
আসমানী দরদর করে ঘামছে। একটু পরেই তার ইন্টারভিউর ডাক আসবে। এই পর্যন্ত কম করে হলেও ২৫টা ইন্টারভিউ দিয়েছে সে, কিন্তু তবুও ইন্টারভিউ পূর্ববর্তী বুক ধুকপুক করা ভয়টা কাটানো এখনো শেখা হয়ে উঠেনি তার। “ঘেমে মুখের অবস্থা খারাপ, মুখটা একটু মুছে নেয়া দরকার”, এটা ভেবে যেই না ব্যাগে হাতটা ঢুকালো টিস্যু পেপার খুঁজতে, ঠিক তখন রিসিপশনের মেয়েটা তার নাম ধরে ডাকল, “আসমানী হোসেন, এখন আপনি যান।” আসমানী হোসেন !! কি ক্ষ্যাত একটা নাম। আজকালকার মেয়েগুলোর নাম কত সুন্দর সুন্দর হয়, আর বাবা-মা কিনা নাম খুঁজতে গিয়ে পেল আসমানী !! এসব ভেবে মনে মনে আরো একবার নিজের নামকরণের ব্যর্থতার জন্য বাবা-মার উপর খানিকটা রাগ করে ফাইলটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো আসমানী। মনে মনে দোয়া ইউনূস পড়তে পড়তে ইন্টারভিউ বোর্ডের রুমটার দিকে হেঁটে যেতে লাগলো।
- আপনি আসমানী হোসেন?
-জ্বি স্যার।
-হুম...বাসা কোথায়?
-রামপুরা।
-আপনার রেজাল্ট তো দেখছি খুব একটা ভাল নয়। পড়াশোনায় মনোযোগ ছিল না নাকি?
(আসমানী এমনিতেই খুব ভীতু মেয়ে, অল্পতেই ঘাবড়ে যায়। একথা শুনে তার গলা শুকিয়ে গেল। তার মনে একটা কথাই আসলো, “আচ্ছা এনারা কি আমাকে এক গ্লাস পানি খেতে দেবেন??”)
-স্যার পানি খাব।
অফিসের এমডি হাসান সাহেব হেসে দিলেন। জীবনে অসংখ্য মানুষের ইন্টারভিউ নিয়েছেন তিনি। এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণে তিনি ২ মিনিট দেখেই বুঝে ফেলতে পারেন যে কোন মানুষটাকে কেমন প্রশ্ন করে ভড়কে দেয়া যাবে। আর এই ব্যাপারটা একবার বুঝে ফেলতে পারলে ঠিক সেই কাজটাই করেন। মানুষকে ভড়কে দিইয়ে বিপুল আনন্দ পান তিনি। এই মেয়েটা এখনি ভয় পেয়ে পানি খেতে চাইবে এটা বুঝার জন্য তাকে খুব বেশি চিন্তা করতে হয়নি। আসমানী এখন নিজে থেকে পানি না চাইলে হাসান সাহেবই তাকে জিজ্ঞেস করতেন পানি লাগবে কিনা। আসমানীর সামনে বেয়ারা এসে পানির গ্লাসটা দেয়া মাত্র আসমানী ঢক ঢক করে পুরো গ্লাস পানি শেষ করে ফেললো। তারপর জড়সড় হয়ে বসে রইলো।
-তা আপনি কম্প্যুটারের কাজ কেমন জানেন?? টুকটাক দরকারী সফটওয়্যারগুলো চালাতে পারেন তো?
-কিছুটা পারি স্যার। প্রয়োজন হলে বাকিটাও শিখে নিতে পারবো।
-আচ্ছা। তা আপনার টাইপিং স্পিড কেমন?
-স্যার মোটামোটি।
-মোটামোটি দিয়ে তো হবে না। যে পোস্টের জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন সেই পোস্ট এ চাকরী করতে হলে টাইপিং টা ভাল জানা খুব দরকার। যাই হোক, বলুনতো GDP মানে কি?
-Gross Domestic Product.
-হুম...very good !! এবার বলুন, একটা প্রোডাক্ট এর চাহিদা বা বিক্রি বাড়ানোর জন্য কোন জিনিসিটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ??
-স্যার, প্রোডাক্ট এর ভাল গুণগত মান নিশ্চিত করাটা সবচেয়ে জরুরী।
-নাহ। হল না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি হল মার্কেটিং, বুঝলেন !! পাবলিককে ভোলানোর মত মার্কেটিং করতে পারলে পঁচা বল সাবান ও পাবলিকের কাছে হয়ে যায় সেরা বল সাবান, বুঝলেন??
