কুয়েত ইস্যুতে উপসাগরীয় যুদ্ধ, ৯/১১ এবং আফগানিস্তান ও ইরাকে আগ্রাসন ইত্যাদি ঘটনার সাক্ষী একবিংশ শতাব্দীর দুনিয়া। খুব সম্ভবত, তেমনি এক নয়া কাহীনি সম্প্রতি ‘আমেরিকান বিমানে নাইজেরিয় যুবকের ব্যর্থ হামলা প্রচেষ্টা’। যে ঘটনাকে এখন ইয়ামেনে আগ্রাসনের ভিত্তি হিসাবে তৈয়ার করার কাজ চলছে। যার একদিকে নয়া দশকের আমেরিকান সম্ভাব্য রণক্ষেত্র ইরান আর অপর সীমান্তে রয়েছে ভুল শোধরাতে উদ্যোগী সৌদি রাজ।
মোতালেব বিষয়ক গোয়েন্দা কাহীনি
আমেরিকান গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ২৫ ডিসেম্বর ডেট্রয়েট বিমানবন্দরে অবতরণের আগে নর্থওয়েস্ট এয়ার লাইনসের ফ্লাইট-২৫৩ বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে নাইজেরিয় নাগরিক ওমর ফারুক আবদুলমোতালেব। ১১ জন ক্রু সহ বিমানটিতে মোট ২৮৫ জন আরোহী ছিল। মোতালেবের এই হামলা প্রচেষ্টা থেকে বিমানটিকে রক্ষা করে যাত্রী ও ক্রুরা নিজেরাই। তারা আটক কওে মোতালেবকে। নাইজেরিয়া থেকে আমস্টারডম হয়ে যুক্তরাষ্ট্র আসছিল মোতালেব।
গোয়েন্দা কাহীনিতে বলা হচ্ছে, নিজের পায়ের সঙ্গে লুকানো পাউডার ও তরল রাসয়নিক বিস্ফোরক দিয়ে বিমান উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে মোতালেব। একাজে সিরিঞ্জ ব্যবহারের চেষ্টা করে সে। হামলা প্রচেষ্টায় তার শরীরের কিছু অংশ পুড়ে যায় এবং অন্য দুই যাত্রী এতে আহত হয়। মোতালেবকে আটকানোর পর সে নিজেকে আল-কায়েদা প্রশিক্ষিত দাবি করে। এর কয়েক দিন পরেই নিজেদের আল-কায়েদার অংশ দাবি করে হামলার দায় স্বীকার করে একটি গ্রুপ।
যে প্রশ্নের জবাব নাই
অবশ্য হামলার দু’দিন পরই নতুন খবর প্রকাশিত হয়। আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম খবর দেয় যে, মোতালেবের বাবা আলহাজি ওমারু মোতালেব নিজের ছেলের আক্রমনত্মক মনোভাব সম্পর্কে আমেরিকান কর্তৃপক্ষকে আগেই সতর্ক করেছিল। কাজেই মোতালেব সম্পর্কে একটি নজরদারির নথি খোলে আমেরিকান গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ। তবে মোতালেবকে ‘নো ফ্লাই’ তালিকায় রাখা হয়নি, কেন রাখা হয়নি? জবাব নাই গোয়েন্দাদের কাছে।
ব্যর্থ হামলার পরে আমেরিকা যা করছে
ঘটনা পরিক্রমায় শুরু হয় মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসনে আমেরিকার নয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রস্তুতি পর্ব। দেশটির গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দাবি করতে থাকে যে মোতালেব ইয়ামেন ভিত্তিক আল-কায়েদা প্রশিক্ষিত। তাদের দাবি, ইয়ামেন আল-কায়েদার নয়া শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। হামলা প্রচেষ্টার জন্য গোয়েন্দা কর্তৃক্ষের ব্যর্থতাকে বারবার দায়ী করে ঘটনার চরমমাত্রার প্রতি ইঙ্গিতের চেষ্টা করেন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা- যনি কি না পরিবর্তনের শ্লোগানধারী। ইয়ামেনে সামরিক উপস্থিতি দ্বিগুন করার ঘোষণা দেন ওবামা। গত ৩ জানুয়ারি ইয়ামেনের পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝাতে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে