ছোট্ট একটা ঘরে ছোট্ট একটা টেবিল, একটা চেয়ার, একটা বিছানা আর অল্প একটু খোলা যায় এমন একটা জানালা। ঐ জানালাটা আছে বলেই রক্ষা, আকাশ দেখে একটু দম ফেলা যায়। মাঝেমাঝে বিছানায় শুয়ে ঐ আকাশটা দেখেই কত স্বপ্ন দেখি, কল্পনার রাজ্যে বিচরণকরি।
পড়াশুনার পাট শেষ করে তিন বছর হতে চলল এই ছোট্ট ঘরেই আমার বাস। কোনরকমে দুই একটা টিউশনি করে মাসের খরচ চালাতাম আগে। আর এখন একটা পত্রিকায় একটু আধটু লেখালেখির কাজ পেয়ে চলছে। টিউশনিতে এখন আর আগের মতো মন নেই। ছাত্র পড়ানোর কাজ আর ভালো লাগে না।
বার তিনেক ভাইভা পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়েও চাকরি হারাতে হয়েছে। হয়ত ওপরি দেয়া নয়ত কোন বড় কর্তার আদেশ এই দুটোর সমণ্বয় করতে না পারার কারণে চাকরিটা আর শেষ পর্যন্ত হয়নি। সেবার অনেক আশা করেছিলাম, একটা বড় বাসা ভাড়া করে মা কে সঙ্গে নিয়ে রাখব আরও কত লালিত স্বপ্ন। শেষ পর্যন্ত এই ছোট্ট ঘরই এখনকার নিত্যদিনের সঙ্গী।
বিকেলের দিকে কাজ অল্প থাকে। দুটো পত্রিকায় খন্ডকালীন কাজ করি। তাও কোনদিন মনে হয় একাজও থাকবে না। সম্পাদকের কথা মতো লেখা না হলে চলে না। কিন্ত শেষ পর্যন্ত লেখা হয় আমারই মনের মতো।
শেষ পর্যন্ত গত মাসে একটা কাজে নিজেই ইস্তফা দিয়ে আসি। বুঝতে পারছিলাম সম্পাদক হাফ ছেড়ে বেচেঁছেন। আমার জায়গায় অন্যজনকে বসানোর জন্য তিনি সুযোগ খুজঁছিলেন।
ছাত্রজীবনে হোস্টেল আর কলেজের ছাত্ররাজনীতি এগুলোর কথা মনে পড়লে খানিকক্ষণ উদাস হয়ে যায় মন। অসীম, বিজয়দা, খোকন আর আমি। এই চার জনে মিলে বেশ ছিলাম। চার জনের কারো সাথেই মিলত না কোন বিষয়েই। তবুও চারজন ছিলাম এক ভুবনের বাসিন্দা। চায়ের কাপে ঝড় উঠত যে কোন বিষয়েই। অসীম ছিল তুখোড় ছাত্র, গণিতের মেধা আর বাস্তব জীবনেও অংক কষে কথা বলত। আর বিজয়দা রাজনীতি নিয়েই মত্ত থাকতেন। স্বদেশের কল্যাণে নিজের জীবন যে ছাই হয়ে যাচ্ছে সে ভাবনাই যেন ছিল না। আর আমাদের মধ্যে খোকন ছিল পড়ুয়া ছেলে, মাঝে মাঝে দু'একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করত আর চুটিয়ে প্রেম করত সবার সঙ্গে। তার ভাষ্যমতে জীবে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। তাই ঈশ্বরের তৈরী এতসব মেয়ের প্রতি অবিচার করা হবে যদি সে একজনের সঙ্গে প্রেম করে!!
