‘ওহাব এত বড় ডাক্তার হোবেরই পারে না। ও আবার ডাক্তারি পোরলো কবে? অতো বড় ডিগ্রি পায়লো কোনে? এতো টেকা-পয়সাই বা পায়লো কোনে? পাবনাতেও নাকি তার কোটি টাকার বাড়ি আছে?’
আলোচিত অজ্ঞ-বিশেষজ্ঞ এ ওহাব খানের বাড়ি পাবনার চাটমোহর উপজেলা শহরে তাঁকে নিয়ে এখন এমন নানা আলোচনা হচ্ছে। এই আলোচনায় ঘি ঢালছে তাঁর পাঁচ বিয়ের তথ্যও। উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের মুশাগাড়ী গ্রামের ওহাব এলাকায় ওষুধের দোকান দিয়ে তাঁর পেশাগত জীবন শুরু করেছিলেন। সেখান থেকে বনে যান স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ। চাকরি নেন ঢাকার জয়নুল হক সিকদার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে, সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে।
গত ৯ মে ‘অজ্ঞ থেকে বিশেষজ্ঞ!’ শিরোনামে প্রথম আলোতে ভুয়া সহযোগী অধ্যাপক এ ওহাব খান সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এর পর থেকে ওহাব খান গা ঢাকা দেন।
সাম্প্রতিক সময়ে এ ওহাব খান চাটমোহর পৌর এলাকায় দুটি দোতলা বাড়ি করায় পৌরবাসী কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। প্রথম আলোতে তাঁর সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর সেই কৌতূহল বহুগুণ বেড়ে যায়। বেশ কিছুদিন ধরে ওহাব খান এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত হওয়া শুরু করেছেন। এলাকার বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অনুদানও দিয়েছেন। তাঁর এই তৎপরতাকে অনেকেই রাজনীতিতে আসার লক্ষণ বলে মনে করতেন।
উপজেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের মুশাগাড়ী গ্রামের নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান এ ওহাব খান এলাকার চড়ইকোল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে গ্রামের বাড়িতে গেলে তাঁর বড় ভাই ইউসুফ খান বলেন, ‘প্রাইমারিতে পড়াকালীন বাবা মারা গেলে ওহাব কুষ্টিয়ায় চলে যায়। অনেক বছর পর সে এসে বলে, “ভাই, আমি ডাক্তার হয়েছি”।’ তিনি বলেন, ‘সে ছোটবেলা থেকে ডানপিটে। আমরা তাকে কোনো সহযোগিতা করতে পারিনি। নিজের চেষ্টায় বড় হয়েছে। এখন আপনার কাছে শুনলাম, সে ভুয়া ডাক্তার।’
গা ঢাকা দেওয়ার বিষয়ে ইউসুফ খান জানান, এখন পর্যন্ত ওহাব বাড়ির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। ওহাবের পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, প্রথমে সে গ্রামের মাওলানা ছগির হায়দারের মেয়ে ফরিদাকে বিয়ে করে। এক ছেলে হবার পর তাকে তালাক দেয়। এরপর রুমা নামের চুয়াডাঙ্গার এক মেয়েকে বিয়ে করে। সেই স্ত্রী মারা গেলে ওহাব আবার গ্রামের জন রোজারিওর মেয়ে কল্পনা রোজারিওকে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করে। ১৯৮৬ সালে এলাকার মথুরাপুর বাজারে একটি ছনের ঘর তুলে ওষুধের দোকান দেয়। কিছুদিন পর দোকানের পাশের চায়ের দোকানি রমজান আলীর মেয়ে নূরজাহানকে বিয়ে করে। কিছুদিন পর তাকে তালাক দিলে এলাকায় সমস্যা হয়। গ্রাম্য সালিসে তাকে আট হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। শেষে ওহাব ঢাকায় মুক্তা নামের উচ্চশিক্ষিত এক মেয়েকে বিয়ে করে।
এ ওহাব খানেরা পাঁচ ভাই ও চার বোন। বাবা মৃত আবুল হুসাইন ওসমান গনী খান। বড় ভাই ইউসুফ খান এলাকার একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। অন্য ভাইয়েরা কৃষিকাজ করেন। বাবার ১৮ বিঘা জমি ছিল। বাড়িতে ছয় কক্ষের একটি কাঁচা-পাকা ঘর আছে।
