somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দীপা মেহতাঃ ধরার বুকে স্বর্গ

৩১ শে অক্টোবর, ২০০৮ বিকাল ৩:২৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দীপা মেহতা’র নতুন ছবি হেভন অন আর্থ (ধরার বুকে স্বর্গ) 24 তারিখে টরন্টো তে মুক্তি পেল। গাহস্থ্য পারিবারিক নির্যাতন আর স্বদেশ মাতৃভুমি থেকে শিকড় ওপড়ানো নিঃসঙ্গ ইমিগ্রান্টদের নিয়ে দীপার এবারের ছবি।

ছবি শুরু হচ্ছে দারুন রঙ ঝলমলে এক বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে, পাঞ্জাবী তরুনী চান্দ (প্রীতি জিনতা)এর বিয়ের আসর, রঙীন ঘাগড়া আর চোলিতে নাচছে তরুনী মেয়েরা- গালে টোল পড়া হাস্যোজ্জ্বল প্রীতি। আজ তার জীবনের সবচেয়ে খুশীর দিন- তার বিয়ে হচ্ছে কানাডা প্রবাশী পাত্রের সাথে। পাঞ্জাবের লুধিয়ানার এই গ্রামের যে কোন অধিবাসী স্পষ্ট করেই জানে কানাডার জ়ীবন মানেই এক স্বর্গীয় জীবনের নাম।

বিয়ের আসর থেকে প্লেনে- অন্টারিও ব্রাম্পটন এর পিয়ারসন এয়ারপোর্ট তার স্বামীর সাথে তার প্রথম দেখা। দুচোখে নতুন জীবন- নতুন সাথী পাওয়ার স্বপ্ন।তার মিস্টিভাসি স্বামী রকি(ভনস্ ভরদ্বাজ) পেশায় লিমো ড্রাইভার।

অপার সম্ভাবনার সব পেয়েছির দেশ, যেখানে ইচ্ছাগুলো পাওয়ার আনন্দের ডানা মেলা প্রজাপতি। নিশ্চিত সুখ, ভোগ আর একটু বিলাস এই জন্যই তো পরিচিত দেশ-পরিজন, ভাষা সব কিছু পেছনে ফেলে এই বিজন বিভুঁইয়ে- এই প্রতি পদে প্রতিকুলতার মধ্যেও ছূটে আসা। হৃদয় মুচড়ে ভেঙ্গে যাক, অন্ততঃ বৈষয়িক অর্থে হলেও আরামদায়ক একটা জীবন তো আশা করাই যায়। চান্দএর এই পরাবাস্তবিক জীবনের শুরু হয় তার প্রথম দেখা তুষারপাতের উত্তেজনা আর নায়াগ্রার জলপ্রপাতের তীব্র গর্জনের ভেতর দিয়ে। ছোট্ট এক শিখ মন্দিরে যখন বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা চলছে- নতুন পরিবেশে- নতুন জীবনের আরম্ভের প্রান্তে চান্দ এর আবেগ বিহ্বল, উত্তেজনায় মথিত এক মুখচ্ছবি। আমরা দেখতে পাই-তার উজ্জ্বল এক জোড়া চোখের দৃষ্টি।

যদিও তার চারপাশে তাকে ঘিরে আছে সেই ভয়ঙ্কর কানাডীয় শীত-চারদিকে নৈরাশ্যের নীলাভ আলো-নির্মম ঠান্ডার নিঃবান্ধব রুপ আর বোধের অতীত ফ্যাকাশে আলো।
খুব দ্রুত বাস্তব জীবনের মুখোমুখী হতে হয় চান্দ কে, তার আপাত লাজুক মৃদুভাষী স্বামীর এক পুরুষালী হাতের থাপ্পড় যখন আছড়ে পড়ে তার নরম গালে। বদলে যায় তার নির্ভরতার মানুষটি এক অত্যাচারী পুরুষে- সাথে যোগ হয় শ্বাশুড়ী এবং অন্যদের গঞ্জনা আর দুর্ব্যবহার। শুরু হয় চিরচেনা অতি পরিচিত গাহস্থ্য নির্যাতন- নিষ্ঠুর নির্মম শারিরীক অত্যাচার।

অথচ যাবতীয় প্রতিকুলতা ডিঙ্গিয়ে যাবার সব ধরনের প্রস্তুতি কিন্ত চান্দের ছিল। তার গ্রাজুয়েট ডিগ্রির তোয়াক্কা না করে সে কাজ নেয় লন্ড্রীতে- আপ্রান চেষ্টা করে অদ্ভুত বিজাতীয় সেই পরিবেশে মানিয়ে নিতে। এর পরেও সে অবাক হয় না যখন তার এই উপার্জনের পুরোটাই চলে যায় তার স্বামীর একাউন্টে।

