যদি ব্যপারটা এমনভাবে দাঁড়া করানো যায়; আপনি ভালোবেসেই চলেছেন… ভালোবেসেই চলেছেন… কিন্তু এর যবনিকাপাত হবে সম্পূর্ন শূন্য হাতে… তাহলে? ধরুন, আপনি একজোড়া চোখের দিকে তাকিয়েছেন কিছু আশা নিয়ে, কিছু একটা খুঁজে পেতে; কিন্তু হারিয়ে গেলেন তার চোখের শূন্যতার গহ্বরে। অথবা একজোড়া হাত আপনার হাতে তুলে নিলেন, আঁকড়ে ধরলেন আবেগ দিয়ে। কিন্তু অনুভব করলেন নিষ্প্রানতার তিক্ত ছোঁয়া… তাহলে?
চলুন ব্যপারটাকে আরেকটু তিক্ত করা যাক। আপনি চান না কোন মেয়ে আপনার জীবনে এসে সব কিছু উলোটপালোট করে দিক। মেয়ে শব্দটাই আপনার কাছে বিরক্তিকর জীব। একমাত্র এরাই পারে একটা ছেলের সঠিক চলন্ত পথে কাঁটা ছড়িয়ে দিতে। কেন আপনি চাইবেন এরা আপনার দূর্বলতা জানুক? কেন চাইবেন ভালোবাসতে?
কিন্তু তারপরেও মানুষ ভালোবাসে; যেমন আমি ভালোবেসেছি। ভালোবাসা পেতে নয়… কষ্টকে জড়াতে।
একদমই দূর্ঘটনাবশতঃ ভালোবেসেছি ওকে। ও সহজে আমার সাথে দেখা করতে রাজি হয় না। বাসা থেকে বের হতে আলসেমী কাজ করে। স্বাভাবিক ব্যপার। আমাকে ভালোবাসে না সে। তবে নাকি পছন্দ করে। খুবই পছন্দ করে। কিন্তু আসলেই কি! এমনও হতে পারে আমি তার একাকিত্বের ঝাপসা এক ছায়া; যে একাকিত্ব দূর করতে সাহায্য করে। এই সামান্য একটু টাইম পাস, এই আরকি! কিছুটা গান শোনার মতো। ইচ্ছে হলে গানের ক্যাসেটি চালানো হলো, ভালো লাগলো না ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হলো!
আমিই তার সাথে দেখা করার জন্য কোন না কোন ছুঁতো বের করি। যখন কোন কিছু চাই, তখন নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়। আজ খুব কষ্ট করে মুখ থেকে বের করলাম, “আগামীকাল দেখা করবে? স্টার সিনেপ্লেক্সে কিংকং এখনো চলছে। ছবিটি তোমার ভালো লাগবে।”
আমাকে খুশি করার জন্যই হোক, কোন কিছু না ভেবেই হোক অথবা আর অলস সময় কাটানোর জন্যই হোক; সে অতি সাধারনভাবেই উত্তর দিলো, “আচ্ছা।” আর কিছু না হোক বন্ধু হিসেবে বেশ ভালো মেয়েটা।
পরের দিন চরম উত্তেজিত থাকলাম। ওর সাথে দেখা হবে। আরও একটা কারন আছে। ওর কিছু ছবি দেবে আমাকে। খুব বেশি পছন্দ করি ওর ছবি দেখতে। ও রাঙামাটি গিয়েছিলো। আমি জেদ ধরেছিলাম ও যে সমস্ত ছবি তুলেছে, আমাকে দেখাতে হবে। নিজে ক্যামেরা নেই নি বলে অন্য ছেলে বন্ধুদের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলেছে। নিজের ছবি দেখাতে পছন্দ করে না সে। যাই হোক রাজি হয়েছে; তবে বেশ কষ্টে। আমাকে ছবি দেবে, কিন্তু সব ছবি নয়। বাছাই করে দেবে। স্বাভাবিক ব্যপার; তাই না! ওর সব ছবি আমার দেখারতো অধিকার নেই। যদিও ওর ভার্সিটির ফ্রেন্ডদের তোলা; প্রতিটা ছেলে মেয়ের কাছেই ওর সব ছবি আছে….
আগ্রহের সাথে তাল মেলাতেই বোধহয় সে আমার ছবিগুলোও দেখতে চাইলো। এর আগে কখনোই চায় নি। আমি সেদিন রাত্র সাড়ে চারটা পর্যন্ত জেগে থেকে ওর চাওয়া বেশ কিছু ছবি খুঁজে বের করে আবার নতুন করে স্ক্যান করে কম্পিউটারে ঠিক করে নিলাম। ওতো কখনো কিছু চায় না আমার কাছে!