এ ওহাব খানের লেখাপড়ার বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে দুই রকম তথ্য পাওয়া গেছে। মথুরাপুর বাজারে তাঁর সেই দোকানটি কিনে নিয়েছিলেন রাশেদুল ইসলাম। তিনি দাবি করেন, এ ওহাব খান অষ্টম শ্রেণী পাস। আবার ওই এলাকার বৃদ্ধ আমজাদ হোসেন আকন্দ দাবি করেন, ওহাব খান আটঘরিয়ার রামচন্দ্রপুর মাদ্রাসা থেকে আলিম (এইচএসসি) পাস করেছেন। তাঁকে সনদও দেখিয়েছেন ওহাব খান।
এলাকার জাকির হোসেন ও ইউসুফ আলী জানান, এ ওহাব খান ১৯৯০ সালের পর মথুরাপুর ছেড়ে পাশের আটঘরিয়া উপজেলার নাদুরিয়া গ্রামে তাঁর বোনের বাড়ির কাছে বাজারে আবার একটি ওষুধের দোকান দিয়েছিলেন। সেখানে সমস্যা হলে ওহাব খান পালিয়ে ঢাকায় চলে যান।
এ ওহাব খানের মামা হরিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মকবুল হোসেন বলেন, ‘আমি তার পেশাগত বিষয়ে কিছুই জানি না। তবে সে আমার এলাকার গরিব মানুষদের চিকিৎসা-সহায়তা দেয়। আমার মাদ্রাসায় সে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছে।’
চাটমোহর পৌরসভার গাইনগড় মহল্লার দোতলা বাড়িতে থাকেন ওহাবের তৃতীয় স্ত্রী কল্পনা খান। তিনি দোতলায় এক ছেলেকে নিয়ে থাকেন। কল্পনা এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি তার খারাপ কিছুই জানি না। ওহাব একজন ভালো ডাক্তার, এটা আমি বিশ্বাস করি। ও পড়াশোনা করত। এলাকার মানুষদের সে অনেক সাহায্য করে। আত্মীয়দের করে।’
কল্পনা দাবি করেন, ‘ওহাব যদি ভুয়া ডাক্তার হবে, তাহলে সিকদার মেডিকেলের মতো প্রতিষ্ঠান ওকে চাকরি দিল কীভাবে? তাহলে তো ওরাও ভুয়া।’
একজন ভুয়া ডিগ্রিধারী কী করে জয়নুল হক সিকদার উইমেন্স মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে চাকরি পেলেন, তা জানতে পাঠক ও পেশাজীবীদের আগ্রহ ব্যাপক। শুধু আগ্রহ নেই ওই মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবু শামীম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যত দূর শুনেছি, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সেনাবাহিনীর একজন পদস্থ কর্মকর্তা কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, ওহাব খান ভালো ডাক্তার। সেভাবেই তাঁর চাকরি হয়।’ অধ্যক্ষ সেই সেনা কর্মকর্তার নাম বলতে পারেননি।
কলেজ কর্তৃপক্ষ ওহাব খানকে চাকরিচ্যুত করেই দায়িত্ব শেষ করেছে। কিন্তু সরকারি পদস্থ কর্মকর্তারা বলছেন, ডিগ্রি নেই এমন লোককে চাকরি দেওয়ার দায়দায়িত্ব প্রাথমিকভাবে মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের। সরকারেরও এ ক্ষেত্রে কিছু দায়িত্ব আছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খন্দকার মো. সিফায়েত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, আইন ও বিধি অনুযায়ী কলেজ ও হাসপাতাল চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেবে। যাঁকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তিনি চিকিৎসক কি না, তা প্রাথমিকভাবে যাচাই করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও পরিদর্শনে গিয়ে এসব যাচাই করতে পারে।
তবে গতকাল রাতে মুঠোফোনে মো. আবু শামীম প্রথম আলোকে জানান, ২০০৮ সালের ১ আগস্ট এ ওহাব খান চাকরিতে যোগ দেন। ব্যাংকে বেতন পাঠানোর হিসাব থেকে এটা তিনি জেনেছেন বলে দাবি করেন। ওহাব খানের মাসিক বেতন ছিল দেড় লাখ টাকা। তাঁর বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা হতে পারে বলে তিনি জানান।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


