somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার কোনো দেশ নেই....শুধু ভাষাটা আছে.....

২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ভোর ৬:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আমার প্রয়াত ঠাকুর্দা (পিতামহ) আজ থেকে বহু বছর আগে তার বিধবা মাকে সঙ্গে নিয়ে নিজের জন্মস্থান (বানরী গ্রাম, ঢাকা, বিক্রমপুর, বাংলাদেশ) ছেড়ে চলে আসেন কলকাতায়....আমার মেজজেঠু তিরিশ বছর বয়েসে কর্মসূত্রে কলকাতা ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন জার্মানি....গতবছর তিনি জার্মানিতেই নিজের বাড়িতে ওনার স্ত্রী ও একমাত্র পুত্রকে রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আশি বছর বয়েসে....আমার বড়জেঠুর একমাত্র পুত্র (আমার জ্যাঠতুতো দাদা) প্রায় বাইশ বছর আগে কলকাতার বাড়ি ত্যাগ করে আমেরিকায় চলে আসেন....তারপর থেকে এদেশেই নিজের স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে আছেন....এই দেশেরই নাগরিকত্ত্ব গ্রহন করেছেন...

আমার প্রয়াত দাদুর (মাতামহ) জন্ম বাংলাদেশের কুমিল্লায়....তারপর একটা সময়ে বাকি অনেক মানুষের মতন তিনিও নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন....তার কনিষ্ঠ পুত্র ও তার স্ত্রী (আমার ছোটোমামা-ছোটোমামী) প্রায় সতেরো বছর আগে কলকাতা ছেড়ে চলে আসেন আমেরিকায়....তারাও এখন এদেশেরই নাগরিক.....

আমি কলকাতা ছাড়ি ২০০২ সালে, দেশ ছাড়ি ২০০৭ সালে....পারিবারিক সুত্রে "নিজের বাড়ি ছেড়ে নতুন দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা ও সেখানে বসবাস" আমি বহন করে চলেছি....মাঝে মাঝে তাই মনে হয় যে ইচ্ছে থাকলেও আমার হয়তো আবার নিজের কলকাতার বাড়িতে ফিরে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করা সম্ভবপর হবে না.....অতীত তাই বলছে.....মন বলছে ফিরে যেতে কিন্তু মস্তিস্ক সায় দিচ্ছে না.....যদি মনের মতন কাজের জায়গা না পাই, যদি ফিরে গিয়ে কিছুদিন থাকার পরে আর ভালো না লাগে, যদি বিভিন্ন কারনে আমি "frustrated" হয়ে পড়ি....কলকাতার কর্মসংস্কৃতির থেকে, রাজনীতির থেকে আমি বহুদিন বিছিন্ন....আর যদি কলকাতাতেই না ফিরতে পারি তাহলে দেশের অন্য কোনো জায়গাতে ফিরে আমি কতটা আনন্দ পাব তাও জানি না.....তাই দ্বিধাগ্রস্থ অবস্থায় দিন কাটছে....যাকে বলে "confusing as well as conflicting state of mind".......এক কানের কাছে কেউ ফিসফিসিয়ে বলতে থাকে "ফিরে চলো, ফিরে চলো", আরেক কানের কাছে আরেকজন কেউ চিৎকার করে বলে ওঠে "তোমার কোনো দ্যাশ নাই, তোমার কোনো ভিটে নাই.....সারা পৃথিবীটাই তোমার দেশ....কোথায় থাকছো সেটা গৌন, কি কাজ করছ সেটাই মূখ্য"......


আমার কোনো দেশ নেই, ঘর নেই, শেকড়টাও আস্তে আস্তে ছিড়ে যাচ্ছে, কিন্তু ভাষাটাতো আছে, আজকাল নিজের মাতৃভাষা ছাড়া আর অন্যকোনো ভাষাতে কথা বলতে ইচ্ছে করে না, পড়তে ইচ্ছে করে না, লিখতে ইচ্ছে করে না....এ এক অদ্ভুত সমস্যা....আমি জানি লিখতে লিখতে, বলতে বলতে আমার বাংলাভাষার সাথে ইংরেজি মিশে যাচ্ছে অবলীলায় আর সেটা কিছু অস্বাভাবিকও নয়.....কিন্তু তবুও বাংলাভাষাকে আঁকড়ে ধরে দিনের পর দিন আমি কাটিয়ে দিচ্ছি এই বিদেশ-বিভুঁয়ে.....এই পৃথিবীর যেখানেই থাকি না কেন, সেই জায়গাটাকেই আমি আমার ঘর বানিয়ে নিচ্ছি, আমি কোনো ভৌগলিক সীমারেখা মানি না, কোনো কাঁটাতার মানি না, আর কেনই বা মানতে যাবো....আমার রক্তে বইছে এক দেশ ছেড়ে আরেক দেশে পাড়ি দেবার রীতি.....আমি শুধু মানি আমার ভাষাটা যেন সবসময় আমার কাছে থাকে, কোথায় থাকছি, কি করছি তার থেকেও বড় কথা হলো আমার ভাষা আমার সঙ্গে আছে কিনা....আর এই ভাষাকে সঙ্গে নিয়েই আমি সারা পৃথিবীর অন্য ভাষা-ভাষী মানুষদের কাছে পৌছতে পারছি কিনা....এই ভাষাকে সঙ্গে নিয়েই একদিন আমি চলে যেতে চাই আমার পূর্বপুরুষদের গ্রামে.....ছুঁয়ে আসতে চাই আমার শিকড়....এই ভাষাকে সঙ্গে নিয়েই একদিন আমি দেখতে চাই পশ্চিমবাংলা আর বাংলাদেশ একসাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে....আমাদের বুকের মধ্যেকার সেই পুরনো কাঁটাতারটা একদিন শুধু এই ভাষার জন্যেই অদৃশ্য হয়ে গেছে....শুধু এই ভাষার জন্যেই আমি আমার স্বপ্নচক্ষে দেখতে পাই আমার দাদু-ঠাকুর্দারা আবার তাদের জন্মস্থানে ফিরে যাচ্ছেন....আমার প্রয়াত জেঠু পুনরুজ্জীবিত হয়ে জার্মানি থেকে ফিরে আসছেন কলকাতায় শুধু নিজের ভাষায় নিজের আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধবদের সাথে কথা বলবেন বলে....আমার দাদা-বৌদিরা, মামা-মামীরা সবাই ফিরে যাচ্ছেন একে একে....আর তাদের পিছন পিছন নিজের ভাষাকে বুকের মধ্যে সযত্নে আঁকড়ে ধরে আমিও হাঁটা শুরু করবো....আস্তে আস্তে.....কোনো তাড়াহুড়ো নেই....কোনো তাড়াহুড়ো নেই....



শিবাশীষ দাশগুপ্ত
২১শে ফেব্রুয়ারী, ২০১৪
সিয়াটেল, ওয়াশিংটন।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×