পরের দিন অফিস। জুতোটা বোধহয় আবার ব্রাশ করতে হবে। এমনিতে সাধারনতঃ অফিসে যাওয়ার সময় অতটা খেয়াল থাকে না। বডি স্প্রে, রেজর/ফোম, ইস্ত্রি করা কাপড় আলাদা করলাম। সকালে তাড়াহুড়োর সময় খেয়াল থাকবে না।
কিন্তু সকালে যা হয় আরকি। সব কিছুই ঠিকঠাক মতো ছিলো, কিন্তু অর্ধেকখানি রাস্তা গিয়ে মনে হলো পেনড্রাইভটাই নেই নি। আবার রিকশা ভাড়া করে বাসায় ফিরে এলাম। আমাকে দেখে পিচ্চি ভাগনী হৈ হৈ করে উঠলো। পেনড্রাইভ নিয়েই দৌঁড়ে আবার বেরিয়ে গেলাম।
অফিসে মাত্র মাসখানেক হলো জয়েন করেছি। আইন কানুন রক্ষায় খুবই কড়া এই অফিস। গিয়ে শুনি আজ সন্ধ্যায় সাংবাদিক সম্মেলন হবে। অফিসের সব্বাইকেই থাকতে হবে। বিশেষ করে আমাকে; এর আগে সাংবাদিক ছিলাম বলে। যারা সাংবাদিক সম্মেলনে আসবে, তারা হয়তো আমার আগের কলিগরাই। ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের ডাইরেক্ট হুকুম। কিন্তু আজ যাই ঘটুক, আমি আগে আগে বের হয়ে যাবো। ওর সাথে দেখা হবে; এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর কি থাকতে পারে। সাফ জানিয়ে দিলাম পারবো না।
দুপুরে একবার ফোন দিলাম। তার বাসায় যাওয়ার কথা। দুপুরের লাঞ্চ ওখানেই করবে। খেয়েছে তো?
জানা গেলো এখনো বাইরেই আছে। আর লাঞ্চ… করে নিয়েছে।
লাইনটা কেটে একটুখানি তাকিয়ে থাকলাম হাতের মোবাইলটার দিকে। সাধারনতঃ একা একা লাঞ্চ করে না সে। কার সাথে লাঞ্চ করেছে সেটাও জানায় নি। মম… তাহলে…!
সময় মতো ব্যগটা নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। পকেটে টাকা বেশি নিয়ে ঘুরি না। তাই দুপুর বেলা ব্যাঙ্কের বুথ থেকে হাজার খানেক টাকা তুলেছি। ও চিপস খেতে পছন্দ করে। তাই চিপস আর বোরহানী কিনবো। আর রাত্রে প্রায়ই না খেয়ে ঘুমায় বলে, আজকে একসাথে ডিনার করে তারপর বাসায় ফিরবো।
কিন্তু কোন রেস্টুরেন্টটা ভালো হবে? একবার মনে পড়লো ক্যান্ডেল লাইট রেস্টুরেন্টের কথা। ঠিক করেছিলাম ওখানে ওর জন্মদিনে একসাথে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করবো। কিন্তু সে সময় দেবে না। তার জন্মদিনে অন্যান্য বন্ধুদেরও তো দাবী আছে। সেদিন আমার সাথে দেখা নাও হতে পারে। কিন্তু আমি ধারনা করতে পারছি। সে বিশেষ কারও জন্য অপেক্ষা করবে। যে ডাকতেও পারে.. নাও পারে..।
আচ্ছা, আমি কোন পর্যায়ে পড়েছি? ভালোতো বাসেই না। কেন তাহলে এতো পাগলামী করছি? অন্ততঃ এতোদিন ভাবতাম বন্ধু হিসেবে দেখে; কিন্তু এখন মনে হচ্ছে… বেহায়া নোংরা কুকুরের পর্যায়ে পৌঁছে গেছি, যে একটুখানি আদরের জন্য মানুষের শত গালি লাত্থি খেয়েও আশে পাশে ঘুরঘুর করে। আমি মানসম্মান বিসর্জন দেয়া শুরু করলাম কবে থেকে?
দূর দূর… এখন এই সব ভাবছি কেন। যতো যাই হোক, ভালোবাসি। দেখলোই বা আমার দূর্বলতা!
ফোন দিলাম।
“আমি বের হয়ে গেছি।”
“আহ্ .. আমার বোধহয় একটু দেরী হবে।” একটু দ্বিধা নিয়ে ঐ পাশ থেকে জানানো হলো।
“কত দেরী হবে..” বোধহয় কন্ঠটা একটু আদুরে করার চেষ্টা করলাম।
“আমি তোমাকে একটু পরে জানাই? এই দশ মিনিট পরে।”
“আচ্ছা।” বলে লাইন কেটে দিলাম।
বোধহয়…. ও এখনো কার সাথে আছে… বোধহয় বুঝতে পারছি। কথা বলার সময় তার কন্ঠ ছিলো অস্বস্তিতে ভরা। আনমনে বাসডিপোর দিকে হাঁটতে থাকলাম। …কিন্তু আজকে কেন তার সাথে দেখা করতে গেলো? আজকে সে আমাকে সময় দিয়ে রেখেছে। নাহ্ কথা যখন দিয়েছে, কথা অবশ্যই রাখবে। কিন্তু আমি ঐ ছেলের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নই, তা-তো সাফ জানিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কথা দিয়েছে-তো…
ঘ্যাঁচ করে একটা বাস ব্র্যাক কষলো পেছনে। আরি! কখন রাস্তার মাঝখানে চলে এসেছি খেয়ালই করিনি! দ্রুত ফুটপাতে উঠে গেলাম। বাস ড্রাইভার ভ্রঁ কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। পাশ থেকে একটা লোক বলে উঠলো, “কি মিয়া… দিনে দুপরে ব্যস্ত রাস্তার মাঝে হাঁটেন..”
