনের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা এবং সেটাকে অনুমোদন করার জন্যে নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন বসানো হোক ১৯২৮ সালের মার্চ মাসের মধ্যে। সোভিয়েত খসড়া-প্রস্তাবটির প্রবল ছাপ পড়েছিল, সেটা বহু পশ্চিমা পত্র-পত্রিকায়ও স্বীকৃত হয়েছিল।
কিন্তু, প্রধান পুঁজিতান্ত্রিক দেশগুলি অনুসরণ করছিল সামরিকীকরণের কর্মনীতি, তাদের প্রতিনিধিরা কার্যত কোন আলোচনা ছাড়াই সোভিয়েত প্রস্তাবটিকে উপেক্ষা করে গিয়েছিল।

এইভাবে চতুর্থ দশকের প্রারম্ভ নাগাতই সম্মিলিত সোভিয়েত-বিরোধী ফ্রন্ট গড়ার অপচেষ্টা একেবারে ভেস্তে গিয়েছিল ১৯২৯ সালে পুঁজিতান্ত্রিক দুনিয়া পড়ে গিয়েছিল একটা অর্থনীতিক সংকটের আবর্তে, তার ফলে সমগ্র পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিহিত যাবতীয় দ্বন্দ্ব-বিরোধ প্রকোপিত হয়ে উঠেছিল। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ক্রমাগত বেশি মাত্রায় উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠছিল। প্রাচ্যে জাপান নেমে পড়েছিল সামরিক কার্য- কলাপে, উদ্বেগজনক সব সংবাদ আসছিল জার্মানি থেকে - সেখানে ফ্যাসিস্টরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার জন্যে সচেষ্ট হয়ে উঠেছিল।

১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাপানী ফৌজ অনধিকার প্রবেশ করেছিল উত্তর-পূর্ব চীনে। ১৯৩৩ সালের বসন্তকাল নাগাদ জাপান চীনের চারটে প্রদেশ দখল করে নিয়েছিল। জাপান সরকার ২৭এ মার্চ লীগ অভ্ নেশন্‌স থেকে ইস্তফা দিয়ে নিজ আক্রমণাত্মক কার্যকলাপ একেবারে অবাধে সম্প্রসারিত করে চালাবার ব্যবস্থা করে নিয়েছিল। এইভাবে দূর প্রাচ্যে সৃষ্টি হল যুদ্ধ প্রসারের কেন্দ্র।

ততদিনে ইউরোপে পরিস্থিতিও অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। বৈদেশিক ঋণের সাহায্যে জার্মানির শাসক মহলগুলি ১৯২৯ সাল নাগাত দেশের যুদ্ধ-শিল্পের বেশির ভাগটাকে আগেকার মাত্রায় ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল। চার বছর পরে, অর্থনীতিক মন্দা এবং শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের লক্ষণীয় বৃদ্ধির মধ্যে জার্মান বুর্জোয়ারা ক্ষমতা তুলে দিল ফাসিস্টদের হাতে, ফাসিস্টরা পৃথিবীর মানচিত্রটাকে নতুন করে প্রস্তুত করার লক্ষ্য গোপন করল না একটুও।
****
আসুন একটু দেখে নিই সোভিয়েত ইউনিয়নের মুল সেই প্রস্তাবে আসলে কি ছিল?

সোভিয়েত প্রতিনিধিদল তার সরকার কর্তৃক অনুমোদিত
সমস্ত স্থল, সমুদ্র এবং আকাশের সামরিক বাহিনী সম্পূর্ণ বিলুপ্তির ইএসএসআর সরকার এই প্রস্তাবটি বাস্তবায়নের জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলির অনুমোদন দেবার জন্য অনুরোধ করছে:
(ক) সমস্ত স্থল, সমুদ্র ও বিমান বাহিনীর বিলুপ্তি এবং
কোন গোপন নামে বা আকারে তাদের অস্তিত্ব থাকবে বা তা সে যে প্রয়োজনেই হোক না কেন।
(খ) সমস্ত অস্ত্র, সামরিক সরবরাহ ধ্বংস,
রাসায়নিক যুদ্ধ এবং অন্যান্য সমস্ত ধরণের অস্ত্রের জন্য অর্থ বরাদ্দ বন্ধ।
(গ) সমস্ত যুদ্ধজাহাজ এবং সামরিক বিমানবাহী জাহাজ বাতিল করা;
(ঘ) সামরিক বাহিনীর জন্য নাগরিকদের ডাকা বন্ধ করা সেনাবাহিনীদের পাবলিক পরিসেবার জন্য প্রশিক্ষণ বন্ধ করা;
(ঙ) সামরিক পরিষেবা বিলোপের জন্য আইন, হয় বাধ্যতামূলক, স্বেচ্ছায় বা নিয়োগপ্রাপ্ত; তাদের বিকল্প চাকুরীর ব্যবস্থা;
(চ) প্রশিক্ষিত রিজার্ভ কল আপ নিষিদ্ধ আইন;
(ছ) দুর্গ এবং নৌ ও বিমান ঘাঁটি ধ্বংস করা;
(জ) মিলিটারি প্ল্যান্ট এবং কারখানা স্ক্র্যাপিং এবং যুদ্ধ শিল্প সরঞ্জাম উৎপাদন বন্ধ করে; সাধারণ শিল্প কাজে ব্যাবহার করা;
(ঝ) সামরিক বাহিনীর জন্য তহবিল বরাদ্দ বন্ধ করা রাষ্ট্রীয় বাজেট এবং সরকারী সংস্থাগুলির উভয়ের উদ্দেশ্য;
(ঞ) সামরিক, নৌ ও বিমান মন্ত্রণালয়ের বিলুপ্তি, জেনারেল স্টাফ এবং সামরিক প্রশাসন সহ সব ধরনের বিভাগ এবং প্রতিষ্ঠান বিলুপ্তি;
(ট) সামরিক প্রচারের আইনি নিষেধাজ্ঞা, সামরিক বাহিনীর সামরিক প্রশিক্ষণ রাষ্ট্র এবং সরকারী সংস্থা উভয় ক্ষেত্রেই শিক্ষা নিষিদ্ধ করা;
(ঠ) সকলের পেটেন্টের আইনি নিষেধাজ্ঞা অস্ত্রশস্ত্র এবং ধ্বংসের উপায়, উদ্ভাবনের জন্য প্রণোদনা অপসারণের দৃশ্য
(ঢ) আইন লঙ্ঘন করে যে কোন উপরোক্ত শর্তাবলী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে প্রতীয়মান হবে;
(ণ) সকলের প্রত্যাহার বা সংশ্লিষ্ট পরিবর্তন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই আইন প্রণয়ন, উপরোক্ত শর্তাবলী লঙ্ঘন করে।

