somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্ল্যাক আউট । বাংলা চলচ্চিত্রের কবরে গজানো রোমান্টিক ঘাসের শিকড় উপড়ানোর গল্প

২৮ শে নভেম্বর, ২০১১ রাত ১২:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছে। এক ধরনের মানুষ হইতেছে যারা নাকি

ব্ল্যাকআউট দেখছেন, আর অন্য দলে আছে যারা যারা ব্ল্যাকআউট দেখেন নাই তারা সবাই। যারা দেখেন নাই তাদের নিয়া কোনো কথা নাই, কিন্তু যারা যারা দেখছেন তাদের নিয়া দুইটা কথা আছে।



তো, যারা নাকি ব্ল্যাক আউট দেখছেন, তাদের আবার দুই দিয়া ভাগ দিলাম। এক

ভাগ হইলো যারা ব্লাকআউট দেইখা বুইঝা ফেলছেন ফিল্ম কী জিনিশ, আর আরেক ভাগে আছেন যারা দেইখা তেমন কিছুই বুইঝা উঠেন নাই। যারা বুইঝা গেছেন তাদের দুই দিয়া ভাগ দিলে এক ভাগ হয়তো ফিল্মটা পছন্দ করবেন, আরেকভাগ পছন্দ করবেন না। আর, যেহেতু পছন্দ অপছন্দ ব্যক্তিগত বিষয়, সেইটা নিয়া কথা বাড়ানো অনুচিত। ফলে, এইখানে কথা শেষ।





কিন্তু আঁতলামী করতে গেলে আরো কিছু কথা বলা যায়; আর সেই কথা বলতে হবে যারা নাকি ফিল্মটা দেইখা কিছুই বুঝেন নাই, তারা কেন বুঝেন নাই সেই

প্রসঙ্গে। তাছাড়া, ব্লাক আউট নিয়া আমার একধরনের উদ্দীপনা তো আছেই, সেইটা প্রকাশের ছুতা খুঁজতে হবে তো!



রেনেসাউত্তর শিল্পের দুনিয়ায় ক্লাসিক বা ধ্রুপদী শিল্পকলারে পাশ কাটাইয়া যখন

রোমান্টিসিজমের জয়জয়কার সবদিকে, তখনকার কবিতা গান পেইন্টিং ইত্যাদি

বিষয়গুলা তো উপভোগ করা যাইতো খুব সহজেই। তেমন চলচ্চিত্রও। মা খালাগো

দেখছি শুক্রবার বিকালে বিটিভিতে বাংলা ছবি দেইখা মরাকান্না কাঁনতে। তখন

অবশ্য ভালো ভালো ছবিগুলাই দেখাইতো বিটিভিতে। সেইসব ছবিগুলা এমন, যে

মানুষকে সহজেই আবেগতাড়িত কইরা ফেলতো। মানবিক ভাবাবেগ, বোধ ইত্যাদির পিঠে হেলান দিয়া আমাদের চলচ্চিত্রমাধ্যম সহজেই দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করতে পারছিলো সেই সময়ে। সেইটা ছিলো বাংলা সিনেমায় রোমান্টিসিজমের যুগ।

তারপরে শুরু হইলো বাংলা চলচ্চিত্রে নিও রিয়ালিজম। পথের পাঁচালী কিংবা বাইসাইকেল থিফ এই সিনেমাগুলা নিও রিয়ালিজমের সফল উদাহরন। ছবি দেখতে দেখতে নিজেরেও ছবির অংশ বইলা মনে হয়, ছবির ক্যারেক্টারগুলার ভিতরে নিজেরে খুঁইজা পাওন যায়। এক অর্থে, ক্যারেক্টারগুলা যেই জীবনটা যাপন করতেছে, দর্শকও সেইরকম জীবন যাপন করতে থাকে ছবি দেখতে দেখতে।





কিন্তু সেই রোমান্টিসিজম কিংবা নিও রিয়ালিজম এখন ইতিহাসমাত্র। সেইসব তত্ত্বের ঘাড়ে পা রাইখা পোস্টমর্ডানিজমই এখন একমাত্র সত্য। পোস্টমর্ডানিজমের অবস্থান মানবীয় আবেগ অনুভূতির থেকা একটু আড়ালে। এই থিওরী মতে, ক্যারেক্টারের জীবন আর যাপন করতে দেয়া হয় না দর্শকদের, বরং ছবির ক্যারেক্টারগুলারে পর্যবেক্ষন করতেই বেশী উপভোগ করেন অডিয়েন্স। এইটা হইলো বিমানবিকীকরন। শিল্পের বিমানবিকীকরন নিয়া সবার আগে থিওরী দিছিলেন স্পেনের দার্শনিক শ্রী অর্তেগা গাসেত। এই বিমানবিকীকরনরে অনেকে অমানবিকীকরন ভাইবাও ভুল বুইঝা থাকেন; সেইটা আলাদা বিষয়, প্রাসঙ্গিক হইলে অন্য কোথাও বলবো নে।