দশ মিনিট নয়, তিন মিনিটের মাথায় ফোন আসলো।
“এই… আজ আসতে পারবো না। তুমি রাগ করো না, হ্যাঁ…” বোধহয় খুশি খুশি কন্ঠে বললো। ব্যাপারটা স্বাভাবিক। সে এখন তার প্রিয় মানুষের সাথে সময় কাটাবে। আমাকে ফোন করে জানিয়েছে, এই-ই তো অনেক বেশি। এর আগেও কথা দিয়ে দেখা না করায় কথা কাটাকাটি হয়েছে। কিন্তু আমাকে পাত্তা দেয়ার মতো কোন বিষয় নই আমি তার কাছে।
“না, আমি বুঝতে পেরেছি।” থমথমে কন্ঠে কথাটা বলে, বাই না বলেই মোবাইলের নো বাটন চেপে ধরলাম সর্ব শক্তি দিয়ে।
জেদ চেপে গেছে। মোবাইলের নো বাটনে চেপে ধরেছিতো ধরেছিই। বন্ধ হয়ে গেলো মোবাইলটা। ভালোই হলো। কারন জানি এখন স্বাভাবিক থাকলেও কিছুক্ষন পর নিজেকে আর সামলাতে পারবো না। দ্রুত বসার জায়গা খুঁজলাম। কিন্তু আসে পাশে কোথাও বসার জায়গা নাই। মতিঝিল এলাকা। মানুষ গিজগিজ করছে।
যা ভেবেছিলাম, তার চেয়েও দ্রুত পরিবর্তন হলো আমার চেহারা। নাকের দুই পাশ ফুলে গেলো, চোখের কোণা থেকে শুরু করে ঠোঁটের দুই কোণা নিচের দিকে বেঁকে গেলো। মনে হলো বুকের উপর দিয়ে লম্বালম্বিভাবে কেউ ছুরি চালিয়ে ভেতর থেকে হৃদপিন্ডটা টেনে হিঁচড়ে বের করার চেষ্টা করছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। জোরে জোরে শ্বাস নেয়া শুরু করলাম। ফোঁস ফোঁস আওয়াজ বের হচ্ছে বুকের ভেতর থেকে। পাশে থেমে থাকা একটি পুরোনো বাস ধরে দাড়ালাম। কাঁপছি… থরথর করে কাঁপছি। দুই হাতের দিকে তাকালাম। নাহ্ দৃষ্টি ঘোলা হয় নি। কিন্তু হাত দুটো কাঁপছে হিস্টোরিয়া রোগীর মতো করে। কাউকে শাস্তি দেয়া প্রয়োজন। যত রাগ পড়লো হাত দুটোর উপর। দাম করে সর্বশক্তি দিয়ে ঘুষি লাগালাম পাশের একটি পাথরের পিলারের গায়ে। আবার লাগালাম.. আবার… মনে হচ্ছে কাঁধ থেকে হাতটা অবশ হয়ে গেছে। নাক দিয়ে শ্বাস নিয়ে কুলাচ্ছে না। এবার নাক দিয়ে শ্বাস নিয়ে মুখ হাঁ বের করে দিলাম। আস্তে আস্তে রাগটা কমে আসলো। এখন খেয়াল করলাম, অনেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার তামাশা দেখছে।
হাঁটা শুরু করলাম। বাসায় যাবো? না অন্য কোথাও? কিন্তু কই যাবো? আমার বেড়ানো বলতে ওকে নিয়েই….
বাসায় গিয়ে মায়ের পাশ ঘেঁষে বসে থাকলাম। আমার চেহারা দেখে তার সন্দেহ হলো। একবার জিজ্ঞেস করলো ‘কি হয়েছে?’। আমি মাথা নাড়লাম। কিন্তু কষ্ট মাখানো দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। হাজার হোক মা-তো.. আমার ভেতরটা যে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারে। এই বুঝতে পারার ক্ষমতা অন্য কোন মেয়ের হবে না.. কোন মেয়ের না।
অনেকদিন গল্প লিখি না। আবার লিখতে ইচ্ছে করলো। তাই লিখলাম। ভালো লাগলে লাগলো না লাগলে নাই! আমি গল্প লিখি আমার খুশি!

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