~ মাক্সিম লিৎভিনভ এঁর সন্মন্ধে আরো জানতে আপনি Litvinov Protocol পড়তে পারেন।

সোভিয়েত প্রতিনিধিদলের নেতা মাক্সিম লিৎভিনভ লীগ অব নেশন্স ~ এ তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে দারুণ একটা স্পিস দিয়েছিলেন। তাঁর সামান্য অংশ নীচে তুলে ধরছি।
আমরা এমন এক সময়ে বাস করি যখন নতুন যুদ্ধের প্রাদুর্ভাব অতি সহজ তাত্ত্বিক বিপদ। এটা শুধু আমাদের মতামত নয়...
পুঁজিবাদী দেশে অনেক দায়িত্বশীল রাষ্ট্রনায়ক আছে সম্প্রতি একই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। যুদ্ধ আসন্নতা
সর্বত্র অনুভূত হয়। আমরা যদি চিরদিনের জন্য এটি এড়াতে চাই, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধযুদ্ধ খেলা-মুক্ত একটা পৃথিবী দিতে যাই তবে কিছু একটা করতে হবে। আমাদের মতে, সেরা সব মানুষ এবং সব দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে
অবিলম্বে এবং সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ প্রয়োজন। এর সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত অবিলম্বে মুখোমুখি এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধান করা।


~ পৃথিবীতে ভুলে হোক ভয়ে কিংবা দুর্বল সময়েই হোক না কেন মহা শক্তিধর দেশের মহা শক্তিমান দেশ নায়কেরা ভাল কিছু কাজ করতে চেয়েও পারেন নি, তাঁর একটি উদাহরণ সোভিয়েত ইউনিয়নের এই নিরস্ত্রীকরণ প্রস্তাব। ভাবুনতো একবার সে সময়ে যদি এই প্রস্তাবটা সবাই মিলে মেনে নিত- তাহলে পৃথিবী আজ কেমন হত?

সুত্রঃ
USSR Proposes Disarmament (১৯২০-১৯৮০)
সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের ইতিহাস
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:০৩
১৯টি মন্তব্য ১৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এই ৩০ জন ব্লগারের ভাবনার জগত ও লেখা নিয়ে মোটামুটি ধারণা হয়ে গেছে?

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৬ ই জুন, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৯



গড়ে ৩০ জনের মতো ব্লগার এখন ব্লগে আসেন, এঁদের মাঝে কার পোষ্ট নিয়ে আপনার ধারণা নেই, কার কমেন্টের সুর, নম্রতা, রুক্ষতা, ভাবনা, গঠন ও আকার ইত্যাদি আপনার জন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আর্তনাদ

লিখেছেন বিষাদ সময়, ১৬ ই জুন, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২১

গতকাল রাত থেকে চোখে ঘুম নাই। মাথার ব্যাথায় মনে হচ্ছে মাথার রগগুলো ছিঁড়ে যাবে। এমনিতেই ভাল ঘুম হয়না। তার উপর গতকাল রাত থেকে শুরু হয়েছে উচ্চস্বরে এক ছাগলের আর্তনাদ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন তার আকাশের বলাকা || নিজের গলায় পুরোনো গান || সেই সাথে শায়মা আপুর আবদারে এ-আই আপুর কণ্ঠেও গানটি শুনতে পাবেন :)

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১৬ ই জুন, ২০২৪ রাত ১০:০০

ব্লগার নিবর্হণ নির্ঘোষ একটা অসাধারণ গল্প লিখেছিলেন - সোনাবীজের গান এবং একটি অকেজো ম্যান্ডোলিন - এই শিরোনামে। গল্পে তিনি আমার 'মন তার আকাশের বলাকা' গানটির কথা উল্লেখ করেছেন। এবং এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল্যাইকা লেন্সে ওঠানো ক’টি ছবি

লিখেছেন অর্ক, ১৭ ই জুন, ২০২৪ সকাল ১১:৩০




ঢাকার বিমানবন্দর রেল স্টেশনে ট্রেন ঢোকার সময়, ক্রসিংয়ে তোলা। ফ্ল্যাস ছাড়া তোলায় ছবিটি ঠিক স্থির আসেনি। ব্লার আছে। অবশ্য এরও একটা আবেদন আছে।




এটাও রেল ক্রসিংয়ে তোলা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×