এখনো মনে আছে, ছোটবেলায় সপ্তাহের একটা বিশেষ রাতে বাসার সবাই টিভি খুলে মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে থাকতাম। কারণ?? কারণটা কখনও ছিল “কোথাও কেউ নেই” এর বাকের ভাই ও মুনা, কখনও “এইসব দিনরাত্রি” –র ছোট্ট টুনি, কিংবা “আজ রবি বার” এর আনিস ভাই এর মুখে “তিতলি ভাইয়া, কঙ্কা ভাইয়া” শোনা। এত সুন্দর নাটক বাংলাদেশে আর কখনও হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না।
৯৮ এর বইমেলা...তখন ক্লাস ফোরে পড়ি আমি। মেলা থেকে আব্বু হুমায়ূন আহমেদ নামের একজন লেখকের একটা বই কিনে দিল, জানলাম এই লোকটাই নাকি ওই সুন্দর সুন্দর নাটকগুলা লিখেন। বাসায় এসে সেদিন রাতে “বোকা দৈত্য” নামে একটা গল্প পড়লাম সেই বই থেকে। গল্পটা পড়ে অনেক্ষণ কেঁদেছিলাম ওই বোকা দৈত্যটার জন্য। খুব ভাল করে মনে আছে এখনও, তারপর আর একটুও থামিনি। একটানে সবগুলো গল্প পড়ে শেষ করেছিলাম বইটার। কখনও কোন গল্প পড়ে হাসতে হাসতে পেট ব্যথা করে ফেলেছি, কখনও কখনও কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছি। আর অবাক হয়ে ভেবেছি, এত সুন্দর গল্পও হয়! সেই থেকে শুরু। প্রতি বইমেলায় দু’হাত ভর্তি করে হুমায়ূন আহমেদ নামের সেই লোকটার বই কিনে ঘরে ফেরা। আর সেই বইগুলোর সাথেই ধীরে ধীরে আমার বড় হওয়া। “সূর্যের দিন”, “একি কাণ্ড”, “বোতল ভুত” এর মত অসংখ্য সুন্দর কিছু উপন্যাস এর সাথে বন্ধুত্ব করে কেটেছে আমার কৈশোর। আর এরপর একদিন “এবং হিমু” নামের একটা বই পড়ে হিমু নামক অদ্ভুত ছেলেটার প্রেমে পড়ে যাওয়া! সেই প্রেম এখনও কাটেনি। এখনও হিমুর কোন বই বের হলে সেটা না পড়া পর্যন্ত মনে হয় যেন নিঃশ্বাস আটকে আছে। আর প্রতিটা বই শেষ করে একবার আফসোস করি, আমি কেন রূপা না?? আবার কখনও শুভ্রর সারল্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যাই, কখনও মিসির আলীর critical reasoning দেখে অবাক হয়ে যাই। কত ভিন্ন চরিত্রগুলো একটা আরেকটা থেকে। অথচ প্রত্যেকেই কত জীবন্ত। আর প্রিয় উপন্যাসগুলোর নাম বলা শুরু করলে তো শেষই করতে পারব না। নন্দিত নরকে, সমুদ্র বিলাস, বহুব্রীহি, মন্দ্রসপ্তক, কোথাও কেউ নেই, চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস, পোকা, তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে, মেঘ বলেছে যাব যাব, কবি, শ্রাবন মেঘের দিন, কে কথা কয়, লীলাবতী, রুমালি, আমার আছে জল, আকাশ জোড়া মেঘ, সাজঘর, জনম জনম, জোছনা ও জননীর গল্প, তার নিজের জীবনের গল্প নিয়ে সাজানো সবগুলো বই...কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি আমি?? এতগুলো নাম লেখার পরও মনে হচ্ছে কিছুই লিখিনি। এই বইগুলো আমার জীবনের অনেক বড় একটা অংশ। অনেকবার নতুন করে জীবনকে শিখেছি, জেনেছি, বুঝেছি উনার বই পড়ে। ভালোবাসা কি, তা বোধহয় রবীন্দ্রনাথ এর পরে সবথেকে সুন্দর করে প্রকাশ করেছেন এই মানুষটা। আমি জোছনা দেখা শিখেছি হিমুর কাছ থেকে। ভালোবাসার মানুষকে পাশে না পেয়েও যে তাকে নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসা যায়, তা শিখেছি রূপার কাছ থেকে। নিজের অনেক অনেক খারাপ সময়েও এই মানুষটার একটা বই হাতে নিয়ে অসংখ্যবার অনায়াসে পার করে দিয়েছি সুন্দর কিছু সময়। মজার ব্যাপার হোল রবীন্দ্রনাথ এর অনেক সুন্দর সুন্দর কবিতা, গান এর খোঁজও আমি পেয়েছি তাঁর বই পড়ে। সেই ছোটবেলার মত এই মানুষটা আমাকে এখন পর্যন্ত আরও অনেক হাজারবার অবাক হয়ে ভাবতে বাধ্য করেছেন, “কিভাবে এত সুন্দর লিখে মানুষ?? কিভাবে নিজের চিন্তাকে এত সুন্দর করে সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারে একটা মানুষ??”
উনার বই পড়ার সময় আমি প্রায়ই একটা কাজ করি। অসম্ভব ভালোলাগা লাইনগুলো একটা ডায়রিতে টুকে রাখি। আর এই কাজটা করতে গিয়ে প্রায়ই হয়রান হয়ে যাই। কয়টা লাইন টুকে রাখবো? এই মানুষটা যাই লিখেন তাই তো অসম্ভব ভালো লাগে আমার। এমন হলে তো একটা বই পড়তে বসলে গোটা বইটাই টুকে রাখতে হবে আমাকে!
এইতো গেল লেখার কথা। এখন আরেকটা কথা না লিখলেই না। সিনেমা। আমাদের দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের এই খারাপ সময়টাতেও এই মানুষটার কাছ থেকে আমরা পেয়েছি, “আগুনের পরশমণি”, “শ্রাবণ মেঘের দিন”, “শ্যামল ছায়া” এর মত সিনেমা। মুক্তিযুদ্ধ কি এটা বোঝার জন্য একটা “আগুনের পরশমণি” সম্ভবত খুব কম কিছু হবে না।
এই মানুষটা অনেক দিয়েছেন আমাকে, অনেক দিয়েছেন আমাদের। অনেক ভালো থাকুন স্যার। অনেক ভালো। আল্লাহ আপনাকে আরও অনেক বছর বাঁচিয়ে রাখুন। আমরা যে আরও অনেক কিছু চাই আপনার কাছ থেকে! তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন। আমি কিন্তু বইমেলায় আপনার নতুন বই না থাকলে বইমেলাতেই যাব না আর!
আজ ১৩ নভেম্বর, এই অসম্ভব গুণী মানুষটার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন স্যার। আজকের দিনটা ফিরে ফিরে আসুক প্রতিবছর...আরও অনেক বছর।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ১:৫৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



