পাশের সিটে মা এর মাঝে ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুমাবেই যখন তাহলে আমাকে কেন জানালার পাশে বসতে দিলো না! জানালার পাশে না বসলে জার্নি করে মজা আছে নাকি!!
থাক! মা - ই তো!
ইশ! ছোট্টোবেলায় এই আম্মুকেই কত্তো ভয় পেতাম!
প্রতিদিন সকালে বাবা অফিসে আর মেজচাচা ভার্সিটি চলে যাওয়ার পর আম্মু আমার আগের দিনের ‘আমলনামা’ নিয়ে বসতো। সামনে সকালের নাস্তা আর ডিম! :-&
আর হাতে তার বিখ্যাত ‘ডালঘুটনি’!
এর প্রয়োগ অবশ্য করতে হত না। এর অতি সুদর্শন আকৃতি-ই ছিল আমার ভয়ের কারন। বলতে গেলে ‘কাউন্ট ড্রাকুলা’ র জন্য ‘ক্রুস’ আর আমার জন্য ‘ডালঘুটনি’ সমার্থক ছিল ।আম্মুর মতে , " 'ডালঘুটনি' হাতে নিয়ে তোকে কাঁচা ডিম দিলে পারলে তুই সেটাও কোঁৎ করে গিলে ফেলতি"।
অবশেষে একদিন সেই ‘ডালঘুটনি’ থেকে পরিত্রানের উপায় খুঁজে বের করলাম....................
তখন আমরা কলেজরোডের কবরস্থানের কাছে একটা বাসায় থাকি। তিনতলা বাসাটার দুইতলায় থাকি আমরা আর তিনতলায় বাড়িওয়ালা ।বাসার পিছন দিকে ছিল ছোটো পুকুর.........না...আসলে ডোবা বললেই ঠিক হবে।
জগতের কতিপয় ‘লক্ষী’ বাচ্চাদের মত আমারও তখন জানালা দিয়ে যাবতীয় দরকারী জিনিস ফেলে দেয়ার অভ্যাস হয়েছিল। প্রথম দিকে শুধু নিজের শখের ‘টেডি বিয়ার’ টা সামনের বারান্দা দিয়ে ফেলে দিতাম। কাজটা অবশ্য করতাম আম্মুর অগোচরে । কিন্তু বাঁধ সাজলো বাড়িওয়ালা আঙ্কেল ! প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার সময় উনি বাসার সামনে থেকে ‘টেডি’ টা কুড়িয়ে এনে দেন আর একটু রাগ দেখিয়ে বলেন
- “ বুড়ির কান্ড দেখ! আবার এইটারে ফেলে দিলো! আমি কী তোর পুতুল কুড়ানোর জন্য আছি নাকি? আর কোনো কাজ নাই আমার !!”
বলে আমার টেডি আমার কোলে ফিরিয়ে দিয়ে যান। ব্যাপারটা আর আম্মুর অজানা রইল না।
কাজেই এই দিকে আর সুবিধা করতে না পেরে আমি বাড়ির পিছন দিকের আশ্রয় নিলাম... সেই ডোবা-র। আম্মু একটু অন্যদিকে গেলেই রান্নাঘরের জানালা দিয়ে পিছনের সেই ডোবায় আমার ছোট ছোট খেলনা আর বাসার টুকটাক জিনিস ফেলে দেই। কেউ আর টের পায় না জিনিসপত্র কই যায়!
এই সুযোগে একদিন আমার চক্ষুশূল ‘ডালঘুটনি’ও গায়েব করে দিলাম!!
কিন্তু, কেন জানি এরপর আর কারো বুঝতে বাকি রইল না জিনিস কই যায়... আর কিভাবে যায়!!:-<
ফলস্বরুপ, মা বাসায় নতুন দুইটা ‘ডালঘুটনি’ আনলেন... একটা আসল ডাল ঘুটার জন্যে, আরেকটা আমাকে ঘুটার জন্য!!