চান্দের স্বামী রকিও আসলে পরিস্থিতির শিকার- তার সীমিত আয়ের সংসারে ৭জনের পরিবার চলে- তাদের একচিলতে দু বেডরুমের এ্যপার্টমেন্ট- অথচ রকি পয়সা জমায় তার পরিবারের বাকী সদস্যদের দেশ থেকে আনানোর জন্য। তার আপাত ব্যার্থতা, আর আর্থিক টানাপোড়েন জনিত নিস্ফল আক্রোশ আর ক্রোধের শিকার হতে হয় চান্দ কে।

নারীর প্রতি এই ধরনের শারিরীক অত্যাচার কে উপজীব্য করে বলিউডে ফি বছর প্রচুর মুভি হয়। তার একাংশে নারীকে শেষ পর্যন্ত দেখানো হয় হান্টার ওয়ালী হিসাবে-যে হঠাৎ করে ফিরে পায় অসীম শক্তি আর সাহস, তারপর প্রতিশোধের পালায় এক এক করে………

হেভন অন আর্থ এ আমরা সে সব কিছু দেখতে পাই না- দীপা বলছিলেন মজা করেই –আমি আসলে বক্সিং গ্লাভস হাতে কোন জেনিফার লোপেয (এনাফ) কে দেখাতে চাইনি! এ ধরনের ছবিতে অনেক বাড়াবাড়ি (এনাফ) দেখানো হয়। আমি সে গন্তব্যে যেতে চাইনি।

তাহলে হেভন অন আর্থ কিসের ছবি? দীপা আমাদের জানাচ্ছেন বউ পেটানো কোন বিশেষ সমাজ বা জনগোষ্ঠীর বিশেষত্ব নয়। দেশ জাতি নির্বিশেষে কম বেশি সর্বত্র এটা দেখা যায়।

ফলে তার ছবি বউ পেটানোর মতো সরল বিষয় হিসাবে ব্যাখা করা যাবে না।

দীপার ছবি ‘হেভন অন আর্থ’ হল বিচ্ছিন্নতার ছবি।বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানুষের নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়ার ছবি। সমাজ-স্বদেশ-পরিবার-নিজস্ব পরিবেশ থেকে আগত এক এক জন নারী কিভাবে ক্রমশঃ আলগা হয়ে যায়, সমস্ত কিছু থেকে নিজকে গুটিয়ে নিতে নিতে এক সময় একদম একলা হয়ে যায়। কারও সাথে সে নিজকে জুড়তে পারে না, পারে না কাউকে আকঁড়ে ধরতে।

প্রাচ্যের এই রক্ষনশীল পরিবার গুলোর সমস্যা নিয়ে সোস্যাল সার্ভিসের এজেন্সিগুলোও মোটেই ওয়াকেবহাল নয়। আমাদের বিরাজমান রাষ্ট্রীয়-সামাজিক তথা প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে থেকে আমরা সর্বতোভাবে, সম্পুর্ন রকম উদাশীন- আমরা জানিনা আমাদের লক্ষ্য কি, আমাদের কর্তব্য কি, কি বা আমাদের করনীয়!! আমাদের সোস্যাল ওয়ার্কারদের সার্ভিস কিংবা এমাজেন্সী ৯১১ (এমাজেন্সী পুলিশ অথবা এ্যম্বুলেন্সের জন্য টেলিফোন নাম্বার)এ কল করা আর যথেষ্ট নয়- আমাদের এই ব্যাক্তিগত সমস্যা থেকে রেহাই পেতে।

প্রতি বছর অনুন্নত দেশ গুলো থেকে লক্ষ লক্ষ যে ইমিগ্রান্ট এদেশে আসে- এরপর তাদের কি পরিনতি হয়- কি ধরনের পরিস্থিতি-অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে তাদের চলতে হয়- রাষ্ট্র তার কতটুকু খোঁজ রাখে? কতটুকু দায়ীত্ব পালন করে? একবার তাদের এখানে এনে মুল জনস্রোতে মিশিয়ে দেবার পর আমরা ভাবি আমাদের দায়ীত্ব শেষ। আমরা আমদের হাত একদম যেন ধুয়ে ফেলি।

দীপার সর্বশেষ ছবি ‘হেভন অন আর্থ’ হল আসলে এদেশের সেই সব লক্ষ্ লক্ষ্ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ইমিগ্রান্ট-মানুষদের নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়ার ছবি।


সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০০৮ বিকাল ৩:৪৫
৮টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখনো নদীপারে ঝড় বয়ে যায় || নতুন গান

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২০

এ গানের লিরিক আমাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। ২৪ বা ২৫ এপ্রিল ২০২৪-এ সুর ও গানের প্রথম কয়েক লাইন তৈরি হয়ে যায়। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি অন্য একটা গান নিয়ে। সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×