তাই সবার সঙ্গেই ভাব। এ নিয়ে অসীম আর খোকনের মধ্যে তর্ক লেগেই থাকত সবসময়। আমার রাজনীতি প্রেম দুটোর কোনটাই করার সাহস ছিল না। নিজের খরচ চালাতে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়। হাতে অত ফালতু খরচের পয়সা না থাকলে মনের ঘরে কেউ আসে না। আর রাজনীতি সেটাতে আমার ধাত নেই।
খুব সাদাসিধা জীবন কাটাতাম। আর আমার টিউশনিগুলো জোগাড় করে দিত খোকনই। বছর খানেক আগে দেখা হয়েছিল, শুনেছি ভাল একটা চাকরি করে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। বিয়েও করেছে তবে তার চিরচেনা শত বান্ধবীদের সবাইকে কষ্ট দিয়ে তার মায়ের পছন্দের মেয়েটিকে।
বাসায় নেয়ার জন্য অনেক পীড়াপিড়ি করেছিল। শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি। বউ নাকি তার ভীষণ আহ্লাদি। আর তার মেয়েদের মন সম্পর্কে ব্যাপক অভিজ্ঞতা, মনমেজাজ বুঝতে সময় লাগে না। ভালই লাগছিল তার জীবনের বসন্তের লাল হলুদ ফুলের গল্প শুনতে।
বিজয়দা রাজনীতি নিয়ে দেশ উদ্ধার করতে পারেননি ঠিকই তবে নিজের দেহটাকে কঙ্কাল থেকে উদ্ধার করেছেন ঠিকই। শুনেছি কোন এক কারণে জেলে গিয়ে অত্যাচারে প্রায় মরতে বসেছিলেন। খোকনই বলল সে সব কথা। এখন আর বিজয়দাকে তার সেই পরিচিত পরিবেশে পাওয়া যায় না। একরকম নিভৃতচারী হয়ে কোন এক গ্রামে নাকি চলে গিয়েছেন সেখানকার ঠিকানা কেউ জানে না। একসময়ের মেধাবী ছাত্র নেতা কালের আবর্তে আজ পরিত্যক্ত সমাজের মানুষ।
আর আমাদের তুখোর ছাত্র গণিত নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনার উদ্দেশ্যে বিদেশ বিভুঁইয়ে পাড়ি জমিয়েছে।
খুব কাছের চারজন মানুষ আমরা। যে চারজন রোজ সকালে একসাথে নাস্তা করে বেড় হতাম। রাতে সবার একই খাওয়া চলত আর আজ জীবন নদীর স্রোতে সে চার জনের পাতে ভিন্ন আহার।
আমার জীবন চলছে কোন এক বৈদ্যুতিক বাতির নিভু নিভু আলোয়। যেখানে প্রতি মুহূর্তে একটি ভালো কাজের আশা আর প্রতিদিনকার জীবন বয়ে বেড়ানো।
মাঝে মাঝে ফুলার রোড ধরে হাটঁতে হাটঁতে শহীদ মিনারে গিয়ে দাড়াঁই, একসময় বসে পড়ি। স্মৃতি হাতড়াতে থাকি তখন। সেই সময়টাই এখন আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় মুহূর্ত। কেউ নেই পাশে অথচ প্রতিদিন একটা সময় স্মৃতিতে সবার একসঙ্গে থাকা। এই সুখস্মৃতিটুকু না থাকলে মানুষ বাচেঁনা।
মাঝে মাঝে ব্যস্ত রাস্তায় মানুষের চলাফেরা দেখে আনমনে হেসে উঠি। চলছে সবাই সময়ের চাকায়। আসলেতো থেমে আছি কোন এক আবর্তে। চক্করে পড়ে আছি। মনে হয় চলছি মনে হয় চলছি না।
আমার কলমে প্রতিদিন রাস্তায় চলমান এসব প্রত্যেকটি মানুষের কথাই ভেসে ওঠে। প্রতিদিনকার জীবনের অসংগতি রাজনীতি। দেশের স্বার্থ বিশ্লেষণ তবে সবই সরকারের পক্ষে থেকে নিরপেক্ষ হয়ে।
আমার কলম আর চলতে চায় না। নিজের বিরূদ্ধে চলা কলম আমাকেই থামিয়ে দেয়। বেশ বুঝতে পারছি আমাকে দিয়ে আর এ কাজ হবে না।
হবে না কোন ভালো কোম্পানিতে চাকরি। হবে না সরকারি চাকরি। দুটোর কোনটাই আর শেষ পর্যন্ত আমাকে দিয়ে হলো না বোধহয়। তবুও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা। যে সরকারের পক্ষ হয়ে এতদিন ধরে কলাম লেখা জনগণের দুর্ভোগ আর তার প্রতিকার নিজের সাথেই যেন প্রতারণা। আমিতো কম ভুক্তভোগী নই! কেবল স্বার্থেই নিজের স্বার্থেই এমন লেখা লেখে যাওয়া। কারন মাস শেষে ঐ কয়টা টাকা না পেলে আমার চলে না।
ইচ্ছে করে হাত খুলে লিখি। মন খুলে বলি। তবুও পারিনা। সব দায় আমার।
ইচ্ছে করে আমার বিজয়দা'র মতো আমিও কোথাও নিরূদ্দেশ হয়ে যাই। ইচ্ছে করে চলে যাই কোন এক নিভৃতপল্লীতে। ছোট্ট ঘরের চার দেয়ালে আবদ্ধ থেকে ঐ জানালার ফাক দিয়ে এক চিলতে আকাশ দেখতে আর ভালো লাগে না।
ইচ্ছে করে খোলা মাঠে গিয়ে দাড়াঁতে। ওপরের সুবিশাল আকাশ আর ঘাসের মাঠে পা ছড়িয়ে বাতাসে নিশ্বাস নিতে।
আর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে প্রিয় স্বদেশ আমাকে ক্ষমা করো স্বার্থের নেশায় আমি তোমার হয়ে কথা বলতে পারিনি কিছু করতে পারিনি।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৩ সকাল ১১:৪৯