তো যেইটা বলতেছিলাম, পোস্টমর্ডান শিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হইলো এই শিল্পকলা মানুষকে দুই ভাগে ভাগ কইরা ফেলা- যারা এই শিল্পকলা বুঝে আর যারা নাকি বুঝে না। রোমান্টিসিজম ছিলো সার্বজনীন, নিও রিয়ালিজম বাস্তবতাঘনিস্ট , কিন্তু পোস্টমর্ডান হইলো গিয়া যারা যারা বুঝে, খালি তাদের জন্য; সবার জন্য না। সমাজতাত্ত্বিক দৃস্টিকোন থেকা দেখলে এইটা হইলো পোস্টমর্ডানিজমের একটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যমাত্র।



তো, এখন বলা যাক গল্পের পোস্টমর্ডানিজম নিয়া, যার কায়দা হইতেছে মাল্টি ফোকাসড,মাল্টি লেয়ার্ড; কাহিনী টানতে টানতে ধারাবাহিক পরিনতিতে না নেওয়া, অথবা তেমন কোনো কাহিনীতেই না যাওয়া, গেলেও মাঝখানে কোথাও ছাইড়া দেওয়া। সেই কাহিনী হইতে পারে খুবই আপাতসরল একটা গল্প; কিংবা গল্পহীনতার গল্পও হইতে পারে সেইটা। আর মাল্টি ডাইমেনশনের বিষয়টা তো পোস্টমর্ডানিজমের একটা কাঠামোগত দিক, এমন আরো আরো অনেক প্রসঙ্গ আছে এই পোস্টমর্ডান থিওরীর ভিতরে।



এইসব হিসাব বিবেচনায় নিলে খুব সহজেই বইলা দেওন যায় যে টোকন ঠাকুর নির্মিত চলচ্চিত্র ব্ল্যাক আউট সমান সমান বাংলাদেশের প্রথম পোস্টমর্ডান সিনেমা। এইটা বানানোই হইছে কারো কারো জন্য, সবার জন্য না। সবার কাছে এই সিনেমা সহজবোধ্য হইলে আলটিমেটলি পরিচালকের ব্যার্থতার সম্ভাবনাই উজ্জ্বল হইয়া দেখা দিত।





এইবার আসি ভিজুয়াল প্রসঙ্গে। সিনেমার শুরুটা ছিলো একজন কবি না জানি আর্টিস্টের

কৈশরজীবনের নস্টালজি; ধরতে না পাইরা আমি ভাইবা নিলাম ঐ কিশোর আসলে ডিরেক্টর নিজেই। প্রথম শটটাই ছিলো মাটিতে উবু হইয়া সেই কিশোর (নাকি ডিরেক্টর?) নাকে খত দিতাছে। এইটারে রূপক ভাইবা অডিয়েন্স ব্ল্যাকআউটের জার্নি শুরু করতে গেলে পর্দায় টাইটেল ভাইসা ওঠে। গ্রাফিক্সের চমৎকার ব্যবহারে টাইটেল বলতে থাকে কলাকুশলীদের নাম ধাম, আর না বইলা যেইটা বুঝায়া দেয় সেইটা হইলো ব্ল্যাকআউট উজ্জ্বল রঙে রাঙানো তীব্র চলচ্চিত্র। বাংলা চলচ্চিত্রে এমন অর্থবোধক টাইটেলের ব্যবহার ব্ল্যাকআউটেই প্রথম, তেমন আরো অনেক কিছুই প্রথম দেখাইলো ব্ল্যাক আউট। বাংলা চলচ্চিত্রে

এ্যানিমেশনের ইন্টেলেকচুয়াল ইমপ্লিমেন্ট ব্ল্যাক আউটের হাত ধইরাই শুরু হইলো। আসলে ব্ল্যাকআউট একটা টোটাল ফিল্ম, যার প্রতিটা মুহুর্তই চলচ্চিত্র। কবিতার সাথে ভিজুয়ালাইজ করা ফটোগ্রাফী, পৃথিবী শ্রেষ্ঠ চিত্রকলাগুলার সাথে একজন আর্টিস্টের মনস্তাত্ত্বিক আদান প্রদানের ভিতরে আমরা দেখতে থাকি এক একটা মন্তাজ কিভাবে চলচ্চিত্রে পুরানো সব গ্রামারের গলা টিপে ধরে। রাস্তায়

