somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

খেয়াল বলে কথা!

২৯ শে জুলাই, ২০১০ রাত ৮:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছোটবেলা মাই হবিজ রচনা পড়েছিলাম বোধ হয় দুই একবার। কিন্তু তখন নিজের শখ বলতে কিছু হয়ে উঠে নি। সেই গত বাঁধা বাগান করা আর স্ট্যাম্প কালেকশন নিয়েই লিখে দিয়ে আসতাম। কিন্তু একটু বড় হচ্ছিলাম যখন, তখন কত শত সব শখ মাথায় চেপে বসা শুরু করলো এক একবার। ক্লাস সিক্স থেকে ছুটিতে কখনও বোরড হই নি! সেই বছরে ছুটিতে মাথায় ঢুকেছিল এম্ব্রয়ডারী করব। একটা লাল টুকটুকে সূতীর সালওয়ার কামিজে ফ্রেইম লাগিয়ে হালকা সবুজ শেইডের সূতা দিয়ে টুকটুক করে সূক্ষ্ম একটা কাজ করে ফেললাম। কে বলবে এর আগে কখনও এম্ব্রয়ডারী করি নি! কয়েকটা সোফা ব্যাগ আর ট্রাপেস্ট্রিও করে ফেললাম ঝটপট। তরপর অবশ্য আর কখনও সূইয়ে সূতা লাগাই নি…

বইয়ের নেশাটা মোটামোটি কনস্ট্যান্ট। বই আমার শুধু পড়লে চলে না। কোন বই খুব ভালো লেগে গেলে সেটা কিনে নিজের কালেকশনে রেখে দেই। আর ছবি আঁকা শুরু করে তো রীতিমত দুই সপ্তাহের ক্লাসও করে ফেললাম। আঁকলাম যতদিন, খারাপ আঁকি নি। কিন্তু যখন বুঝলাম ছবি আঁকতে কি পরিমান ধৈর্যের দরকার হয়, তখন আঁকার সরঞ্জামগুলোর ব্যবহার আস্তে আস্তে কমে গেল…

এম্ব্রয়ডারী গেল, কিন্তু মেশিনে সেলাই করে জামা কাপড় বানানো পুরাপুরি অন্যরকম ব্যাপার স্যাপার। কত হিসাব কিতাব আছে! আবায়া পরা শুরু করার ইচ্ছা করার পর থেকে খেয়াল করলাম পছন্দসই আবায়াগুলো ভীষণ দামী! এত দাম দিয়ে কে কাপড় কিনে? আমি কখনই কিনবো না--এই মর্মে প্রতিজ্ঞা করে কাপড় কিনে, প্যাটার্ন কিনে, দিন রাত সেলাই করতে নেমে গেলাম। একে একে বানিয়ে ফেললাম আবায়া, স্কার্ট, সালওয়ার-কামিজ--সব মিলিয়ে পনেরোটা আইটেম হবে হয়তো! বাসা বদলানোর সময় খাটের নিচ থেকে একটা সেলাইয়ের খাতা উদ্ধার করলাম, পাতায় পাতায় কত ভেবে চিন্তে আঁকা সব ডিজাইন! বলাই বাহুল্য এখানেও ধৈর্যের পরীক্ষা টের পাওয়ার পরই পনেরতম আইটেমের পরে খাতাটা খাটের নিচে ঢুকেছে… এখন ডিজাইন নিজে করলেও দর্জি ছাড়া উপায় দেখি না!

গানের খাতা পেলাম দুইটাগুলো। কত গান শিখেছি এক সময়ে! যখন বুঝতে পেরেছি মিউজিকের থিওরী না বুঝে গান খুব ভালো গাওয়া যায় না, ভুল ভাল রয়েই যাবে, তখন ইন্টারনেট ঘেটে ঘেটে মিউজিকের থিওরীও পড়ে গেলাম কত দিন!