দূতাবাস বন্ধ করে দেয় আমেরিকান কর্তৃপক্ষ। এর কয়েক ঘন্টা পরই আমেরিকান ইমামের অনুসারী হয়ে ইয়ামেনে নিজেদের দূতাবাস বন্ধ ঘোষণা করে বৃটেনও। একধাপ এগিয়ে টনি ব্লেয়ারের উত্তরসূরী গর্ডন ব্রাউন ২৮ জানুয়ারি ইয়ামেন ইস্যুতে জরুরি ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ঘোষণা দেন। অঙ্গিকার করেন, আমেরিকার সঙ্গে এক হয়ে ইয়ামেন ‘সংকট’ মোকাবিলার। আশা, আরো একটি মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের আন্তর্জাতিক সম্মতি মিলবে অনুষ্ঠিতব্য সম্মলনে।
গোয়েন্দা কাহীনি দুর্বল দিকগুলো
ইয়ামেন আগ্রাসনের ভিত্তি সাজাতে যে ঘটনার উপস্থিতি, যে গোয়েন্দা কাহীনি রচনা করা হয়, তার অনেক দুর্বল দিক উঠে আসে গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের নজরে। আমেরিকান বিমানে হামলার চেষ্টার আগে মোতালেব সম্পর্কিত তথ্য ও তার গতিবিধি বিশ্লেষনে এসব তথ্য উঠে আসে।
এক. বলা হচ্ছে, মোতালেব বিমান উড়িয়ে দেয়ার প্রশিক্ষনের জন্য ইয়ামেনে গিয়েছিল। ইয়ামেনের আল-সদস্যদেও কাছ থেকে প্রশিক্ষন পায মোতালেব। অথচ, এটাও জানা গেছে মোতালেবের মা ইয়ামেনে থাকে যা তার ইয়ামেনে আসার কারণ হতে পারে।
দুই. হামলার ঘটনায় ইয়ামেনি সন্দেহভাজনদের কয়েকজন বুশ প্রসাশনের আমলে আমেরিকার বন্দিশালা কুখ্যাত গুয়ান্তনামোবেতে আটক ছিল। তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বিচারের মুখোমুখি না কওে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। এবং এখন তাদেরই ব্যর্থ বিমান হামলার সন্দেহভাজন বলে প্রচার করা হচ্ছে।
তিন. ইয়ামেন সরকার জানিয়েছে, আটককৃত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার সম্পর্ক থাকার বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
চার. যদিও গোয়েন্দা কাহীনিতে বলা হয়েছে মোতালেবের বাবা একজন অবসপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা, কিন্তু আদতে তিনি ইসরাইলের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সহযোগিতাপুষ্ট একটি প্রতিরক্ষা শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।
পাঁচ. মোতালেবের আক্রমনাত্বক মনোভাবের কথা মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তাদের আগেই জানিয়েছিলেন তার বাবা। এই তথ্য অন্যান্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার সতর্কতাকে আরো শক্তিশালী করেছে।
ছয়. ‘সন্ত্রাসী নজরদারি’ তালিকায় থাকা সত্ত্বেও মোতালেবের আমেরিকান ভিসা বাতিল কখনো করা হয়নি। সন্দেহভাজনদের বিমানে ওঠা ঠেকাতে যা সবসময় করে আমেরিকা।
সাত. নাইজেরিয়া থেকে কোনো ধরনের কাস্টমস পাস ছাড়াই নেদারল্যান্ডে প্রবেশ করে মোতালেব। কোনো গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতা ছাড়া যা সম্ভব ছিল না।
আট. আমস্টারডাম বিমানবন্দরে এক ভারতীয় মোতালেবকে সহযোগিতা করে। মোতালেবকে পাসপোর্ট বিহীন সুদানি উদ্বাস্তু হিসাবে পরিচিত করে তাকে বোর্ডিং পাসের ব্যবস্থা করে দেয় সেই ভারতীয় আগন্তুক। অথচ ইওরোপিয় আইনানুযায়ি পাসপোর্ট ছাড়া তাকে কাস্টমস পার হতে দেয়ার কথা নয়। পাসপোর্ট ছাড়া বোর্ডিং পাস ব্যবস্থা করে দেয়ার এতগুলো ঘটনার কোন ভিডিও বিমানবন্দরের কোন সিসি ক্যামরায় ধারণ করা হয়নি।
