somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অসতী দাহ (১ম পর্ব)

১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৯ রাত ৮:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এটি একটি আরব মেয়ের গল্প। শুধু আরব নয় মুসলমান আরব।
একটা সিঙাড়া আর এক কাপ চা নিয়ে আরাম করে বসুন। গল্পটা খুব আরামের নয়। মেয়েটির নাম সোয়াদ। আগেপিছে কিছু নেই, শুধুই সোয়াদ। পারিবারিক নাম আছে একটা, কিন্তু ওটা সে ব্যবহার করেনা, পাছে কোন বিপদ হয়। পৈতৃক পরিচয় বহন করবার অধিকার তার নেই। তার বাবা-মা জানে না যে সে বেঁচে আছে। জানলে হয়তো তাকে দ্বিতীয়বার মরতে হবে!

আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে প্যালেস্টাইনের একটি ছোট্ট গ্রামে এ গল্পের শুরু। সোয়াদরা চার বোন, এক ভাই। ছোট দুটি সৎ বোনও আছে তার, বাবার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। ওর মায়ের বিয়ে হয়েছিল চৌদ্দ বছর বয়সে। প্যালেস্টানের মেয়েদের ওটাই হলো বিয়ের বয়স। তার বেশী হয়ে গেলে গ্রামের লোকের কানাঘুষা শুরু হয়ে যায়। কড়াকড়ি পর্দাপ্রথা না থাকলেও মেয়েদের নিষেধাজ্ঞাগুলো পর্দার চেয়ে কম নয়। মাথা নিচু করে হাঁটবে, প্রসাধন করে বের হবে না, কোন পুরুষের দিকে তাকাবে না, পুরুষের সাথে কথা বলবে না। এক মায়ের পেটের ভাই ছাড়া আর কোন যুবকের সাথে চোখাচুখি হলে সবাই চার্মুটা বলে গাল দিতে শুরু করে। চার্মুটা অর্থ হল খারাপ মেয়ে, বেশ্যা। আসলে সমাজের নিয়মটাই এই যে পরপুরুষের দিকে মেয়েদের চোখ পড়ার মুহূর্ত থেকেই তার পাত্র খোঁজা শুরু করতে হবে।

বিয়ের পর মেয়েদের তিনটি কর্তব্য। এক, অন্তত একটি পুত্র সন্তান প্রসব করতে হবে। দুই, দুইটি কি বড়জোর তিনটি কন্যাসন্তান, যাতে ঘরের কাজে, গরু-ছাগল আর ক্ষেত-খামারের কাজে সাহায্য করতে পারে। তিন, পরিবারের জন্য তিন বেলা খাবারদাবারের ব্যবস্থা। এর কোনটিতে সামান্য ব্যতিক্রম হলে তার শাস্তি আছে। সোয়াদ নিজে তার মাকে বহুবার বাবার হাতে পিটুনি খেতে দেখেছে। চুলের মুঠি ধরে কাবু করার পর শক্ত মার দেয়া হলো আবর-পুরুষদের একটি বৈশিষ্ট্য। আসলে মেয়েদের চুলের প্রতি গোটা আবরজাতির যেন একটা বিশেষ আর্কষণ। শুধু পুরুষ নয়, মেয়েরাও ঝগড়াঝাটি করতে চাইলে চুলের দিকেই তাক করে প্রথমে।

বলা বাহুল্য যে গ্রামে মেয়েদের স্কুলে পাঠানো হয়না, সেখানে মেয়েরা কাজ করে ঘরে। স্কুলে যায় ছেলেরা। সন্ধ্যাবেলা সবাই বাড়ি এলে বাইরের গেট বন্ধ হয়ে যায়। সোয়াদের বাবা আর ভাই আসাদ প্রায়ই বাইরে গিয়ে ফুর্তি করে, সিনেমা দেখে। মেয়েদের জন্য এগুলো হারাম। উপরন্তু ঘরের কাজে একটু উনিশ-বিশ হলে বাবা রেগে আগুন হয়। একদিন তার বড়বোন কৈনাত আর তাকে একসাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে মুখে কাপড় গুঁজে অসম্ভব মার মেরেছিল, কারণ ভেড়াগুলো ওদের পাহারায় না থেকে নিজেরাই ফিরে এসেছিল খোঁয়াড়ে। মেয়েদের ওপর অনর্থক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তার মা এসে বাঁধা দিতে চেষ্টা করেছিলেন। ফলে মাকেও মার খেতে হয়েছিল। কৈনাতের বিয়ের পর তার স্বামীও তার ওপর মারধোর শুরু করল। বেচারীর চুপ করে সহ্য করা ছাড়া উপায় ছিলনা। প্যালেস্টাইনের মেয়েরা স্বামীর অত্যাচারে কেঁদে কেঁদে বাপারে বাড়ি ফিরে আসতে পারে না। ওতে পরিবারের লজ্জা। লোকে মন্দ বলবে। একবার ওর এক বড়বোন বলেছিল মার নাকি চৌদ্দটি সন্তান ছিল। তার মধ্যে মাত্র পাঁচটি বেঁচে আছে, বাকিরা নেই কেন সে প্রশ্নটি তাকে মনে মনে খোঁচায়নি তা নয়। কিন্তু প্রশ্ন করতে সে সাহস পায়নি। একদিন নিজেই সে প্রমাণ পেয়ে যায়।