আমার ব্রাউজারের ফেভরিটসে এখনও ইন্দোনেশিয়ান ভাষা শিক্ষার বেশ কয়েকটা পৃষ্টা জমানো আছে। দু্ই বছর ধরে আছে ওগুলো। যদিও আমার ইন্দোনেশিয়ান 'নামা সায়া সন্ধ্যা' (আমার নাম সন্ধ্যা) পর্যন্তই ঠেকে আছে কিন্তু এখনও ওই শখ বাতিলের তালিকায় রাখি নি! ঠিক করে রেখেছি, সুযোগ আসলেই শিখে নিব। আরবি তো সেই কবে থেকেই শিখছি… কত কিছু ডাউনলোড করলাম, কত প্ল্যান নিলাম। আমার সুদীর্ঘ এবং অগোছালো অধ্যাবস্যায়ের ফলাফল হিসেবে অবশেষে জানি সজারাতুন মানে গাছ আর রজালুন মানে লোক!

রান্না বান্না বরাবরই ভালো লাগে। মাশরুম স্যুপ আপাতত আমার স্পেশালিটি আর সর্বশেষ এক্সপেরিমেন্ট ছিল থাই স্যুপ! ছবি তোলা আর ঘুরাঘুরি নিয়ে নাই বললাম, এই দু'টো শখ মনে হয় কখনও যাবে না! এগুলো খেয়াল না বলে শখ বলা যায়!

কিন্তু আমার সর্বশেষ খেয়ালটাকে খেয়ালই বলতে হবে মনে হয়! বেশ কয়েকদিন ধরেই দেখছিলাম নও ওর মোটা মোটা বইগুলো আমাদের পিচ্চি টেবিলটায় যুতসই ভাবে ছড়িয়ে বসতে পারছে না। কখনও মাটিতে বসে, কখনও বিছানায় বসে পড়ছে। তারপর একদিন হঠাৎ ও রুমে নেই।এদিক ওদিক খুঁজে ওকে আবিষ্কার করলাম গ্যারাজে। গ্যারাজের জঙ্গল থেকে আমাদের অতি প্রাগৌতিহাসিক ডাইনিং টেবিলটা উদ্ধার করে ওখানেই বসে বসে পড়ছে! টেবিলটা অনেক হাত ঘুরে আমাদের কাছে এসেছিল। কাঠের টেবিল কিন্তু টেবিলটার উপর এত অত্যাচার গিয়েছে যে এখন আর কাঠ বুঝা যায় না। এখানে সেখানে খাবলা খাবলা রং উঠা। যেটুকুতে রং উঠেনি, সেটুকুতে আবার স্টিকারের খাবলা খাবলা দাগ। কোন এক দুষ্ট পিচ্চির মালিকানাধীন ছিল নিশ্চয়ই টেবিলটা। নও ঘোষণা করে বসলো সেই টেবিলটাতেই ও এখন থেকে পড়বে… একটা টেবিল ক্লথ লাগিয়ে নিলেই দারুন হবে। আমার এত মায়া লাগলো বেচারার জন্য, ভাবলাম, চুপিচুপি একটা বড় টেবিল কিনে ওকে সারপ্রাইজ গিফট দেই। ওমা, ইন্টারনেটে বড় টেবিলের দাম দেখতে গিয়ে মাথায় বাড়ি! পছন্দসই টেবিলের দাম পাঁচশ+ অস্ট্রেলিয়ান ডলার‍! মাথা খারাপ! রাগ করে ব্রাউজার বন্ধ করে দিলাম।

তারপর গ্যারাজের টেবিলটা হাতিয়ে দেখতে দেখতেই আইডিয়াটা মাথায় আসলো। ওই টেবিলটাই সিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষে বার্নিশ করে দিলে কেমন হয়?! একটা বড় টেবিল কিনে গিফট করার চেয়ে নিজ হাত বার্নিশ করে দিলে নও নিশ্চয়ই অসম্ভব খুশি হবে! এই ছেলেটাকে মুগ্ধ করতে আমার খুবই ভালো লাগে।