আমার চোখে তখন মা এক “নিষ্ঠুর/পাষাণ/হৃদয়হীন” নারী।কিন্তু তারপর ও কেন জানি মা-কে ছাড়া এক মূহুর্ত চলতো না আমার। সেই জন্যই মা যে স্কুলে টিচার ছিলেন সেই কিন্ডার গার্টেন স্কুলেই ক্লাস ‘নার্সারী’তে আমাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন।
আমি আবার বছরের মাঝের দিকে ভর্তি হয়েছিলাম ।স্কুলে প্রথম দিন আর ক্লাস করিনি। ভর্তি হয়ে বাসায় চলে গেলাম। মা বিকালে মার্কেট থেকে আমার জন্য নতুন টিফিন বক্স , পেন্সিল বক্স, স্কুল ব্যাগ নিয়ে এলেন। আর আলমারি থেকে বের করে দিলেন আমার বহুদিনের কাঙ্খিত সেই ‘ওয়াটার বোটল’ যার চেহারা অনেকটা রোবটের মতো, আর মাথা খুললে পানি খাওয়ার স্ট্র বের হয়ে আসে। আমার এক চাচা সেটা দিয়েছিলেন। স্কুলে ভর্তি হলে পরে মা আমাকে সেটা ব্যবহার করতে দিবেন বলে আলমারিতে রেখে দিয়েছিলেন।
পরদিন মহানন্দে আমি নতুন নতুন জিনিস নিয়ে স্কুলে গেলাম। ক্লাস টিচার আম্মুর কলিগ আর ভাল বন্ধু। ম্যাডামের ছেলেও এক-ই ক্লাস এ। ম্যাডাম তাই ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব করিয়ে দিলেন।
টিফিন পিরিয়ডে আমার নতুন বন্ধুটি এসে আমার সেই রোবট-মার্কা ‘ওয়াটার বোটল’ দেখে বলে,
- “আমি তোমার ফ্লাস্ক টা থেকে পানি খাবো”
- “তুমি পানি আন নাই আজকে?”
- “আনসি...কিন্তু তোমারটা থেকে দিতে অসুবিধা কি?”
- “আচ্ছা... দেই...তুমি তোমার ফ্লাস্ক এর মুখটা নিয়ে আসো...আমি পানি ঢেলে দেই”
- “না! আমি তোমার ফ্লাস্ক এর স্ট্র দিয়েই খাবো। ”
ভালো মুশকিলে পড়ে গেলাম। একে তো আমি কেউ কিছু মুখে দিলে আর সেটা খাই না।।তার উপর আবার প্রিয় ফ্লাস্ক- এর স্ট্র মুখে দিতে চায় এই ছেলে।(যেখানে নিজের ফ্লাস্ক-ও ঠিক-ই নিয়ে আসচে সে )
তবুও আমি তাকে ভালভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম,
- “কিন্তু, একজনের স্ট্র দিয়ে আরেক জনের খাওয়া তো ঠিক না...আমার কিন্তু টনসিল হইছে, পরে তোমারও টন্সিল হয়ে যাবে”
- “উহু! কিছু হবে না। আমারও টন্সিল আগে থেকেই আছে।”
এইবার আমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। মুখ শক্ত করে বললাম
- “আমার স্ট্র তে কেউ মুখ দিলে আমি সেটা দিয়ে আর খাই না, আমার ফ্লাস্ক থেকে পানি খেতে হলে ঢাকনিতে ঢেলেই খেতে হবে। আর তোমার তো ফ্লাস্ক আছেই, যাও নিজের ফ্লাস্কের স্ট্র দিয়ে পানি খাও গিয়ে”
ব্যাস......সাথে সাথে বলতে লাগলো,
-“ছিঃ! তুমি এত্তো পঁচা......কেউ পানি চাইলে দাও না ।”
আমি তো অবাক! আমি আবার পানি দিব না বললাম কখন!
কিন্তু ও এর মাঝে ক্লাসের অনেককে নিয়ে দল বানিয়ে ফেললো। ওদেরকে কি বলেছিল সে-ই জানে। সবাই ভাবলো আমি বুঝি আসলেই ও-কে পানি দিবো না বলেছি। আমি আমার পক্ষে কিছু বলার আগেই সব কয়টা ক্লাস রুমের বাইরে জটলা করে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ফিরে বলল।
- “তোমার সাথে আমরা কেউ মিশবো না, তোমার সাথে আমাদের আড়ি”
বলে সবাই তাদের একহাত মুঠ বন্ধ করে বুড়া আঙ্গুল নিজের থুতনির আছে এনে আড়ি দেয়ার বিশেষ ভঙ্গিতে একযোগে বলতে লাগলো,
- “ আড়ি আড়ি আড়ি
কাল যাবো তোর শ্বশুর বাড়ি
পরশু যাবো ঘর
হনুমানের লেজ ধইরা
টানাটানি কর”
এই বলে তারা সকলে আমাকে হনুমানের লেজ ধরে টানাটানি করার পরামর্শ দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। আর আমি হাঁদারামের মত সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। সমস্ত ব্যাপারটা কি ঘটল বুঝতে আমার মিনিটখানেক লেগে গেলো। ততোক্ষনে কে কাকে পায়!!
সেদিন আমি স্কুলের পড়ার পাশাপাশি দুইটা নতুন জিনিস শিখলাম।
১. আড়ি দেয়ার নতুন স্টাইল।
২. “আড়ি আড়ি” ছড়াটা ।
এটাই ছিল আমার জীবনে প্রথম কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্ধুত্বের অভিজ্ঞতা!!
ধুর!! আম্মু এখনো ঘুমাচ্ছে । এভাবে বাসে কোনো কথাবার্তা ছাড়া বসে থাকতে থাকতে তো বোর হয়ে গেলাম।
(আরো চলতে পারে...)
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ডিসেম্বর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৭:৩১