সোয়াদের বয়স তখন দশের নিচে। বাইরের কাজ সেরে ঘরে ফিরে দেখে তার মা মেঝের ওপর পাতা বিছানায় শুয়ে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন। তার খালা সালিমা পাশে বসে এটাওটা করছেন। কিছুক্ষণ পরে সন্তান ভূমিষ্ট হলো। বাচ্চাটাকে খালা হাতে ঝুলন্ত অবস্থায় ধরে আছেন। বাচ্চাটি তখন কাঁদছিল। মা তাকে এক নজর দেখলেন। তারপর বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে মেঝেতে ছড়ানো ভেড়ার চামড়াতে মুড়ে বাচ্চাটিকে চেপে ধরলেন শক্ত করে। বাচ্চাটির কান্না থেমে গেল! দশ বছরের খুকী হয়েও সোয়াদের বুঝতে বাকি রইল না কেন চৌদ্দটি বাচ্চার মধ্যে এখন পাঁচটি টিকে আছে। সোয়াদের শরীর থরথর করে কাঁপছে তখন, কিন্তু নোরা নির্বিকার। যেন কিছুই হয়নি, দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। সে ফিসফিস করে বলল সোয়াদকে- আমার যদি মেয়ে হয় আমিও ঠিক এই করব।

বাবা মা বা গ্রামের মুরব্বিদের নিষ্ঠুরতায় কোনদিন অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি সোয়াদ। প্রতিটি মুহূর্তে মনে হত এটাই তার জীবনের শেষ মুহূর্ত। সে দা-কুড়াল দেখলে ভয় পায়, বাবার মুরগি কাটা বা ভেড়া কাটা দেখেলে তার রক্ত হিম হয়ে যেত, সে মই বেয়ে উপরে উঠতে ভয় পেত, বিশেষ করে তার বাবা সে মই ধরে নিচে দাঁড়িয়ে থাকলে। সবচেয়ে বেশী ভয় পেত সে বাড়ির কুয়োটাকে। কূয়োর পানিতে পড়ে মরার আতঙ্ক একটা বাতিক হয়ে দাড়িয়েছিল ওর। কল্পনা করত একদিন বাড়ি ফিরে দেখবে তার বাবা মাকে কূয়াতে ফেলে দিয়েছে। মায়ের মৃত্যুকে দারুণ ভয় পেত সে। কারণ আর যাই হোক মাই ছিল তার একমাত্র আশ্রয়।

হেনা নামে একটা বোন ছিল তার। ভীষন সুন্দর দেখতে। চরিত্র স্বাভাবেও সে ছিল অন্য সবার থেকে ভিন্ন। খেয়ালী, স্বাপ্নিক, ভাবাবিষ্ট। কেউ তাকে কিছু বললে যেন কানে যেত না ওর। কাজেকর্মে মন ছিলনা। সবকিছুতেই ঢিলামি। তার চালচলন ছিল বড়লোকের সৌখিন মেয়েদের মতো। ওর কপালে যে দুঃখ ছিল সেটা সবাই জানত। একদিন বাড়িতে চিৎকার চেচামিচি শুনে সোয়াদ আর তার বোনগুলো দৌড়ে গেল কি হয়েছে দেখতে। গিয়ে দেখে হেনা মাটিতে পরে গলাকাটা ভেড়ার মতো দাপড়াচ্ছে, হাত,পা,মুখ শক্ত করে বাঁধা। ভাই আসাদ তার গায়ের ওপর বসে গলায় ফাঁসি দিয়ে মারবার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হেনার আমলকীর আঁশের মতো নরম আদুরে মুখটা নীল হয়ে উঠল। জিভ বেড়িয়ে এলো গলা থেকে, যেন ওটাই প্রতিবাদের একমাত্র অন্ত্র। কি অপরাধ করেছিল হেনা তা কোনদিন জানতে পারেনি সোয়াদ। জানতে চাওয়ার সাহস ছিলনা। প্যালেস্টাইনের গ্রাম্য মেয়েরা জীবন হারায় কেবল যৌবনের অপরাধে। আরবজাতির মুসলমান ঘরে পারিবারিক সম্মানের চাইতে মূল্যবান জিনিস আর নেই। আর সেই সম্মান রাখা না রাখার পুরো দায়িত্বটাই মেয়েদের। আসাদের মহান কর্তব্যটি সংঘটিত হবার কালে বাবা মা দুজনেই ছিল বাড়ির বাইরে। ফিরে এসে এ ঘটনা দেখে আসাদের সাথে কি কথা বলাবলি করার পরই মা যথারীতি কাঁদতে শুরু করলেন। যথারীতি কারণ এমন নাটক আরো দেখেছে সোয়াদ। কোন অপরাধ করা হলে প্রথমে পারিবারিক সালিশে সিদ্ধান্ত নেয় হয় কি শাস্তি দেয়া হবে। বিবাহ-বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক হলে মৃত্যুদণ্ড অবধারিত। কোন কোন ক্ষেত্রে তার চেয়ে লঘু অপরাধেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় মেয়েদের। আর শাস্তিটি কার্যকর করার দায়িত্ব দেয়া হয় পরিবারের কোন না কোন সদস্যর ওপর। আর যার ওপর দায়িত্বটি দেয়া হয় তিনি হলেন ভাগ্যবান। কারণ কাজটি মহৎ, এতে পূণ্য আছে। দণ্ডের কার্য দিবসে বাবা মা কোন এক ছুতোয় বাইরে চলে যান। কর্মসিদ্ধির পর ফিরে এসে সোয়াদের মায়ের মতো নাকিকান্না জুড়ে দেন। এই হল সামাজের ধারা। পারিবারিক সম্মান-রক্ষার মধ্যযুগীয় পন্থা।

চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে অক্টোবর, ২০০৯ রাত ৮:১৬
১০টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×