পইড়া থাকা একটা কাগজ ভাইঙ্গা বানানো এরোপ্লেন অথবা পানিতে ভাইসা না যাওয়া একটা কাগজের নৌকা আমাদের কিসের ইঙ্গিত দেয়? স্কাল্পচারের এক্সিবিশন দেখতে গিয়া রাফি যখন মিটির ছবি তোলা নিয়া ব্যস্ত, তখন পিছনের দরজা দিয়া যে ভাইগা গেলো সেই তো টোকন ঠাকুর। একদিকে আর্টিস্ট অন্যদিকে কবি- ব্ল্যাকআউট কি টোকন ঠাকুরের সেই কবিতা যেইখানে ক্যামেরাকে কলম ভাইবা নিয়া ডিরেকটর তার আত্নজৈবনিক কবিতাটা পুঁইতা থুইছে?



সেইসব মনস্তাত্ত্বিক গবেষনা ভুইলা যদি কথপকথনের দিকে নজর দেই, ব্ল্যাক

আউটের প্রতিটা ডায়লগ, স্পেশালি দুই বন্ধুর কথপকথন পরিপূর্ন স্যাটায়ারে।

রাস্তায় দূর থেকা দেইখা কেউ যখন জিগায় রাফি কই যাস, সে জবাব দেয়-

প্যারিসে! আর্ট কালচারের সংঙ্গা নির্ধারন করে তারা এইভাবে যে, আর্ট

কালচার হইলো গলির মোড়ে খাড়ায়া থাকা পতিতা, যাদের দেইখা নাকি তরুন সমাজ বিভ্রান্ত হয়! এমন আরো কত কী! সেই কবি মাদলের চোখে জীবনানন্দও স্যাটায়ার হইয়া ধরা দেয়। ছবির এক পর্যায়ে ধ্রুব এষ রাফি কে জানাইলেন যে আহমদ ছফার উপন্যাস নিয়া তিনি ছবি বানাইতে চান, সেইখানে ছবির মূল চরিত্র হিসাবে তিনি ছফাকেই ভাবতেছেন। তখন তিনি দুঃখ কইরা বলেন ছফা ভাই তো মইরা গেছেন, সেই ডায়লগের ইংরেজী সাবটাইটেলে দেখা যায় দ্যা প্রোফেট ইজ নো মোর। এইখানে সাবটাইটেলও আলাদা গুরুত্ব বহন করে, ভাবায়, যে ডিরেক্টর ছফা কে প্রোফেট কইলেন কেন?



প্রথাগত চোখ প্রথমে ঠিক দেখতে পায় না ব্ল্যাকআউটের পিছনের গল্প, প্রথাগত কান শুনতে পায় না সেইসব গান কেন বলতে চায় যে যিশু হাতে কুঠার নিয়ে চন্দ্র কোপায়। ফলে, এইটুকু প্রথাগত আলোচনা কইরা বলা সম্ভব না ব্লাকআউট কতটা কবিতা আর কতটা চলচ্চিত্র। সেইটা বুঝতে চাইলে মাটির শানকীতে সুরা ঢাইলা নিয়া একা একা ছাদে বইসা টের পাইতে হবে, সঙ্গে থাকতে পারে এক টুকরা আগুন। শেষ পর্যন্ত ব্ল্যাক আউট তো বলেই যে, আমি এবং আমার আগুন আমরা দুজন জমজ বোন জমজ ভাই।



তারপর, যেন আর কিছু মনে নেই! সবই ব্ল্যাকআউট!
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগটা তো ছ্যাড়াব্যাড়া হয়ে গেলো :(

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৫৭



আমি আমার ব্লগিং শুরু করি প্রথম আলো ব্লগে লেখালেখির মাধ্যমে। ব্লগটির প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কারণ প্রথম আলো ব্লগ আমায় লেখালেখিতে মনোযোগী হতে শিখিয়েছে । সে এক যুগ আগের কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

লুঙ্গিসুট

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৫

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

ছবি কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল।

একবার শাইখুল হাদিস মুফতি তাকি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, জীবনের সারকথা কী? উত্তরে তিনি এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

=মৃত্যু কাছে, অথবা দূরেও নয়=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



©কাজী ফাতেমা ছবি
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলি, আমারও সময় হবে যাবার
কি করে চলে যায় মানুষ হুটহাট, না বলে কয়ে,
মৃত্যু কী খুব কাছে নয়, অথবা খুব দূরে!
দূরে তবু ধরে নেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×