-জ্বি স্যার, বুঝেছি।
-আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি এখন যেতে পারেন।
-থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, স্লামালিকুম।
আহ !! কি শান্তি!! ইন্টারভিউ বোর্ড থেকে বের হবার পর আসমানীর প্রথম রিএকশন থাকে এটাই। তার মনে হয় যেন জেলখানা থেকে মুক্তি পেল সে মাত্র!! নিজেকে এখনো মাঝে মাঝে বুঝে উঠতে পারে না আসমানী। এতগুলো ইন্টারভিউ দেয়ার পরও কেন তার ভয়টা এখন কাটল না?? অফিস থেকে বের হয়েই বাইরে থেকে প্রথমে এক গ্লাস ঠাণ্ডা আঁখের রস খেয়ে নিল সে। খাওয়া শেষ করে নিজের মনেই বলে উঠলো, “আহ ভিতরটা একদম ঠাণ্ডা হয়ে গেল !!” ঘড়ির দিকে একটু তাকালো সে, ২টা বেজে গেছে। নাহ, এখন আর ঘোরাঘুরি না, বাসায় যাওয়া দরকার, মা নিশ্চয়ই এখনো না খেয়ে বসে আছে। রিক্সার খোঁজে সামনের দিকে তাকালো আসমানী।
-এই রিক্সা যাবেন??
-কই যাইবেন?
-রামপুরা...পশ্চিম রামপুরা।
-যামু...৪০ ট্যাকা দেওন লাগবো কিন্তু।
-ঠিক আছে, চলেন।
বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় আড়াইটা বেজে গেল। রিক্সা ভাড়াটা মিটিয়ে দিয়ে বাসায় ঢুকতে গিয়ে মনটা কেমন যেন করে উঠলো আসমানীর। বাসায় ঢোকার পরই মা, বাবা, ছোট বোনটার সেই প্রশ্নের জবাব দিতে হবে...যে প্রশ্নটার জবাব দিতে দিতে সে ক্লান্ত। “ইন্টারভিউ কেমন হয়েছে??” নাহ, আসলেই আর সহ্য হয় না। আর কত?? কতবার এই একটা প্রশ্নের জবাব দেয়া যায়, আর সেই আশা করে রাখা মানুষগুলোর আশাকে ভেঙ্গে দেয়া যায়। হয়তো রেজাল্ট খুব বেশি ভাল না তার, হয়তো খুব বেশি স্মার্টও না সে। কিন্তু তাই বলে কি এতটাই খারাপ যে ২ বছর চেষ্টা করে যাবার পরও রিটায়ার্ড বাবার পেনশনের টাকার কষ্টে-সৃষ্টে চলা সংসারটাকে একটু স্বস্তি দেবার মত বেতনের একটা চাকরিও সে পাবে না? কই? অন্যদেরতো এমন হয় না। তার সাথেই পড়তো একটা বোকামত ছেলে, রফিক নাম, পড়াশোনায় তার চেয়েও খারাপ ছিল, দেখতে-শুনতেও একদমই গোবেচারা টাইপ, সেই ছেলেটাও তো গতবছর একটা ছোট্ট প্রাইভেট ফার্মে চাকরী পেয়ে গেল। তার এক ক্ষমতাবান চাচা আছে, যে চাকরীটা তাকে পাইয়ে দিয়েছে। আসমানীর কোন ক্ষমতাবান চাচা নেই, আসলে চাচা-মামা কেউই নেই, যে তাকে একটা চাকরী পাইয়ে দিতে পারে রফিকের মত করে। আচ্ছা তাহলে এটাই কি তার ব্যার্থতা ?? কি জানি! হয়তো এটাই! এরকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কেন জানি বাসায় ফেরার ইচ্ছেটা উবে গেল আসমানীর। নাহ, আর ভাল লাগে না বাসায় গিয়ে সবার মুখে আশামাখা হাসিটা দেখতে, যেখানে আশা পূরণের আলোর কোন দেখাই পায়নি আসমানী বরাবরের মত। বাসার পাশের রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে মেইন রোডে উঠে গেল আসমানী। শহুরের রাস্তার ব্যস্ততার মাঝে নিজেকে খানিকের জন্য হারিয়ে ফেলার ক্ষুদ্র ইচ্ছায়। আর হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে নিজেকে প্রস্তত করতে লাগলো আরেকটা পরীক্ষার জন্য, পরের ইন্টারভিউটার জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:১৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