আইডিয়াটা আমার কাছে দারুণ লাগলেও বাসার প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ এবং বিচক্ষন মন্ডলীর কারও পছন্দ হলো না। 'এত বড় টেবিল সিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষিয়ে রং উঠানো খেলা কথা নাকি?' 'মাঝপথে ছেড়ে দিবা, তখন আরও বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার হবে, এটা ধরার কোন দরকারই নাই।' 'টেবিল ক্লথ দিয়ে ঢেকে নিলেই হয়ে যাবে, এত কষ্ট করে কে?' 'নতুন একটা কিনে নাও, কাঠেরই কিনতে হবে এমন কোন কথা আছে?' ইত্যাদি ইত্যাদি নানা নেগেটিভ কথা বলে সব সেক্টর থেকে বিপুল পরিমানে নিরুৎসাহিত করা হলো।

কিন্তু খেয়াল বলে কথা!

একদিন দুপুর বেলা যখন বাসায় কেউ ছিল না, তখন ঘন্টা খানেক সিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষে নিলাম টেবিলটা। প্রথম প্রথম শখের ঠেলায় খারাপ লাগছিল না, কিন্তু এক ঘন্টা পরে হাত পাথরের মত ভারি, অথচ টেবিলের এক চতুর্থাংশও হয় নি!

কি যে মন খারাপ হলো!

কিন্তু শুরু যখন করেই দিয়েছি, থামি কি করে, কোন মুখে? জেদ চেপে গেল খুব। দোকানে গিয়ে তিরিশ ডলারে সিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষার মেশিন কিনে আনলাম। ভাবলাম, মেশিন শুধু রাখব আর হয়ে যাব। ব্যাস, সোজা কাজ! ওমা, মেশিন ছাড়তেই দেখি মেশিন তীব্র বেগে নড়ছে! এই প্রচন্ড বেগে নড়তে থাকা মেশিনটাকে দুই হাতে শক্ত করে ধরে এক জায়গায় স্থির রাখতে হয়, এবং একই সাথে মেশিনটা ধরে টেবিলের গায়ে চাপ দিতে হয়, এবং তার সাথে সাথেই সামনে পিছনে ঘষতে হয়! এক সাথে তিনটা ভিন্ন ডিরেকশনের শক্তি নিয়ন্ত্রন করতে গিয়ে প্রচন্ড শক্তি লাগে! তবু প্রচন্ড জেদ নিয়ে টানা তিন ঘন্টা করে গেলাম যুদ্ধ! যুদ্ধ শেষে সারা ঘরে গুড়া গুড়া ধূলা। আমার দুই বাহু খুলে চলে আসে আসে এমন ভাব। কিন্তু টেবিল?

রঙ-মুক্ত! :)

এরপরের কাজটুকু সোজা ছিল। বার্নিশ লাগানো হয়ে গেলো দুই দিনেই। রং শুকানোর পর আমি নিজেই মুগ্ধ! বাসার প্রাজ্ঞ, অভিজ্ঞ এবং বিচক্ষনমন্ডলীও ভূয়সী প্রশংসা করলেন এবং স্বীকার করে নিলেন তারা আমার খেয়ালকে ভীষণ রকমের আন্ডারএস্টিমেইট করেছিল :)

আর নও তো পুরাই ধরা! :))

আজকে যখন দেখলাম নও বইটই ছড়িয়ে পড়তে বসেছে সদ্য পাওয়া উপহারে, তখন মনটাই ভরে গেল! আর মনে হলো, যাক, রিসার্চ থেকে মন উঠে গেলেও না খেয়ে মরতে হবে না, কাঠমিস্ত্রীগিরি ক্যারিয়ার হিসেবে নিলেও মনে হয় খারাপ করব না :)

(ছবিগুলো: বার্নিশের পরে (১ ও ৩), রং উঠানোর মাঝামাঝি সময়ে (২) এবং রং উঠানোর প্রায়ে শেষের দিকে (৪)।)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুলাই, ২০১০ রাত ৮:৩১
১৩টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×