নয়. উপরন্তু ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় সবচেয়ে অধুনা প্রযুক্তি সম্পন্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে আমস্টারডাম বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
দশ. প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বিমান ছাড়ার আগমুহূর্তে মোতালেবের পেছনে দাঁড়ানো এক ব্যক্তি তার ক্যামকোডার ব্যবহার করে ভিডিও করছিল। ওই ব্যক্তির এমন অস্বাভাবিক কাজের পরও তার পরিচয় এখনো শনাক্ত করা হয়নি।
এগারো. প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য থেকে জানা যায়, এ সময় মোতালেবকে শান্ত দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছে, কেউ একজন তাকে এমন শান্ত থাকার জন্য আশ্বস্ত করেছে, শিখিয়েছে এবং সে অনুযায়ী সে কাজ করে যাচ্ছে।
বারো. ফ্লাইট-২৫৩ এর যাত্রী কার্ট হাসকেল জানান, বিমানবন্দরে সন্দেহভাজন আরো একজন হ্যান্ডকাপ পরা ছিলো। আটককৃত ব্যক্তিকে বোমা-তল্লাশি কুকুর দ্বারা আটক করা হয়েছিল। তার লাগেজে বিস্ফোরক থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। অথচ এ ঘটনাটি এড়িয়ে যাচ্ছে এফবিআই, ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অনবরত অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে শুরু করেছে।
তেরো. এছাড়া ঘটনার বর্ণনায় এফবিআই কমপক্ষে চারবার তাদের বক্তব্য পরিবর্তন করেছিল বলে ডেট্রয়েট নিউজ নিশ্চিত করেছে।
চৌদ্দ. মোতালেবের যে ছবিটি এফবিআই সংবাদ মাধ্যমে পাঠিয়েছে-পটভূমিতে আল-কায়েদার পতাকাওয়ালা- ওটা ফটোশপে বানানো হয়েছিল।
পনের. গোয়েন্দা কাহীনিতে প্রথম বলা হয়েছিল যে, মোতালিব তার প্যান্টের মধ্যে ৫০ গ্রাম পিইটিএন বিস্ফোরক বহন করছিল, পরে পরিমান বাড়িয়ে ৮০ গ্রাম পিইটিএনের কথা বলে এফবিআই।
ষোল. স্বাধীন বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন যে, ওই পরিমান বিস্ফোরক দিয়ে যাত্রী কেবিনের আসনে বিস্ফোরন ঘটিয়ে বিমান উড়িয়ে দেয়া একেবারেই অসম্ভব- যে সম্ভাবনার দাবি তুলেছেন আমেরিকান গোয়েন্দারা।
আমেরিকান কাহীনি যতই দুর্বল হোকনা কেন, সবমিলিয়ে কাহীনির নায়ক মোতালিব ইয়েমেন গেলেন, আল কায়েদার সাথে দেখা করলেন, আমেরিকান বিমান উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন। ইয়েমেনের সরকারি বাহীনির বিরুদ্ধে নানা কারনে লড়াইরত যোদ্ধাদের আল কায়েদা বানানোর প্রয়োজন আছে আমেরিকার। কারন দীর্ঘদিন ধরে ‘অডিও’ হুমকির জন্ম দিয়ে টিকে থাকা আল-কায়দা মানেই আমেরিকান ফ্রিডম-এর দুশমন। যে দুশমনকে শায়েস্তা করতে যেকোনো ধরনের দখলদারি জায়েজ।
হদিস:
Click This Link
Click This Link
Click This Link
এবং ডেট্রয়েট নিউজ, ওয়াশিংটন পোস্ট, দি নিউ ইয়র্ক টাইমস, ভয়েস অফ আমেরিকা সহ অন্যান্য সংবাদ মাধ্যম
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১:১৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




